পুনর্গঠন কালক্ষেপণে বিএনপির তৃণমূলে অস্বস্তি
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি আদায় করাকে টার্গেট করে হিসাব কষছে বিএনপি। দলটির তৃণমূল থেকে শুরু করে শীর্ষ পর্যায় সবাই এখন মাঠে নামার কথা বলছেন, অথচ সাংগঠনিকভাবে দলটির প্রকৃত অবস্থা এখনো নড়বড়ে। ফলে অতীত ব্যর্থতার তকমা থেকে বের হয়ে সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে চায় দলটির হাইকমাণ্ড।
কাগজে-কলমে না থাকলেও আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দীর্ঘ প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে দলটি। সাংগঠনিক কার্যক্রমে দুর্বলতা কাটতে ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার ধাক্কা সামলে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে দলটির হাইকমাণ্ড। এই মুহূর্তে সরকারবিরোধী বড় আন্দোলনে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই দলটির। রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার অবর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চেষ্টা করছেন দল গোছাতে। যদিও সারাদেশে বিএনপির সাংগঠনিক কমিটি গঠন ও নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্বস্তি আছে।
কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হচ্ছে না প্রায় বছর পাঁচেক হলো। অনেক জেলা-উপজেলায় কমিটি নেই। অনেক জেলায় আংশিক কমিটি দিয়েই পার হচ্ছে বছরের পর বছর। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম-জাতীয় স্থায়ী কমিটিতেও অনেক দিন ধরে একাধিক পদ শূন্য। করোনায় কয়েক মাস বন্ধ থাকলেও ফের শুরু হয়েছে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম। তবে পর্যাপ্ত সময় পেয়েও দলকে ঢেলে সাজাতে অনেকটাই ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে দলটি।
সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল হয় বিএনপির। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়া এবং আদালত কর্তৃক রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার শর্ত রেখায় বেধে দেওয়ার পর আর কাউন্সিলের আয়োজন করতে পারেনি বিএনপি। অবশ্য বেশকয়েকবার সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েও কার্যত সফলতার মুখ দেখেনি দলটির হাইকমান্ড। বরং কমিটি গঠনের কালক্ষেপণে সাংগঠনিক অবস্থা স্থবির হয়ে পড়ছে বিএনপির।
এদিকে দলটির শীর্ষ নেতাদের কথা অনুয়ায়ী সারাদেশে দল পুনর্গঠনের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চায় বিএনপির হাইকমাণ্ড। সেক্ষেত্রে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘সারাদেশে জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে এবং দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে রাজপথ আন্দোলনের উপযুক্ত হিসাবে গড়ে তুলতে দল পুনগর্ঠন প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। যদিও কোথাও কোথাও সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে আমাদের এসব কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিনা কারণেই অনেক জেলায় কাউন্সিল করতে দিচ্ছে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম ভোটের পর আরো এলামেলো হয়ে পড়ে। প্রথমে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। পরবর্তীতে বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচন বাতিল চেয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। কিন্তু সিদ্ধান্ত অমান্য করে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নেওয়ায় তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অথচ চার মাস ব্যবধানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া নির্বাচিত নেতারা সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ নেন। আর মির্জা ফখরুল কেন শপথ নিলেন না, তা এখনো নেতা-কর্মীদের কাছে রহস্যই থেকে যায়। নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যানের পর দলীয় সংসদ সদস্যদের শপথ নেওয়া নিয়ে যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি, সেখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে দলটি দলটির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। ফলে দল গোছানোর কথা বললেও এখন পর্যন্ত সব জেলায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি বিএনপি। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠন হয়নি। তাই কমিটি গঠনে বাণিজ্যিক সিন্ডিকেটের কারণে রাজনীতিতে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং নানামুখী চাপের কারণে নেতা-কর্মীদের একটা অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে।
