চট্টগ্রাম বন্দর
শেড ভাড়া বেশি, গাড়ি খালাসে অনীহা আমদানিকারকদের
চট্টগ্রাম বন্দরে এক সময় চার শেডে গাড়ি রাখার জায়গা মিলত না। আমদানিকারকদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গাড়ি রাখার শেড-ইয়ার্ডের পরিধি বাড়ানো হয়। ২০০৭ সাল থেকে গাড়ি রাখার ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন শেড-ইয়ার্ডে চার হাজার ইউনিট গাড়ি রাখা যায়। ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধির পর খালাসও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু উল্টো গাড়ি খালাস কমে গেছে। জাপান থেকে থেকে রো রো জাহাজে (গাড়ি পরিবহনের জন্য বিশেষায়িত জাহাজ) আমদানি করা বেশিরভাগ গাড়ি খালাস হচ্ছে খুলনার মোংলা বন্দরে। আমদানিকারকরা বলছেন, ফ্রি টাইমের পর চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি রাখার ভাড়া আগের চেয়ে অন্তত আটগুন বেশি। আবার একই গাড়ির জন্য ফ্রি টাইমের পর গাড়ি রাখার ভাড়া খুলনার মোংলা বন্দরে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে অনেক কম। তাই চট্টগ্রাম বন্দরে আসা রো রো জাহাজ থেকে অল্প পরিমাণ গাড়ি খালাস করা হচ্ছে। বেশিরভাগ গাড়ি নিয়ে রো রো জাহাজ যায় মোংলা বন্দরে। আর চট্টগ্রাম বন্দরে দিনের পর দিন গাড়ি রাখার শেড ইয়ার্ডের বড় অংশ খালি থাকছে। চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ির চার হাজার ইউনিট ধারণ ক্ষমতার বিপরীতে শুক্রবার (২৫ মার্চ) গাড়ি ছিল ৭৮৩ ইউনিট। যা ধারণ ক্ষমতার চার ভাগের এক ভাগেরও কম।
আমদানিকারকরা বলছেন, শুধু গাড়ি রাখার ভাড়া বেশি হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগ সূত্র জানায়, রো রো জাহাজ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ি খালাসের পর পরই ভাড়া গোনা শুরু হয় না। বন্দরে জাহাজ থেকে গাড়ি খালাসের পর ফ্রি টাইম (শেড/ইয়ার্ডে ভাড়া ছাড়া অবস্থান সময়) থাকে চারদিন। এই চারদিন ভাড়া গুনতে হয় না আমদানিকারকদের। চারদিন পর থেকে ভাড়া গোনা শুরু হয়। ভাড়া নির্ধারণ হয় গাড়ির ওজন ও সিসি ভেদে। গাড়ি রাখার ভাড়া অন্তত আটগুন বেশি দিতে হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। মোংলা বন্দরে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তাই চট্টগ্রামের আমদানিকারকরা ক্ষতির মুখে পড়েও খুলনার মোংলা বন্দরে গাড়ি খালাস করেন।
গাড়ি আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে যে ভাড়ায় গাড়ি ২ দিন রাখা যায় একই ভাড়ায় মোংলা বন্দরে গাড়ি ৭ থেকে ৮ দিন রাখা যায়। শুধু বাড়তি ভাড়ার কারণে চট্টগ্রামের আমদানিকারকরাও চট্টগ্রাম বন্দর এড়িয়ে চলেন। তারা মোংলা বন্দরে গাড়ি খালাস করতে বেশি আগ্রহী।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরে জাপানের বন্দর থেকে আসা গাড়িবাহী রো রো ভ্যাসেল ভিড়লে খালাস করা হয় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। বাকি ৭০ শতাংশ গাড়ি নিয়ে একই জাহাজ চলে যায় মোংলা বন্দরে। গাড়ি খালাস কম হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে গাড়ির শেড-ইয়ার্ড বছরের প্রায় পুরো সময় থাকছে ফাঁকা। