দক্ষিণাঞ্চলের সব থেকে বড় ফুল ও ফল চারার বাজার
বরিশালের সন্ধ্যা নদীর তীর ঘেঁষে দক্ষিণাঞ্চলের সব থেকে বড় ফুল ও ফলের চারার বাজার গড়ে উঠেছে। এটি পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার অলংকারকাঠী গ্রামে অবস্থিত। এই শীতের মৌসুমে ফুলের চাদরে ঢাকা পড়েছে গ্রামটি। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই ফুল ও ছোট ছোট ফুল চারার সমারোহ।
উপজেলার আকলম, কুনিয়ারী, সুলতানপুর, পানাউল্লাপুর, সংগীতকাঠি ও আরামকাঠিসহ ১০ থেকে ১২ টি গ্রামে বানিজ্যিকভাবে নানা প্রজাতির ফুলের চাষ হয়। অন্য ফসলের চেয়ে অধিক লাভের আশায় প্রতিদিন বাড়ছে ফুলের কৃষি, বাড়ছে ফুলচাষী, গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে পড়ছে ফুলের আবাদ। তবে এই অলংকারকাঠীর নার্সারিগুলো টিকিয়ে রাখতে হলে আশেপাশের ইটের ভাটাগুলো সরিয়ে অন্যত্র নিতে হবে। না হলে পরিবেশ নষ্টের কারণে নার্সারির অনেক বড় ক্ষতি হবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা। বরিশাল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে বরিশাল-বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠি সড়কের পাশেই সন্ধ্যা নদীর তীর জুড়ে অলংকারকাঠি গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চোখ ধাঁধানো এই ফুলের নার্সারিগুলো।
এই অঞ্চল জুড়ে প্রায় ৩০০টির মত নার্সারি গড়ে উঠেছে। এসব নার্সারিগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ফুল এবং ফল গাছের চারা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের বনজ, ফলজ ও ঔষধি গাছের চারার কলম উৎপাদন করে আসছেন নার্সারি ব্যবসায়ীরা। প্রায় দুই হাজারের মতো নারী-পুরুষ জীবিকার পথ খুঁজে পেয়েছেন এখানে। পুরুষের প্রতিদিন পারিশ্রমিক ৫০০ টাকা এবং নারীদের ৩০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এছাড়া নার্সারিগুলোতে মাসব্যাপীও কাজ করেন অনেক কর্মচারী।
সরেজমিনে দেখা যায়, অলংকারকাঠী ব্রিজ থেকে উত্তর শর্ষিনা পর্যন্ত সড়কের দুইধারে সন্ধ্যা নদীর কোল ঘেঁষে কোহিনুর নার্সারি, বৈশাখী নার্সারি, আশা নার্সারি, নিরব নার্সারি, রুবেল নার্সারি, নেছারাবাদ নার্সারি, আদর্শ নার্সারি, ফারিয়া নার্সারিসহ বিভিন্ন নামের নার্সারি রয়েছে। জমে ওঠেছে ফুলের চারা বেচা-কেনা। এ অঞ্চলের তিনটি গ্রাম নিয়ে এ ফুলের বানিজ্য গড়ে উঠলেও অলংকারকাঠী নামেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। এখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফুল ও প্রকৃতিপ্রেমীদেরও উপচেপড়া ভীড় দেখা যায়। সামনে ভালোবাসা দিবস এবং বসন্ত উৎসবকে ঘিরে নার্সারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে উচ্ছ¦াস লক্ষ্য করা গেছে। তারা আগাম ফুল সংরক্ষণে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
নার্সারি ম্যানেজার মো. জসিম জানান, এ সকল নার্সারি থেকে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ টাকার ফুলের চারা ও নানা প্রজাতির গাছ-গাছালির চারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। এ অঞ্চলের শত শত মানুষ তার নিজের বা সরকারি ঠিকাদারী কাজে সরবরাহের জন্য চারা কলম কিনে নেন এখন থেকে। তবে শীত মৌসুমে শুধুই ফুলের চারা কলম এবং ফুল বেচা-কেনা চলে। মুরাদ নার্সারির মালিক মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চলের সব স্থানে আমাদের এখান থেকে ফুল, ফুলের চারা এবং ফলের চারা বিক্রি কারা হয়। তার মধ্যে যশোর, খুলনা, বরগুনা, পটুয়াখালী, কুয়াকাটা এবং বরিশাল নগরী সহ বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে বেশি কেনাকাটা করে।’
তিনি আরো বলেন, আমার নার্সারিতে শীতের সিজনের যত ফুলআছে সবগুলো পাওয়া যায়। এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে বিদেশি নানান রকমের ফুলআমার নার্সারিতে রয়েছে। তার মধ্যে- অপারাজিতা, অলকানন্দা, আশোক, এডেনিয়াম, কদম, করবী, কাঠগোলাপ, কৃষ্ণচূড়া, ক্যাক্ট্যস, গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, টিউলিপ, চামেলি, নয়নতারা, জারুল, চেরি, ডালিয়া, বেলী, অকিড, ক্যামিলিয়া সহ নানান ফুল ও ফুলের চারা পাওয়া যায়। ফলের চারার মধ্যে- জাম্বুরা, পেয়ারা, লেবু, লিচু, আঙ্গুর, জলপাই, কমলা, নাশপাতি, স্ট্রবেরি, পিচ, পেঁপে, বরই, কামরাঙা, ডালিম সহ দেশি বিদেশি বিবিন্ন ফল গাছের চারা পাওয়া যায়।
বৈশাখী নার্সারি কর্মচারী আহমদ শফী বলেন, এখানে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ফুলের ভরা মৌসুম চলে। এই মৌসুমী আমাদের এখানে বেচাকেনা অনেক ভালো হয়। স্থানীয় গরিব-দুঃখী মানুষের একটি কর্মসংস্থানের জায়গা হয়েছে, যাদের এখন ভাত না খেয়ে মরতে হয় না।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এখানে বিভিন্ন বীজ এর পাইকাররা আসেন, যারা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে ফুল এবং ফল গাছের বীজ সংগ্রহ করেন। তাদের কাছ থেকে আমরা এই বীজগুলো কিনে বপন করি। আশ্বিন মাসে বীজতলা করে বীজ বপন করতে হয়। ১৫ থেকে ২০ দিন পর চারা গজালে পলিথিন প্যাকেটে স্থাপন করে পানি ও ঔষধ দিতে হয়। ওইসব গাছে অগ্রহায়ণ মাসে ফুল আসতে শুরু করে।
নার্সারি মালিকরা জানান, বর্তমানে নার্সারি টিকিয়ে রাখা অনেক কষ্টের হয়ে যাচ্ছে। এখানে বড় বড় ইটের ভাটা তৈরি হয়েছে যার কারণে চারপাশের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া নার্সারির মধ্য থেকে বিশাল এক খাল বয়ে গেছে যেই খালের মধ্য থেকে নৌকায় আমাদের মালামাল পার করতে হয় যেটা আমাদের জন্য অনেক দুর্ভোগের কারণ। এখানে যে সকল কর্মচারীরা প্রতিদিন কাজ করে তাদের জন্য টিউবওয়েল প্রয়োজন, এখানে খাবার পানির সংকটে রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, স্থানটি অনেক বড় একটি পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে। যা দেশের জন্য গৌরবের। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার হাত বাড়িয়ে দিলে এটি একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে।
কৃষি সম্প্রসারন অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, এ শিল্পকে আরও বিকশিত করার জন্য কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সকল ধরনের সহযোগীতা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে নার্সারি মালিকরা যাতে স্বল্প সুদে ঋণ পায় সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কেএফ/