ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
৫ বছরে ব্যয় দেড় হাজার কোটি টাকা, শুরু হয়নি মূল কাজ
রাজধানীতে যাতায়াতে ৩০ জেলার যানজট কমাতে ২০১৭ সালে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। আগামী জুনে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রকল্পে অনুমোদনের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মূল কাজই শুরু হয়নি।
এ সময়ে শুধু ফ্যাসিলিটিজ ফর ইমপ্লয়ারের জন্য আট একর জমি কেনা হয়েছে। তাতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। বুয়েট থেকে পাঁচ বছর ধরে প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয়। কিন্তু এখনো বাস্তব অগ্রগতি শূন্য। তাই সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্পটি সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তাতে এক লাফেই চার বছর সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সঙ্গে ব্যয়ও ২৫২ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৭ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তা যাচাই-বাচাই করতে সম্প্রতি প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় পরিকল্পনা কমিশন থেকে ফ্যাসিলিটিজ ফর ইমপ্লয়ারের জন্য রানাভোলা মোজায় আট একর (২৪ বিঘা) ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় হয়েছে। এর উত্তরে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- অধিগ্রহণ করা আট একর জমিতে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের অফিস সম্প্রসারণ কাজে বা ভবিষ্যৎ প্রকল্পের পুনর্বাসন সাইড হিসেবে ব্যবহার করা হবে। প্রথম সংশোধনের পরও বাস্তবায়ন হবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি জানতে ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা যায়, গত বছরের ৭ অক্টোবর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। বর্তমানে চায়না এক্সিম ব্যাংকের সইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর অনুমোদন দেয় সরকার। যা ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুনে বাস্তবায়নের কথা ছিল। সে সময় ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। এরমধ্যে বিদেশি ঋণ বা প্রকল্প সাহায্য ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। বাকি অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় ধরা হয়েছে।
বুয়েট থেকে ২০১৩ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই করে ২০১৬ সালের আগস্টে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়। এ সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার করা হয়। পরে এর সঙ্গে র্যাম প্রায় ১১ কিলোমিটার এবং ১৪ দশমিক ২৮ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও দীর্ঘ সময়ে প্রকল্পটির মূল কাজই শুরু হয়নি। গত অক্টোবর পর্যন্ত এক হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অপরদিকে মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী জুনে। তাই এটির প্রথম সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ সংশোধনীতে ব্যয়ও বেশি ধরা হয়েছে ২৬২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এরফলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১৭ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। এরমধ্যে প্রকল্প সাহায্য কমিয়ে ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। তবে ডলারের বিনিময়ের কারণে ব্যয় কিছু বাড়ছে। কারণ মূল ডিপিপিতে ৮০ দশমিক ৫৭ টাকা ধরা ছিল। বর্তমানে ৮৫ দশমিক ৮০ টাকা ধরা হয়েছে। বাকি কাজ শেষ করতে মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত।
পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্টরা জানান, সংশোধিত ডিপিপি আসার পর তা যাচাই-বাচাই করতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিছু ব্যাপারে অসঙ্গতি পাওয়ায় তা আবার সংশোধন করতে বলা হয়েছে। সব প্রক্রিয়া শেষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেতে উপস্থাপনের জন্য সুপারিশ করা হবে।
একনেক সভা জানানো হয়, এশিয়ান হাইওয়ে অ্যালাইনমেন্টের মধ্যে প্রস্তাবিত ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে। এটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকার সঙ্গে ৩০ জেলার সংযোগ স্থাপনকারী আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল-চন্দ্রা-করিডোরে যানজট অনেকটাই কমে যাবে।
২০১৩ সালে বুয়েটের মাধ্যমে প্রাক-সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুসারে প্রস্তাবিত অ্যালাইনমেন্টটি ছিল হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে-আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল হয়ে নবীনগর মোড় এবং ইপজেড থেকে চন্দ্রা পর্যন্ত। এ ২৪ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হলে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল হয়ে নবীনগর মোড় এবং ইপিজেড হয়ে চন্দ্রা পর্যন্ত সংযোগ স্থাপিত হবে।
প্রথম থেকে এ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে যুক্ত আছেন প্রকৌশলী মো. শাহাবুদ্দিন খান। সার্বিক ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘ঠিকাদার মোবিলাইজেশনের (সচল) কাজ চলছে। এ মাসেই মূল কাজ (পাইলিং) শুরু হবে।’
দীর্ঘ সময়ে বাস্তব অগ্রগতি শূন্য কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কাজই তো শুরু হয়নি। তাহলে অগ্রগতি হবে কেমন করে। শূন্য হওয়ায় স্বাভাবিক।‘
তাহলে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা কীভাবে খরচ হয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণে এ টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রায় ১১৫ একর ( ৪৪৫ বিঘা) ভূমি লাগবে। সড়কের পাশে প্রায় অর্ধেক ভূমি অধিগ্রহণ হয়েছে। আমি ২০১৭ সাল থেকে এ প্রকল্পের দায়িত্বে আছি। ঋণ চুক্তি থেকে ঠিকাদার নিয়োগ হয়েছে। চীনের একটা কোম্পানি এ কাজ পেয়েছে। তারা আগামী মাসে ইনশাআল্লাহ মূল কাজ শুরু হবে।’
প্রকল্পের ধীর গতির ব্যাপারে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘দেখেন, জবাবদিহির জায়গা নেই বলেই নির্দিষ্ট সময়ে তো দূরের কথা কয়েকবার সংশোধন করেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্প শেষ হচ্ছে না। এরফলে একদিকে জনগণের করের টাকার অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। সংশ্লিষ্ট এজেন্সির গাফেলতির কারণেই এভাবে অর্থের অপচয় হচ্ছে।’
আর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আমরা সবাইকে বারবার বলছি, নির্ধারিত সময়ে যাতে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। কারণ সময় মতো কাজ করলে সবাই উপকৃত হয়। এতে অর্থেরও অপচয় হয় না। তবে ভূমি অধিগ্রহণ সমস্যাটাও বড় ব্যাপার হয়ে গেছে। এ জন্য অনেক প্রকল্প দেরি হচ্ছে।’
জেডএ/এসএন