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরে ইয়ার্ডগুলোতে প্রায় সময় বাড়তি কনটেইনার থাকে। শুধু ফাঁকা থাকে গাড়ি রাখার জন্য নির্মিত পৃথক শেড ইয়ার্ড। গেল জানুয়ারি থেকে চলতি মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিনের হিসাব নিয়ে দেখা যায়, ৪ হাজার ইউনিট ধারণ ক্ষমতা থাকলেও গাড়ি ছিল ৯০০ ইউনিট কিংবা এক হাজার ইউনিট। কোন সময় গাড়ির সংখ্যা ৬০০ ইউনিট কিংবা ৭০০ ইউনিটে নেমে আসে। মাসজুড়ে শেড ইয়ার্ডের বড় অংশ ফাঁকাই থাকে।
চট্টগ্রাম বন্দরের হিসাব বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ফ্রি টাইমের পর প্রথম ৭ দিনের জন্য প্রতিটি গাড়ি রাখতে মোট ভাড়া দিতে হচ্ছে ৭৯৩ টাকা। এই ভাড়ার সঙ্গে ৫০৩ টাকা নানা ধরনের চার্জ যুক্ত হয়ে ৭ দিনের ভাড়া দাঁড়ায় ১ হাজার ২৯৩ টাকা। পরবর্তী ৭ দিন একই গাড়ির জন্য নানা ধরনের চার্জ সহ ভাড়া দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৮৩ টাকা। ১৪ দিন পরেও খালাস না নিলে প্রতিদিনের জন্য ভাড়া গোনা শুরু হয়। প্রতিদিনই প্রতিটি গাড়ির জন্য দিতে হয় ৭০০ টাকা করে। অর্থাৎ আগে প্রথম ৭ দিন মিলে ১ হাজার ২৯৩ টাকা করে ভাড়া গুনতে হতো আমদানিকারকদের। ১৪ দিন পর প্রতিদিনই গাড়ির ভাড়া গুনতে হয় ৭০০ টাকা করে। ১৪ দিন পর সপ্তাহ ভিত্তিক ভাড়ার পরিবর্তে দৈনিক ভিত্তিক ভাড়া গোনা শুরু হয়।
অপরদিকে মোংলা বন্দরে জাহাজ থেকে গাড়ি খালাসের পর প্রথম চারদিন ফ্রি টাইম। এরপর ৭ দিন প্রতিটি গাড়ি রাখার জন্য ভাড়া গুনতে হয় ৪০০ টাকা। পরের ৭ দিন ভাড়া গুনতে হয় ৭৬৭ টাকা। এরপর বন্দর থেকে গাড়ি ছাড় না করলে অর্থাৎ ১৪ দিন পার হলে প্রতিদিন ১২৯ টাকা করে চার্জ গুনতে হয় আমদানিকারকদের। যা চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে অন্তত ছয় গুন কম।
গাড়ির ইয়ার্ড শেড বছরের বেশি সময় ফাঁকা থাকছে জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ফ্রি টাইমের চারদিন পর আমদানি করা গাড়ি রাখার রেন্ট বা ভাড়া বেশি। মোংলা বন্দরে রেন্ট কম। তাই বেশিরভাগ আমদানিকারক খুলনার মোংলা বন্দরে আমদানি করা গাড়ি খালাস করেন।
গাড়ি আমদানিকারকের সংগঠন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকলস ইম্পোটার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বারভিডা)। সংগঠনের সাবেক সভাপতি আবদুল হক বলেন, চট্টগ্রামের আমদানিকারকদের পাশাপাশি দেশের অন্য এলাকার আমদানিকারকরা চট্টগ্রাম বন্দরেই গাড়ি খালাস করতে চান। কিন্তু বড় সমস্যা ফ্রি টাইমের পর ভাড়া। চট্টগ্রাম বন্দরের গাড়ি রাখার বাড়তি ভাড়া কোন মতে ব্যবসা বান্ধব নয়। খুলনার মোংলা বন্দরে ফ্রি টাইমের পর প্রতিদিনের গাড়ি রাখার ভাড়া অনেক কম। আর চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন গাড়ি রাখার ভাড়া ফ্রি টাইমের পর ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। আমদানিকারকরা চট্টগ্রাম বন্দরেই গাড়ি খালাস করতে চান। কিন্তু বাড়তি ভাড়া এড়াতে বাধ্য হয়ে মোংলা বন্দরকে বেছে নেন। এতে শুধু আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তা নয়, চট্টগ্রাম বন্দর রাজস্ব আয় কম পাচ্ছে।