সারাদেশে ফের সক্রিয় অনলাইন জুয়া চক্রের সদস্যরা
সারাদেশে ফের সক্রিয় হচ্ছে অনলাইনে জুয়া চক্রের সদস্যরা। জুয়া খেলার নামে সাধারণ মানুষের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে এ চক্রটি। সম্প্রতি এই চক্রের বেশকিছু সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেও থেমে নেই তাদের কার্যক্রম। ঈদকে সামনে রেখে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এ চক্র।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, কয়েকবার এই চক্রের সদস্যরা গ্রেপ্তার হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর তারা জেল থেকে বের হয়ে এসে এবং কৌশল পরিবর্তন করে তারা আবারও এসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়। আমাদের কাছে নতুন রূপে তথ্য এসেছে ঈদকে সামনে রেখে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
অনলাইন জুয়া এবং মোবাইল ফোন দিয়ে কার্ড ও লুডু খেলে প্রায় তিন লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মহাখালী এলাকার কড়াইল বস্তি রফিক মিয়া। তিনি বলেন, বস্তি এলাকার নায়েব আলী, জুনায়েদ, সোহাগসহ আমরা অনেকে এই জুয়ায় আসক্ত হয়ে কয়েক লাখ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ক্রিকেটের জুয়া আমরা নিয়মিত খেলতাম। তবে প্রতিজ্ঞা করেছি আর জুয়া খেলব না।
রাজধানীর আজিমপুর এলাকার বাসিন্দা গনি মিয়া। পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। বনানীতে একটা হোটেলে বসে ক্রিকেট বেটিং অ্যাপের জুয়ার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত। তিনি এখন একটি ছোট চায়ের দোকান দিয়ে কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
বেটিং অ্যাপে জুয়ার ফাঁদ যে শুধু শহর কেন্দ্রিক তা নয়, শহর ছাপিয়ে তা এখন দেশের আনাচে কানাচে। জুয়ার এ ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে বনশ্রীতে অন্তত শতাধিক ব্যক্তি জুয়ার ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। আর এটি যদি পুরো রাজধানী জুড়ে হিসেবে করা যায় তবে তা হবে লক্ষাধিক। রাজধানীর অলিতে-গলিতে বিভিন্নভাবে অনলাইনে জুয়া খেলছে প্রাপ্তবয়স্ক কিশোররা।
তথ্য বলছে, বাংলাদেশে এখন আলোচিত জুয়া ক্রিকেট বেটিং। এই জুয়া এখন ছড়িয়ে পড়েছে শহর থেকে গ্রামে। একে কেউ বলে টাকা লাগানো, আবার কেউ বলেন বাজি। বিপিএল, আইপিএলসহ নানা খেলা চলার সময় চলে এই জুয়া বা বেটিং। বিপিএল, আইপিএল, বিশ্বকাপ, ওয়ানডে, এমনকি দেশ-বিদেশের টেস্ট খেলা ঘিরেও চলে বাজিকরদের রমরমা জুয়া। যেখানে জড়িয়ে পড়েছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, যুবক ও ব্যবসায়ীসহ অনেকেই।
এমনকি সমাজের শ্রমজীবী মানুষেরা, যারা ‘দিন আনে দিন খায়’ তারাও এই জুয়ার জালে পড়ে হারাচ্ছেন কষ্ট করে জমানো সামান্য পুঁজি। এছাড়া স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছাত্ররা বিপথগামী হচ্ছে। একইসঙ্গে জুয়ায় হার-জিতকে কেন্দ্র করে পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও চলে এই জুয়া বা বেটিং। ক্রিকেট বিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোতেও দেখা যায় বেটিং এর অপশন। বেটিং এর দুটি জনপ্রিয় ওয়েবসাইট হলো বেট৩৬৫ এবং বেটওয়ে।
ক্রিকেটের জুয়া
ক্রিকেট জুয়া হয় নানাভাবে। দলের হার-জিত, পরের বলে কত রান বা ছয়-চার হবে কি না, পরের ওভারে ব্যাটসম্যান আউট হবেন কি না, একজন বোলার কত উইকেট পাবেন, ব্যাটসম্যান কত রান করবেন, দলের কত রান হতে পারে, নির্দিষ্ট দল কত রান বা উইকেটের ব্যবধানে জিতবে ইত্যাদি ছোটখাটো নানা বিষয় নিয়েই চলছে বাজি ধরা। বাজির দরও ঠিক করেন নিজেরাই। এই বেটিং বা জুয়া সাধারণত দুই দলের হার-জয়ের ওপর ধরা হয়। এই ক্ষেত্রে ভালো দল, যার জয়ের সুযোগ বেশি তার বাজির হার দুই আর অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল এক।
এই বাজির ক্ষেত্রে বেশিরভাগ জুয়ারিই দুর্বল দলের হয়ে বাজি ধরে থাকে। কেননা এতে বিনিয়োগ কম থাকে আর লাভ বেশি। বল বাই বল বেটিং, দলের, প্রতি ওভার টস-খেলোয়াড় বুঝে যেভাবে চলে এসব জুয়া।
সবচেয়ে বেশি জুয়া হয় আইপিএল ঘিরে
ক্রিকেটবিশ্বে সবচেয়ে ধনী ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)। তাদের আয়োজন করা শতকোটি ডলারের লিগ আইপিএল খেলতে মুখিয়ে থাকেন খেলোয়াড়রা। ক্রিকেটবিশ্বে সবচেয়ে বেশি জুয়া হয় আইপিএল ঘিরে। গত বছরের তথ্য মতে, ভারতে জুয়ার বাজার ৬ হাজার কোটি ডলার বা ৫ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার। বাংলাদেশের ক্রিকেট ভারতের উচ্চতায় পৌঁছেনি। তবু বাংলাদেশের পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে পাঁচতারা হোটেল পর্যন্ত সব জায়গাতেই ক্রিকেট নিয়ে বাজি চলে।