বিএনপির দফতর সূত্রে জানা যায়, বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক ইউনিট। পাঁচটি জেলায় কাউন্সিল সম্পন্ন হয়। ৩০ পূর্ণাঙ্গ কমিটির ৬টির মেয়াদ আছে। আহ্বায়ক কমিটি আছে ৫১টি যার বেশিরভাগ মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব কমিটির মধ্যে ২০১৪, ২০১৬ সালের আহ্বায়ক কমিটি ও ২০০৯ সালের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও রয়েছে। অথচ দলের গঠণতন্ত্র অনুযায়ী প্রত্যেক জেলা ও মহানগর কমিটির মেয়াদ দুই বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে ব্যর্থ হলে যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে আরও তিন মাস সময় নিতে পারবে। এই সময়েও কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলে পূর্ববর্তী কমিটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে। এরপর কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের শর্তে তিন মাসের জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেবে কেন্দ্র। আহ্বায়ক কমিটিও ব্যর্থ হলে কেন্দ্র থেকে কমিটি গঠন করে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে গঠনতন্ত্রে। কিন্তু এসব নিয়ম মানা হয় না।
ফলে যে মুহূর্তে দলটির নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা তখন দেখা যাচ্ছে কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে প্রায় সর্বত্র বিভক্তি বাড়ছে। দলে আধিপত্য বিস্তার এবং নিজস্ব বলয় সৃষ্টিতে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে বিদ্যমান কোন্দল-রেষারেষি দিন দিন প্রকট হচ্ছে। তৃণমূলে পুনর্গঠন আটকে আছে অজুহাত আর অভিযোগে। যে কারণে পরীক্ষিত ও মামলায় জর্জরিত নেতা-কর্মীরা অনেক জায়গায় পদ পাচ্ছেন না। ফলে এ নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভ বাড়ছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, শত প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে দলের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি পুনগর্ঠন চলমান। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জায়গায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। বেশকয়েকটি জেলায় কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে। আরো কয়েকটি জেলায় কাউন্সিলের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি রয়েছে।
সারাদেশে বিএনপির দশটি বিভাগীয় সাংগঠনিক এলাকা রয়েছে। ঢাকা ও ফরিদপুর বিভাগ এই দুই বিভাগে বিএনপির সাংগঠনিক ইউনিট ১৭টি। মানিকগঞ্জ জেলায় কাউন্সিল হয়েছে। ফরিদপুর জেলা ও মহানগরের আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ রয়েছে। অন্যান্য পূর্ণাঙ্গ ও আহ্বায়ক কমিটির একটিরও মেয়াদ নেই। গত বছরের ২০ মার্চ মাদারীপুর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়। চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা এই দুই বিভাগে ১৪টি সাংগঠনিক ইউনিট কমিটি রয়েছে। যার চাঁদপুর ছাড়া সব জেলা কমিটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। রাজশাহী বিভাগে ৯টি সাংগঠনিক ইউনিটের সবগুলোই মেয়াদোত্তীর্ণ। খুলনা বিভাগের ১১টি সাংগঠনিক ইউনিটের একটিরও মেয়াদ নেই। বরিশাল বিভাগে ৮টি সাংগঠনিক ইউনিট কমিটির মধ্যে বরগুনা ও পিরোজপুর আহ্বায়ক কমিটি ছাড়া বাকিগুলোর মেয়াদ নেই। বিএনপির দপ্তরেও তথ্য নেই ভোলা জেলার কমিটি সর্বশেষ কবে হয়েছে। তবে পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি জেলা কাউন্সিল এ মাসেই হতে পারে। রংপুর বিভাগের ১০টি সাংগঠনিক ইউনিট। এর মধ্যে দিনাজপুরে কাউন্সিল হয়েছে। ময়মনসিংহ ৬টি সাংগঠনিক ইউনিট কমিটির মধ্যে শুধু শেরপুর জেলা কমিটির মেয়াদ রয়েছে। তাও অবশ্য আগামী আগস্ট পর্যন্ত। সিলেট বিভাগের ৫টির মধ্যে শুধু সিলেট মহানগরের কাউন্সিল হয়েছে। অন্যগুলোর একটিরও মেয়াদ নেই।
জানতে চাইলে রাজশাহী বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ওবায়দুর রহমান চন্দন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, রাজশাহী বিভাগে দলের ৯ টি সাংগঠনিক ইউনিট যার পুনগর্ঠন শুরু হয়েছে। পুনগর্ঠন কবে শেষ হতে পারে এই মুহূর্তে নিদিষ্ট সময় সীমা বলা না গেলেও যতদ্রুত সম্ভব পুনগর্ঠন প্রক্রিয়া সমাপ্তি ঘটবে।
ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ ঢাকা প্রকাশকে বলেন, দলের ১১ সাংগঠনিক ইউনিট নিয়ে ঢাকা বিভাগ। আমরা ইতিমধ্যে গাজীপুর জেলা ও মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির কাউন্সিল করেছি। নারায়ণগঞ্জ জেলায় কাউন্সিলের জন্য কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। এছাড়াও ঢাকা বিভাগের প্রতিটি জেলায় সাংগঠনিক ভাবে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলমান, স্বল্প সময়ের মধ্যে পুনর্গঠন কার্যক্রম শেষ করা হবে।