‘আম্মু তেল পাইছি, কিন্তু এক হাজার টাকার কমে দিচ্ছে না’

‘আম্মু একটা পাইছি ১ হাজার টাকা চাচ্ছে। ২০ টাকা কম বললাম দিচ্ছে না, আঙ্কেল এক টাকাও কম নেবে না। আমি কি নেব?” ওপর প্রান্ত থেকে কি বলছেন শোনা না গেলেও বোঝা গেল তেল নিতে বলছেন। নিজের মানিব্যাগ থেকে ১ হাজার টাকার একটি নোট দিয়ে ৫ লিটারের একটি ‘তীর’ সয়াবিন তেল কিনলেন জাহিদ হোসেন। সকাল থেকে প্রায় ৬ থেকে ৭টি দোকান ঘুরে হন্তদন্ত হয়ে এসেছেন কৃষি মার্কেটের লাবিবা স্টোরে।
মা’র সঙ্গে কথপোকথন শেষে জাহিদ হোসেন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, সকালে আমাদের বাসার গলিতে যতগুলো দোকান আছে খুঁজেছি সয়াবিন তেল আছে কি-না। সবাই বলছে নাই। এরপর আম্মু বলছেন কৃষি মার্কেটে খোঁজ নিতে। এখানে এসেও ৬ থেকে ৭ টি দোকান খুঁজেছি, সবাই বলে তেল নাই। অবশেষে এই দোকানে পেলাম ৫ লিটারের এক বোতল। দাম বেশি তাই আম্মুর কাছে জেনে নিলাম তেল নেব কি-না। কি করার, দাম বেশি হলেও নিতে হবে। তেল না হলে তো রান্না হবে না।
জাহিদের মতোই তেল খুঁজছেন মো. রিপন। কৃষি মার্কেটের লাবিব স্টোরের সামনেই দেখা হয় রিপনের সঙ্গে। জাহিদের হয়তো সামর্থ্য আছে ১ হাজার টাকা দিয়ে ৫ লিটার তেল কেনার তাই মা’র সঙ্গে কথা বলে নিয়ে গেলেন। কিন্তু রিপনের সেই সামর্থ নাই, তাই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ছেন।
ঢাকাপ্রকাশকে রিপন বলেন, ‘এপাশে খুঁজলাম নাই, আমার মহল্লায় খুঁজলাম নাই। এখানে এসে পেলাম কিন্তু মনে হচ্ছে দামটা বেশি। ৫ লিটারের দাম ১ হাজার টাকা আমার কাছে খুব বেশি মনে হচ্ছে। এটা যদি আমি ১ হাজার টাকা দিয়ে নিই তাহলে আমার চলতে সমস্যা হয়ে যাবে। এ কারণে আমি নিচ্ছি না। এখন বাসায় হয়তো বা লিটার খানেক আছে, ওটা দিয়ে সপ্তাহ খানেক যাবে। ওটা দিয়েই চলতে থাকি পরে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ৫ লিটার তেল হলে আমার পরিবারে প্রায় মাস খানেক চলে যায়। রান্নার জন্য তেল তো লাগবেই। আগে হয়তো ৫ লিটার কিনতাম এখন ৪ লিটার কিনব এই আর কি’?
