চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতে দল পুনর্গঠনে বিএনপি
একদিকে দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিল-নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, অন্যদিকে বিএনপিও প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে বিএনপির প্রস্তুতি নির্বাচন কিংবা দলীয় কাউন্সিলের নয়, প্রস্তুতি সরকার পতন আন্দোলনের। ফলে দুটি লক্ষ্য সামনে রেখে অগ্রসর হওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড।
একটি হচ্ছে স্বল্পসময়ের মধ্যে দল পুনর্গঠন অন্যটি হচ্ছে আন্দোলন। সেজন্য চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগেই দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে সাংগঠনিক জেলা-উপজেলা কমিটির পুনর্গঠন শুরু করেছে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয় ৬ আগস্ট। এরপর কাউন্সিল করতে পারেনি বিএনপি। কিন্তু কাউন্সিল করতে না পারলেও ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির বেশকিছু পদে রদবদল করেছেন বিএনপির হাইকমান্ড। সম্প্রতি বেশকিছু জেলায় কাউন্সিলে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন শুরু হয়েছে।
এ ছাড়া বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সংস্থা (জাসাস) এর আহ্বায়ক কমিটি, তাঁতীদলের আহ্বায়ক কমিটি, কৃষকদলের আহ্বায়ক কমিটি, ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) এর আহ্বায়ক কমিটি, শ্রমিকদল ঢাকা মহানগর (উত্তর-দক্ষিণ) আহ্বায়ক কমিটি, স্বেচ্ছাসেবক দলের পুর্ণাঙ্গ কমিটি, ছাত্রদল নতুন আংশিক কমিটি এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ৭০টি ওয়ার্ডের নতুন আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ২৬ থানার ৭১ টি ওয়ার্ড অন্তর্ভুক্ত ৬২০ টি ইউনিট কমিটি অনুমোদন করা হয়েছে। তবে মেয়াদ শেষ হয়েছে অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠনগুলোকেও ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘ভবিষ্যৎ করণীয়’ নির্ধারণে করোনাকালিন সময় থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা প্রতি সপ্তাহে বৈঠক করছেন, যা এখনো অব্যাহত রেখেছে। এসব বৈঠকেই দল পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।’
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ কে বলেন, ‘সরকার পতনে আন্দোলনের বিকল্প নেই। চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতেই দল পুনর্গঠন চলছে। সারাদেশে জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলমান। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে এবং দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করে রাজপথ
আন্দোলনের উপযুক্ত হিসাবে গড়ে তুলতে দল পুনগর্ঠন প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। যদিও কোথাও কোথাও সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে আমাদের এসব কর্মকান্ডে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিনা কারণেই অনেক জেলায় কাউন্সিল করতে দিচ্ছে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- এবার ঢাকার রাজপথ আন্দোলন কে জোড়দার করতে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো যেমন-গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জ জেলার কমিটি কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কেন না ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘অবিশ্বাস্য’ বিপর্যয়ের পর বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দেখা দেয় এক ধরণের স্থবিরতা। ইস্যুভিত্তিক বেশকিছু কর্মসূচি বিশেষ করে বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে উদ্দীপনা দেখে সেটাকে বিবেচনায় নিয়েই এবার জোড়ালোভাবে দল গোছানো কাজ শেষ করতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জেলা পর্যায়ে সাংগঠনিক সফরে গিয়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন শুরু করেছেন।
সম্প্রতি বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমরা সংগঠন শক্তিশালী করছি। যারা বলে বিএনপি আন্দোলন করে না। রোজা গেলে বুঝতে পারবেন আন্দোলন কাকে বলে! আমাদের আন্দোলন চলছে। হয়তো সাময়িক বিরতি আছে। বিরোধীদলকে জেলে ভরে কেটে মেরে বলছেন দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল নেই। মনে রাখবেন বিএনপি এখনো আছে এবং থাকবে। যার নেতৃত্বে রয়েছেন আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।’
এদিকে, বর্তমান সরকারের পতন ঘটলেই কেবল একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব হবে বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা। তাদের মতে, এই সরকারের পতন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, খালেদা জিয়ার মুক্তি, জনগণের ভোটের অধিকারের লক্ষ্যে আন্দোলন করা হবে। এসব দাবিতে সরকারবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বড় ধরনের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে কাজ চলছে, এবং সেই প্রস্তুতির ক্ষেত্রে দল পুনর্গঠনের কোনো বিকল্প থাকছে না বলেও মনে করছে দলটির নেতারা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবার তরুণদের প্রধান্য দিয়ে দল পুনর্গঠন করতে চাচ্ছেন। সে লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ের আহ্বায়ক কমিটিতে তরুণদের দেখা যাচ্ছে। কমিটিতে ছাত্রদলের সাবেক নেতাদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। আর তরুণ-ছাত্রনেতাদের দিয়ে কমিটি গঠন করায় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। তারা একটি বিষয়ে একমত যে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সেই জন্য দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপিও কোনো নির্বাচনে যাবে না। ‘আমরা বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে। এ ছাড়া চূড়ান্ত আন্দোলনের আগেই সাংগঠনিক জেলার মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠন শেষ করতে কাজ করছে দল।’
বিএনপির দপ্তর সূত্র মতে-বিএনপি এখন সংগঠন গোছানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। সম্ভাব্য আন্দোলন সংগ্রাম বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো পুনর্গঠন করা হচ্ছে। ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি ব্যতীত এই মুহূর্তে চূড়ান্ত আন্দোলনে নেমে শক্তি ক্ষয় করতে চাচ্ছে না দলটির হাইকমান্ড। তবে বিএনপি শিগগিরই ঐক্যবদ্ধভাবে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাবে। সেই লক্ষ্যেই দলের নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদকমণ্ডলীর মতামত নিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ ছাড়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী আন্দোলন নিয়ে বিএনপি বেশ সতর্ক। উৎসাহ দেখানোর পক্ষপাতী নয় দলটি। ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত নিতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড।
দল পুনগর্ঠন প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘দল পুনর্গঠন চলছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি পুনগর্ঠনে কাজ করে যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় বাধা দেওয়া হচ্ছে। তবে সরকারের বাধাকে অতিক্রম করে আমরা কোথাও কোথাও আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যেটা হবে সেটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে তার আগে এই অবৈধ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, এবং সেই পদত্যাগের যে আন্দোলন সেই আন্দোলনে এবার সবাইকে কোমর বেঁধে নামতে হবে। এটা জীবন মরণের প্রশ্ন। আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্ন, সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, ভোটের প্রশ্ন এগুলোর সুরক্ষার জন্য এবার জীবনপণ করে আমাদেরকে রাস্তায় নামতে হবে।’
এমএইচ/এমএমএ/