গোয়েন্দারা বলছেন, দেশে ক্রিকেট জুয়ার বাজার আনুমানিক ৭ হাজার কোটি টাকারও বেশি। যে যেভাবে পারে এই জুয়ায় লিপ্ত হয়। শুধু শহরে নয় দেশের আনাচে-কানাচে অনেকেই অনলাইন জুয়াসহ বিভিন্ন জুয়াই আসক্ত। গোয়েন্দা তথ্য বলছে, তবে সাম্প্রতি অনেক জুয়াড়িদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। অনলাইনে জুয়া খেলার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা হয় বেশিরভাগ দেশের বাইরে থেকে। এই জুয়া খেলার কারণে দেশের অনেক অর্থ পাচার হচ্ছে।
জানতে চাইলে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের অতিরিক্ত ডিআইজি কামরুল আহসান বলেন, আমরা বিভিন্ন সাইটে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকার লেনদেন হতে দেখি। আইপিএল, বিপিএল ও বিশ্বকাপের সময় এর আসর থাকলে এ লেনদেন বেড়ে যায়। বেশির ভাগ জুয়া হয় ক্রিকেট নিয়ে। ফুটবলের খেলার সময়ও এই জুয়া চলে। বর্তমান প্রিমিয়ার লিগ নিয়েও জুয়াড়িদের আগ্রহ বাড়ছে। পাশাপাশি আছে বিভিন্ন দোকান, ক্লাব ও হোটেলে বসা বাজির আসর। সেখানে কত টাকা লেনদেন হয় বলা কঠিন। তবে বছরে অনলাইন জুয়ায় পাচার হয়ে যায় প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো। এটা ঠেকাতেই নিরলস কাজ করে চলেছি আমরা।
সিআইডির হিসাব মতে, বাংলাদেশে দিনে (১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা) গড়ে ১২ দশমিক ৫ কোটি টাকা হিসাবে ধরে বছরে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি অবৈধ জুয়ার সাইটে লেনদেন হয়।
ক্রিকেট জুয়া তদন্তকারী গোয়েন্দাদের ধারণা, দোকান, ক্লাব, হোটেলেও এই অঙ্কের কাছাকাছি লেনদেন হয় বছরজুড়ে। সে হিসাবে অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকার জুয়ার বাজার আছে বাংলাদেশে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। দ্রুত এ বিষয়ে ফলাফল আসবে। কয়েকদিন আগেও জুয়ার মূল হোতাসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, কয়েকটি চক্রের সন্ধান নিয়ে কাজ চলছে আশাকরি ভালো রেজাল্ট আসবে।
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, মানি লন্ডারিং নিয়ে কাজ করে সিআইডি। তারা যদি বলে দিনে জুয়ার সাইটে ১০ থেকে ১৫ কোটি টাকা অনলাইনে অবৈধ লেনদেন হচ্ছে, তাহলে তথ্যটি ঠিকই আছে মনে হয়। তিনি বলেন, আমরাও মনিটরিং করছি। এ চক্রকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে এর আগে র্যাব অনেক জুয়াড়িদের আইনের আওতায় এনেছে। আশাকরি দ্রুত সময়ের মধ্যে অনলাইনে জুয়া পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সাম্প্রতিককালে জুয়াচক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তারের করে সিআইডি। তাদের ধরার পর সিআইডি জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- তোফায়েল ইসলাম রাসেল, শাকিল খান, পারভেজ, সাগর ও জিয়াউল হক রনি। তারা সবাই মেধাবী। প্রত্যেকে একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করে।
জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে চক্রটি বিভিন্ন ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে জুয়ায় আসক্তদের যুক্ত করে। তাছাড়া জুয়া পরিচালনাকারীরা বেকার যুবকদের অল্প সময়ে টাকা কামানোর লোভ দেখিয়ে তাদের সর্বস্ব লুটে নেয়। তারা অবৈধভাবে ই-ট্রানজেকশনের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচারও করে।
তিনি বলেন, জুয়া পরিচালনার জন্য সাম্প্রতিক গ্রেপ্তারকৃত রাসেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ডলার বাই অ্যান্ড সেলিং’ গ্রুপের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে শাকিল রাসেলের বিশেষ সহযোগী এবং মাহিম খান (ছদ্মনাম) নামে ব্যবসায়ী হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করে ‘৯ উইকেট’ নামে অপর একটি অনলাইন জুয়ার ওয়েবসাইট ও বেট৩৬৫ নামের ওয়েবসাইটে অনলাইন গ্যাম্বলিং করে থাকে।
সিআইডি আরও জানায়, চক্রটি অনলাইনে জুয়া খেলে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেছে। এবং অনেক টাকা বিদেশে পাচার করেছে। এ চক্রের এজেন্ট সহকারী ও পরিচালনাকারীদের আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।
কেএম/এএস