পাসপোর্ট অফিসে অনিয়মই এখন নিয়ম
রাজধানীর মালিবাগ এলাকায় ফলের ব্যবসা করেন সিরাজ মিয়া, গ্রামের বাড়ি রংপুর বিভাগের নীলফামারী জেলার খোকশাবাড়ি ইউনিয়নে সেখানে স্ত্রী-কন্যা ও বাবা-মা নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। কিন্তু ইদানিং বাবা হায়দার আলী বুকে ও কোমরে ব্যথা অনুভব করেন। বাবার চিকিৎসা করাতে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার জানান, দেশে চিকিৎসা করানো এক প্রকার অসম্ভব। হায়দার আলীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাইয়ে নিয়ে চিকিৎসা করার পরামর্শ দেন ডাক্তার। এতে চিন্তার ভাঁজ পড়ে সিরাজ মিয়ার কপালে। বাবাকে উন্নত চিকিৎসা করাতে গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করতে হয় সিরাজ মিয়াকে।
খুব দ্রুতই বাবাকে নিয়ে ভারতে যেতে হবে। তবে বাবা-ছেলের কারও নেই পাসপোর্ট। পাসপোর্ট করাতে গতকাল বুধবার (১৮ মে) এপ্রিল আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে ধর্না দেন সিরাজ মিয়া। প্রয়োজনীয় কাগজ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও আসছে না ডাক। সিরিয়ালে আগে থাকলেও আগেভাগেই মিলছে না সেবা।
এদিকে লাইনের ফাঁকে দেন-দরবার হচ্ছে। দালালদের টাকা দিলেই মিলবে সেবা। টাকা দিলেই লাইন থেকে দালাল, দালাল থেকে আনসার আর আনসার থেকে কর্মকর্তার হাত ঘুরে মুহূর্তেই মিলছে সেবা। এগুলো হলো ফল ব্যবসায়ী সিরাজ মিয়ার ভোগান্তি ও পাসপোর্ট অফিসের দালাল এবং কর্মকর্তাদের সংঘবদ্ধ ঘুষ চক্রের চিত্র।
পাসপোর্ট অফিসে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দালালদের হাতে জিম্মি প্রক্রিয়া, সার্ভার জটিলতা, কর্মকর্তাদের অসদাচরণ, অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়ে সেবা প্রদানসহ নানা রকমের অনিয়মের আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে দেশের বেশির ভাগ পাসপোর্ট অফিস। বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে গেলে তারা শুধু সংশ্লিষ্ট অফিসার ডিজির কথা বলে পার পেয়ে যান। এবং কথায় কথায় কর্মকর্তারা তার নাম ব্যবহার করেন।
ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিন শত শত আবেদনকারী পাসপোর্ট করতে এসে পড়ে যান গোলক ধাঁধায়। অফিসের বাইরে ওঁৎ পেতে থাকা প্রতারক ও দালাল চক্রের খপ্পর এড়াতে অফিসের যে কারও কাছে পাসপোর্ট করার তথ্য জানতে গেলেও মেলে না সুরাহা। তারা পরামর্শ দেয় নির্ধারিত দালালদের দিয়ে পাসপোর্ট করার অথবা কোনো তথ্যই না দিয়ে এড়িয়ে যান। কর্মকর্তাদের পরোক্ষ ইন্ধনে নিয়োগ দেওয়া এসব দালাল ছাড়া গ্রাহক নিজ উদ্যোগে লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার চেষ্টা করলে তার আবেদনে নানাবিধ সমস্যা আর ভুল দেখিয়ে দিনের পর দিন ফেরত দেওয়া হয়। আবার যারা দেরি করে হলেও পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছেন তাদের পাসপোর্টের তথ্যে রয়েছে নানা অসঙ্গতি। সেটা সংশোধনে আরেক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার জালে জড়িয়ে যাচ্ছেন সেবাগ্রহীতারা।
অপরদিকে, দালাললের কাছ থেকে সেবা নিতে গেলেই গুনতে হয় মোটা অংকের টাকা। এসব টাকার একটি বড় অংশের ভাগ নেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পাসপোর্ট অফিসে ফরম পূরণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট ডেলিভারি পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় ঘুষ দিতে হচ্ছে। সব কাজ শেষ হওয়ার পরও পাসপোর্ট হাতে পেতেও গুনতে হয় আটশ থেকে হাজার টাকা। এদিকে সেবাপ্রত্যাশীদের সারি দীর্ঘ হলেও বাইরে থেকে দালালদের মাধ্যমে নেওয়া হয় টোকেন। এসব টোকেন আবার আনসারদের মাধ্যমে চলে যায় কর্মকর্তাদের কাছে। তারা আবার নির্ধারিত ফি নিয়ে মুহূর্তেই দিয়ে দেন সমাধান।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাসুদুর রহমান। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলাফল ভালো হওয়ার সুবাদে স্কলারশিপে কানাডায় যাওয়ার সুযোগ পান তিনি। প্রস্তুতিও চলে সব কিছুর। আবেদন করেন পাসপোর্ট করার। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে না পাওয়ায় কানাডায় যাওয়ার স্বপ্ন শেষ হওয়ার পথে তার।
