বিষাদে ঢাকা পূজার আনন্দ
মহালয়াতেই ম্লান পূজার আনন্দ। আল্পনা আঁকার কথা ছিল মণ্ডপের আঙিনায়, কিন্তু চন্দনের ফোঁটা আঁকতে হচ্ছে মৃত স্বজনের কপালে। আপনজনের শেষ যাত্রায় অশ্রুর নীবর বহতা। যেখানে ঢাকের বাড়িতে নেচে উঠার কথা, সেখানে অবনত মস্তকে স্বজনের মরদেহের সৎকারে ব্যস্ত পূজারিরা।
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের মণ্ডপগুলোতে ঢাকের বাড়ি, শাঁখের আওয়াজ নেই, নেই গৃহীনির উলুধ্বনি। আছে কেবল শোকস্তব্ধ স্বজনের গুঁমরে উঠা আর ফোঁপানো কান্নার শব্দ। কেউ কেউ এখনো ছুটে বেড়াচ্ছেন নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে। স্বজন ও প্রতিবেশীদের এমন করুণ বিদায়ে বিষাদে মলিন সবার মুখ। ঝলমলে মণ্ডপগুলোতে ফিকে হয়ে গিয়েছে উৎসবের রং।
আর মাত্র একদিন পরেই শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মালম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজা। পূজা শুরুর প্রাক্কালে চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে আমন্ত্রণ জানাতে মহালয়ার দিন পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নের বোদেশ্বরী মন্দিরে দুর্গার আবাহন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় বিশাল অনুষ্ঠান। এতে যোগ দিতে কয়েক উপজেলার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জড়ো হন আউলিয়ার ঘাটে। নতুন পোশাক আর রঙিন সাজ নিয়ে দেড় শতাধিক মানুষ ওঠেন নৌকায়। কিন্তু মাঝনদীতে গিয়ে ডুবে যায় নৌকাটি। নৌকা ডুবিতে এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৬৯ জনের মরদেহ। আর নিখোঁজ রয়েছেন আরও তিনজন। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শোকে স্তব্ধ করতোয়ার তীরবাসী। ইতিহাসের ভয়াবহ এমন দুর্ঘটনার সাক্ষী উত্তরের এই জনপদ। হিন্দুপল্লিগুলোতে চলছে শোকের মাতম। শোকে ম্লান জেলার ২৯৫টি পূজা মণ্ডপের শারদীয় দুর্গোৎসব।
সাকোয়া কলেজ পাড়ার স্বপন রায় বলেন, চোখ বুজলেই ভেসে আসছে বাবা ও দুই বোনের চেহারা। মহালয়ার দিন ভয়াবহ নৌকাডুবিতে সবাই ডুবে গেছে। তাদের সঙ্গে থাকা ভগ্নিপতি আর বেয়াইয়ের একই পরিণতি হয়েছে। এদের মধ্যে চারজনের মরদেহ উদ্ধার হলেও এখনো বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাকে খুঁজতে করতোয়া তীরে এ ঘাট থেকে ও ঘাট ছুটছি। পরিবারের বাকি সদস্যরাও বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করছেন।
সাকোয়া কলেজপাড়ার বাসিন্দা মিঠুন জানান, হিন্দুগ্রামগুলোতে এমন কোনো পরিবার পাওয়া যাবে না যাদের আপনজন এ দুর্ঘটনায় মারা যাননি। স্বজনদের মরদেহ দাহের পর মনে কী আর কোনো আনন্দ থাকে- এমন প্রশ্ন করেন তিনি।
দেবীর আরতির ধুপের বদলে গ্রামে গ্রামে জ্বলছে স্বজন ও প্রতিবেশীদের পোড়ানোর চিতা। কোনো কোনো পরিবারের ৩-৪ জনকে হারিয়েছেন। পাঁচ দিন থেকে নিহতদের বাড়িতে চুলো জ্বলছে না। শোকার্ত মানুষের হৃদয়ে যে বিষাদ, তা ঢেকে দিয়েছে পূজার আনন্দ। প্রিয়জন হারানোর ব্যথা আর যন্ত্রনায় ম্লান এবারের পূজা উৎসব।
