দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে বেপরোয়া মজুতদার
আইন থাকলেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা। শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা হুঁশিয়ার করার পরও যতই দিন যাচ্ছে অতি মুনাফার লোভে অবৈধ মজুতে মরিয়া হয়ে উঠছে। স্বয়ং সরকার প্রধান শেখ হাসিনা পর্যন্ত বলছেন `অবৈধ মজুত করলে রক্ষা নেই।‘ তারপরও বাজার থেকে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে তেলসহ অন্যান্য পণ্য। বাজারে অভিযান করলেই ধরা পড়ছে অবৈধ মজুত। এর ফলে ভোক্তাদের বেশি দামে চাল, তেলসহ বিভিন্ন পণ্য বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, প্রতারিত হচ্ছেন।
শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বলছেন,মজুতদার এক ভাগও হবে না। তারপরও অপবাদের কালিমা পড়ছে সব ব্যবসায়ীদের উপর। তারা বলছেন, সরকারের ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে বাজারে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। মজুত ও সরবরাহে সংকট হচ্ছে। সময় থাকতে যখন যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তা করা হয় না। বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ করে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
গত দুই মাস থেকে ভোজ্যতেল নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি হলে সরকার নড়েচড়ে বসে। বিভিন্ন পর্যায়ে শুল্ক কমিয়েছে।তারপরও এর সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা।মিলমালিকদের দাবির প্রেক্ষিতে তেলের লিটারে ১৬০ থেকে এক লাফে বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা লিটার করা হয়েছে। তারপরও্র বাজার স্বাভাবিক তো দুরের কথা, এখনো অনেক বাজারে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু বাজারে অভিযান পরিচালনা করলেই ধরা পড়ছে মজুত করা তেল।
রবিবার (১৫ মে) চট্টগ্রামে ইপিজেড থানার মাইলের মাথা বাজারে মেসার্স বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজে এক অভিযানে তেলের দাম বাড়ানোর আগেই কেনা ছয় হাজার ১২০ লিটার সয়াবিন তেল মজুতের অভিযোগে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, রচট্টগ্রামের উপ-পরিচালক মো. ফয়েজউল্লাহ।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১২মে) জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার মন্ডলের নেতৃত্বে বাজার অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় রাজধানীর ওয়ারী থানার কাপ্তান বাজারে মেসার্স জনতা এন্টারপ্রাইজ থেকে অবৈধভাবে মজুদকৃত ৭ হাজার ৯৫৬ লিটার ভোজ্যতেল উদ্ধার করা হয়েছে। এভাবে সারা দেশে ভোক্তা অদিদপ্তরের বাজার অভিযানে ৩৬টি জেলায় ২ লাখ ছয় হাজার ৬৬৩ লিটার তেল জব্দ করে আগের রেটে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই দিন ভোক্তা-স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন অপরাধ করায় ১১৪টি প্রতিষ্ঠানকে ১৮ লাখ দুই হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
কিছুতেই তেলের সংকট কাটছে। তাই সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইতে মিলমালিক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে মতবিনিময় সভা হয়। তেলের ডিলাররা বাজার অভিযানের বিরুদ্ধে খেদোক্তি প্রকাশ করে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের নেতা গোলাম মাওলা বলেন,আইনে কি আছে মজুত করা (মাল রাখা) যাবে না? দোকানে মাল না রাখলে তাহলে কীভাবে বিক্রি হবে। ক্রেতা আসবে কীভাবে? অযথা অভিযানে ব্যবসায়ীদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ‘
তবে এফবিসিসিআইএর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘মজুত না করলে কীভাবে লাখ লাখ লিটার তেল উদ্ধার হচ্ছে। দাম বাড়ার সুযোগ নিতে তেল লুকানো হচ্ছে। এভাবে ৯৯ শতাংশ প্রকৃত ব্যবসায়ীকে এক শতাংশ হেও করতে পারে না। চোর-বাটপারের নেতা হতে পারি না।’
মজুতের শাস্তি বিশেষ আইনে ‘মৃত্যুদণ্ড’
খাদ্যপণ্য মজুতের বিরুদ্ধে আইনে আছে কঠোর শান্তি বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুতদারি নিষিদ্ধ করে আইনে মজুতদারি বা কালোবাজারির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদন্ডের মতো কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।অপরাধের মাত্রা ভেদে অন্যান্য মেয়াদের কারাদণ্ড ও জরিমানা করার কথা উল্লেখ রয়েছে।