পাসপোর্ট অফিসের সামনে আরেক ভুক্তভোগী দুবাই কর্মরত মামুনের সঙ্গে ঢাকা প্রকাশের এই প্রতিবেদকের কথা হয়। এ সময় মামুন বলেন, পাসপোর্ট নবায়নের জন্য কয়েকদিন এখানে আসছি কিন্তু কাজ হচ্ছে না। যতবারই যাই, বলে প্রসেসিং চলছে, কালকে আসেন, কালকে এলে বলে সার্ভারে সমস্যা, অপেক্ষা করেন। দিন তারিখ কিছুই বলে না। এমন অভিযোগ শুধু তাদের নয় অসংখ্য মানুষ বিভিন্নভাবে রাতের সময় পাসপোর্ট না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দালালদের দিয়ে পাসপোর্ট আবেদন করালে তুলনামূলক ভোগান্তি কম। পুলিশ ভেরিফিকেশন, জন্মনিবন্ধন সনদ আর সত্যায়িত করার সিল সবই আছে দালালের কাছে। দরকার শুধু টাকা। নিজে না গিয়েও পকেটভর্তি টাকা দিলেই হয় পাসপোর্ট প্রস্তুত। কিন্তু নিয়মানুসারে আবেদন করে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পাওয়া যায় না পাসপোর্ট।
এদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, নতুন পাসপোর্টেও আবেদনকারীদের তিন চতুর্থাংশকেই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হয়ে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলেই পুলিশ ভেরিফিকেশন নিয়েও শুরু হয় গড়িমসি। অথচ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি (সিটিজেন চার্টার) অনুযায়ী, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ইস্যু করতে ১৫ কর্মদিবস এবং জরুরি ফি এবং পুলিশ প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে সাত কর্ম দিবসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
অপরদিকে, ই-পাসপোর্ট প্রক্রিয়ায় বিতরণের ধরণ অনুযায়ী সাধারণ ১৫ কর্ম দিবসের মধ্যে, জরুরি সাত কর্ম দিবসের মধ্যে এবং অতীব জরুরি দুই কর্ম দিবসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। এছাড়াও ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদে এবং অনুকূল তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে তিন কর্মদিবস থেকে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেবা নিশ্চিত করার কথা। এ ক্ষেত্রে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ দেখা যায় না।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, দেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতি মাসে গড়ে দুই লাখ ২৬ হাজারের বেশি পাসপোর্টের আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জমা হয় দালালের মাধ্যমে। তাদের জমা করা আবেদন প্রতি পাসপোর্ট কর্মকর্তারা ঘুষ নেন নির্ধারিত রেট এক হাজার টাকা করে। সে হিসাবে পাসপোর্ট আবেদন থেকে প্রতি মাসে ঘুষ আদায় হয় ১১ কোটি ৩২ লাখ টাকার বেশি। বিশাল অঙ্কের এ ঘুষের টাকা থেকে ১০ শতাংশ হারে অর্থাৎ এক কোটি সোয়া ১৩ লাখ টাকার মতো পাঠানো হয় ঢাকায় পাসপোর্টের প্রধান কার্যালয়ে।
এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ে আসা নথিপত্রে ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার বিভাগের কর্মকর্তা মো. সাচ্চু মিয়া, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক রফিকুল ইসলামসহ ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণসহ বিভিন্ন অনিয়মের বিবরণ রয়েছে।