স্থানীয় বাসিন্দা নারায়ণ বলেন, এই উৎসবে আমাদের আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু এত মানুষকে হারিয়ে এই উৎসবে কীভাবে আনন্দ করব।
নিজের চোখের সামনে লোকবোঝাই নৌকাটিকে ডুবতে দেখেছেন ঘটনাস্থলের পাশের চা বাগানের ম্যানেজার প্রহ্লাদ চন্দ্র বর্মন। তিনি জানালেন, চোখের সামনে এতগুলো মানুষকে ডুবে যেতে দেখে এখনো গা কাঁপছে তার। শেষ মুহূর্তে একে অন্যকে জড়িয়ে বাঁচার আকুতি আর গগণবিদারী চিৎকার এখনো কানে বাজছে। এতগুলো প্রাণ বিসর্জনের পর দেবী দুর্গার প্রতিমাকে তারা কীভাবে বিসর্জন দেবেন তা জানেন না।
নৌকাডুবিতে পাঁচ দিনের অভিযানে এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৬৯ জনের মরদেহ। নিখোঁজের তালিকায় থাকা তিনজনকে এখনো পাওয়া যায়নি। তাদের খুঁজে পেতে করতোয়া তীরে স্বজনরা ছুটছেন।
ডুবে যাওয়া নৌকার যাত্রী ছিলেন বোদা উপজেলার ময়দানদিঘী এলাকার হিমালয় ও তার স্ত্রী। তার স্ত্রী কোনোভাবে বেঁচে ফিরলেও গতকাল মরদেহ পাওয়া যায় হিমালেয়ের। তাকে খুঁজতে নদীপাড়ে বোন নীতি রানীর কান্না কাঁদিয়েছে সবাইকে। তিনি বলেন, 'আমি আজ ভাইকে না নিয়ে যাব না, আমার ভাই কই তাকে ছাড়া আমি আজ যাব না'। শেষমেষে বিকেলে ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরেন বোন নীতি রানী।
শোকে ঢাকা করতোয়ার পাড়ে ভিড় করছেন আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। ঠাকুরগাঁওয়ের আকচা একালা থেকে আসা আরিফ বলেন, এ দুর্ঘটনা আমাদের সবাইকে কাঁদিয়েছে। শোকার্ত মানুষের সঙ্গে দেখা করতে আসছি। তাদের কান্না দেখে চোখের পানি আটকানো যাচ্ছে না।
এর আগে কয়েকবার ঘটনাস্থলে আসেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, নৌকাডুবির ঘটনা পঞ্চগড়ের মানুষ কখনো দেখেনি। এখানে প্রশাসনের গাফিলতি ছিল। আমাদের লোকও দেখেনি, ঘাটের লোকও দেখেনি। এটা একটা অবহেলার কারণ হিসেবে আমি দেখছি। ঘাটে যারা দায়িত্বে ছিল তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেনি।
এ ছাড়া ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, ঠাকুরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন, দিনাজপুরের সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতারা ঘটনাস্থলে আসেন। এসময় তারা নিহতের পরিবারের সদস্যদের শান্ত্বনা জানানোর পাশাপাশি সবাইকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক প্রাণতোষ আচার্য শিবু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'মৃত্যুই একমাত্র নিয়তি কিন্তু এমন মৃত্যু আমাদের হৃদয়কে বেদনাসিক্ত করে। নৌ-দুর্ঘটনায় পঞ্চগড়বাসীর সঙ্গে আমরা সারা দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শোকার্ত। এমনকি সারা দেশের মানুষ এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে।’
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে এবং এবারের পূজায় নিহতদের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে বলেও জানান তিনি।
এসএন