জাহিদ বা রিপনের দাম বাড়ানো কমানোর সঙ্গে কোনো হাত নেই। তাই বলে পেট তো আর থেমে থাকবে না। তাই দুই জনের দুইরকম পথ বেঁছে নিতে হলো। এরকম হাজার হাজার জাহিদ, রিপনরা মার্কেটে মার্কেটে ঘুরছেন। শুধু তেল আর তেল খোঁজা খুঁজি করছেন।
কৃষি মার্কেটের লাবিবা স্টোরের মালিক মো. শাহিনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তেল আছে কি-না? তিনি বলেন, ‘আছে। ৫ লিটারের কয়েকটা বোতল আছে। দাম কত জানতে চাইলে বলেন ১ হাজার টাকা। এটা নতুন দামের তেল কি না জানতে চাইলে বলেন, নতুন পুরতান নাই, বোতলে কোন মূল্য লেখা নাই, নিলে নেবেন না, নিলে কিছু করার নাই। আমি বেশি দামে কিনেছি যেভাবে পারছি বিক্রি করছি।’
পরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যেভাবে কিনছি সেভাবেই বিক্রি করছি। প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আরও একজন ক্রেতা এসে তেল আছে কি না জানতে চাইলে বলেন, নাই। তখন দোকানিকে বলা হয় আপনি না বললেন আছে, তাহলে দিলেন না কেন? জবাবে বলেন আরও কাস্টমার আছে না? সেও তো টাকা দিয়ে নেবে তাহলে তাকে দিলেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, যারা নিয়মিত কাস্টমার তাদের জন্য রেখে দিয়েছি।
কয়েক মিনিট আগেও ৫ লিটারের বোতল ১ হাজার টাকা বিক্রি করলেও সাংবাদিক পরিচয় জানার পর একই দোকানি বলেন, ৯৮০, ৯৭৫ টাকা যার কাছে যেটা পারছি বিক্রি করছি। এভাবেই তেলের দাম নিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন বিক্রেতারা।
কৃষি মার্কেটের জহির উদ্দিন স্টোরের জহির ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, আমার কাছে সয়াবিন তেল নাই। সকালে কিছু তেল ছিল বিক্রি করে দিয়েছি। আমি কোন তেল স্টকে রাখি নাই। আজকে রূপচাঁদা গ্রুপের ডিলার অর্ডার কেটে গেছে রাতে তেল পেলে সকালে দিয়ে যাবে বলেছেন। কত কার্টুন তেল অর্ডার করলেন জানতে চাইলে বলেন, ৫ কার্টুন দেবে বলছে। এই মার্কেটে ১০ কার্টুন তেল হলে এক সপ্তাহ ভালোভাবে চলত। আসলে তেলের নতুন দাম লাগলেই বাজারে আর সংকট থাকবে না।
কৃষি মার্কেটের পর মোহাম্মদপুর টাউনহল মার্কেটে অন্তত ৫ টি দোকান ঘুরেও সোয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। টাউনহল মার্কেটে পরনে পাঞ্জাবি মুখ ভর্তি দাড়ি এক ভদ্রলোককে দোকানে দোকানে জানতে চাইতে শোনা যায় দুই লিটারের বোতল আছে? সব দোকান থেকে না বলায় এক দোকানে গিয়ে দেখি তিনি তেল নিয়েছেন দুই লিটার। তবে বোতল না প্যাকেট তেল নিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ভদ্রলোক ঢাকাপ্রকাশকে জানান, কি করার তেল লাগবে বাসায়। দুই প্যাকেট তেল নিয়ে নিলাম। আপনার যদি লাগে নিয়ে নেন, বোতল পাবেন না। তার কথা অনুযায়ী তেল কেনার জন্য কয়েক দোকান খুঁজে তেল পাওয়া যায়নি।
ঈদের আগ থেকে বাজারে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে তেল নিয়ে ডিলার, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও পাইকারি বিক্রেতাদের মধ্যে চলে চোর পুলিশ খেলা। ডিলাররা বলে তেল পাচ্ছি না, তাই মার্কেটে দিতে পারছি না। অন্যদিকে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা বলেন তেল নাই কাস্টমারকে দেব কিভাবে? চারদিক থেকে অভিযোগ উঠেছিল দাম বাড়ানোর জন্যই এই সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের আবদারে অবশেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে লিটার প্রতি ৩৮ থেকে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে নতুন দামে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বর্ধিত দামে ৬ মে শুক্রবার থেকেই বাজারে তেল থাকার কথা। কিন্তু গত দুই দিন মার্কেটে তেল নেই বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি নতুন দামের লেবেল বোতলের গায়ে লাগলে বাজারে এই সংকট থাকবে না।
তেল নিয়ে এই কারসাজির জবাবে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, আগামীকাল (ররিবার) থেকে আমাদের টিম মাঠে নামবে। ঈদের বন্ধের কারণে সব কিছু ঝিমিয়ে পড়েছিল। যে কারণে অনেকেই সুযোগ নিয়েছে। রবিবার থেকে ভোক্তা অধিকারের টিম মাঠে নামবে; আশা করি পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ঈদের বন্ধের সময় মিলের উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ থাকার কারণে একটা সংকট তৈরি হয়েছে। আগামী দুই তিন দিনের মধ্যে সংকট কেটে যাবে বলে আশা করি। দাম আর কমবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা দেশে এবং বিদেশ থেকে আমদানি ও সরবারহ নিশ্চিতের উপর জোর দিচ্ছি।
বাণিজ্য সচিব বলেন, যারা এখন বেশি দামে তেল কিনছেন তার সুনির্দিষ্ট দোকোনের নাম ঠিকানা দিয়ে ভোক্তা অধিকারে অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসএম/