আর খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ২০১১সালের ৪মে ১৩ নং আইনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে আমদানি কারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকরা কি পরিমাণ খাদ্যপণ্য মজুত করতে পারবেন। তাতে বলা হয়েছে-সরকারের লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী এক টনের বেশি খাদ্য সামগ্রী মজুত রাখতে পারবে না। ভোজ্যতেলের মধ্যে পাইকারি পর্যায়ে সয়াবিন ও পামওয়েল ৩০ টন ৩০ দিন, খুচরা পর্যায়ে ৫ টন ২০ দিন ও আমদানি পর্যায়ে ২৫ ভাগ ৫০ দিন মজুত রাখার নিয়ম করা হয়েছে। তারপরও অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, মজুত করার ব্যপারে আইনে কি আছে জানেন না তারা।
এই আইন এখনো কার্যকর বলে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে। শুধু তেল নয়, ধান,চাল মজুতের ব্যপারেও আইনে বলা হয়েছে পাইকারি পর্যায়ে ধান ও চাল ৩০০ টন ৩০ দিন এবং খুচরা পর্যায়ে ১৫ টন মজুত রাখা যাবে ১৫ দিন। আর আমদানিকৃত হলে ৩০ দিন রাখা যাবে। একে ভিত্তি করেই বাজারে প্রতিনিয়ত মজুতদারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে জাতীয় জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সফিকুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও ফোন না ধরায় কোনো মন্তব্য জানান সম্ভব হয়নি।
তবে প্রতিষ্টানটির পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ভোক্তা সংরক্ষণ-২০০৯ আইন অনুযায়ী ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা করতে কাজ করা হচ্ছে। সারা দেশে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কেউ আইনের ঊর্দ্ধে নয়। তাই প্রায় দিন বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেকে সর্তক হলেও অনেকে অতি মুনাফার লোভ সামলাতে পারছে না। তাই সুযোগ পেলেই মজুত করছে বিভিন্ন পণ্য।’কখনো কি মজুতদারি বন্ধ হবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে এই উপ-সচিব বলেন, ‘ভোক্তা আইন সংশোধন করা হচ্ছে। তখন হয়ত অনেকটা খাদ্যপণ্য মজুতের পরিমাণ কমে যেতে পারে।’
শুধু তেল নয়, দেশে আমন ধানের প্রচুর ফলন ও সরকারি পর্যায়ে খাদ্য মজুত দ্বিগুণ হলেও কমছে না চালের দাম। অবৈধভাবে মজুত করে পরে বেশি মুনাফা করতে বেশি দামে বিক্রি করছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। বাধ্য হয়ে ৭ফেব্রুয়ারি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, ‘অবৈধ মজুতের তথ্য পেলে মজুতদারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তারপরও লাগাম টানা যাচ্ছে না বিভিন্ন পণ্যের দামে। বাধ্য হয়ে গত ২৪ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘নিত্যপণ্যের বাজার বিভিন্ন সময় অসাধু সিন্ডিকেট এবংঅবৈধ মজুতদারদের কারণে বেড়ে যায়। এ সকল কর্মকাণ্ড প্রমাণ হলেই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কে শুনে কার কথা। তাই তো আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাতে ঠেকানো যাচ্ছে না নিত্য পণ্যের দাম। আমদানি বন্ধ ঘোষণার পরই পেঁয়াজের দামও বেড়ে গেছে।২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজির পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। শ্যামবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী নেতা মো. মাজেদ বলেন, ‘সময়ের কাজ সময়ে না করলে মালের দাম বাড়বেই।’
দূর করতে হবে বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি
সার্বিক ব্যাপারে জানতে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকাপ্রেকাশ-কে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আঞ্জুমান মফিদুল নয়। তারা লাভের আশায় মজুত করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের দেখার বিষয় সংকট কেন হচ্ছে। তা হবার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়ছে। তাহলে তো সরকারকে দেখতে হবে কোন কোন পণ্যের কত চাহিদা, সরবরাহ কতটা আছে। তাহলে বিপণনে সমস্যা হবার কথা না। কেউ বেশি লাভের আশায় মজুত করে রাখবে না। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে হুট করে পণ্য আমদানি কোনো সমাধানের পথ নয়। ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে আমদানি-বিপণনে। কারণ চাহিদার তুলনায় আমদানি বেশি হলে দাম কমে যায়। আবার আমদানি কম হলে বেড়ে যায় দাম। শুরু হয় সংকট। ধরা হয় ব্যবসায়ীদের। এটা হতে পারে না। আগেই সর্তক হলে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘একেবারে আমদানি বন্ধ না করে শুল্ক (ডিউটি) কাঠামো কমিয়ে-বাড়িয়ে বাজার স্বাভাবিক রাখা যায়। সরকারের ভালো ব্যবস্থাপনা থাকলে ব্যবসায়ীরা অসাধু পথে যেতে পারে না। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে বাজারে। বলির পাঠা হচ্ছে ভোক্তরা। অনেক সময় ব্যবসায়ীকেও শান্তি পেতে হচ্ছে।
মজুত নয়, স্বাভাবিক বাজারের পথ কোথায়? এমন প্রশ্নের জবাবে দোকানমালিক সমিতির এই নেতা বলেন, ‘ব্যবসায়ীকে ব্যবসার পরিবেশ দিতে হবে। জনগণের আয় বাড়াতে হবে। তবেই বাজার স্থির হবে। ভোক্তারা প্রতারিত হবেন না।’
জেডএ/এমএমএ/