পাসপোর্ট আবেদনকারী (সেবা গ্রহীতা) পরিচয় দিয়ে একাধিক দালাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, সরকারি ফি থেকে বেশি যা নেই সেই টাকা থেকে খুব অল্প কিছু থাকে আমাদের। বেশির ভাগই চলে যায় পাসপোর্ট অফিসের লোকজন ও আনসার সদস্যের কাছে।
পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই কাজ করে দেওয়া যায় বলেও জানান তারা। আইন অনুযায়ী, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ইস্যু করতে সাধারণভাবে পাসপোর্ট প্রাপ্তির জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ তিন হাজার ৪৫০ টাকা। অপরদিকে, জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট প্রাপ্তির জন্য ১৫ শতাংশ ভ্যাটসহ ফিস ছয় হাজার ৯০০ টাকা।
শুধু ই চালান এবং সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে জমাকৃত এসব ফি গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা থাকলেও দালালরা হাতে হাতেই গ্রহণ করছেন টাকা। দালালের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান পেতে হলে একজন গ্রাহককে গুনতে হয় অন্তত ৯ হাজার টাকা। দর-কষাকষিতে ক্ষেত্রবিশেষ টাকার অংক আট হাজারে নামতে পারে।
তবে সেই সংখ্যাটা তুলনামূলক কম। ফলে দেখা যায়, দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে একজন গ্রাহকের অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে পাঁচ হাজার ৫৫০ টাকা। এই টাকা প্রায় পাঁচটি পক্ষ পায়। কে কত টাকা পাবেন, তা আগে থেকে নির্দিষ্ট করা। ফলে ভাগাভাগি নিয়ে পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সংঘাত বা অন্তঃকলহ দেখা যায় না।
ভুক্তভোগীদের এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পাসপোর্ট, ভিসা ও ইমিগ্রেশন) সেলিনা বানু বলেন, বাইরে দালাল চক্র কি করে তা আমাদের জানা নেই। আমরা তো দালাল নিয়োগ করি না। কে কত নিচ্ছে বা দিচ্ছে তার দায় আমাদের নয়। এ সবের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, তারাই পদক্ষেপ নেবে। আমাদের কাছে পৃথক কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সার্ভার জটিলতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিস্টেম আপগ্রেড করতে হলে সাময়িক জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়, যার কারণে এসব সমস্যা তৈরি হয়। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সার্ভার আমাদের সার্ভারের চেয়েও অনেক বেশি সমস্যা আছে। অনেক সময় দেখা যায় এনআইডির সার্ভার স্লো থাকায় আমরাই ভেরিফিকেশন করতে পারি না। সার্ভার যেহেতু টেকনিক্যাল বিষয় সেহেতু মাঝে মাঝে সমস্যা হতেই পারে। তবে সার্ভার আরও উন্নত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ডিজির (সহকারি) মেজর মো. মোরশেদ বলেন, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করি তবে বাইরের বিষয়টি আমরা দেখি না। বাইরের বিষয়ে অন্যরা দেখে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কথা বলতে হলে বিল্ডিং এর ডিরেক্টর আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কথা বলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিরেক্টর পাসপোর্ট অফিসের ডিরেক্টর (৬০২) মামুন আব্দুল্লাহ আল মামুন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, পাসপোর্ট অফিসের বাইরে সমস্যাগুলো আমরা দেখি না, এখানে পৃথকভাবে আমরা কাজ করি। এ বিষয়ে কথা বলতে হলে অ্যাডমিনের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, বাইরে অনিয়ম হয় বলছেন, ভুক্তভোগী কোনো ব্যক্তি আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ করেনি এর জন্য আমরা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারছিনা।
কেএম/আরএ/