নিলাম ছাড়াই নদী খননের বালুতে হচ্ছে রাস্তার কাজ
নীলফামারীর ডিমলায় সরকারি রাস্তা নির্মাণের কাজে নদী খননের বালু ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, রাস্তার জন্য বালু কিনতে সরকারি বরাদ্দ থাকলেও চুরি করে নিলামের বালু নিয়ে বরাদ্দের টাকা লোপাট করা হচ্ছে। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, ডালিয়া পাউবোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে নিলামে বিক্রির জন্য রাখা বালু ব্যাবহার করে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে নামমাত্র কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
তাদের মতে, এটা চুরির নামান্তর। নিলামে বিক্রির জন্য রাখা বালুর চুরি হওয়ায় সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, তিস্তা সেচ প্রকল্পের কমাণ্ড ও পুনর্বাসন প্রকল্পের আওতায় ডালিয়া ব্যারেজ থেকে তিস্তা সেচ প্রকল্পের চার কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মাণের জন্য ৮ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ডালিয়া পওর বিভাগের তত্ত্বাবধানে কাজের দায়িত্ব পায় ঢাকার নোনা লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
তবে কাজ সম্পন্ন করছেন স্থানীয় সাব ঠিকাদার সাহিদুল ইসলাম। কাজটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনও অবধি এর ৮০ ভাগ কাজ বাকি রয়েছে। এরই মধ্যে এই রাস্তা নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে। সরজমিনে দেখা যায়, ওই রাস্তার নির্মাণ কাজে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীর ধারে নিলামের জন্য স্তুপ করা বালু ব্যবহার করা হচ্ছে। ডালিয়া সিলট্রাপ এলাকায় দুটি এস্কেভেটরের সাহায্যে ৮ থেকে ১০টি ট্রাক্টর দিয়ে বালু সরবরাহ করা হচ্ছে সরকারি রাস্তায়।
সম্প্রতি উপজেলার বাইশপুকুর, ছোটখাতা ও ডালিয়া মৌজায় তিস্তা নদী ও সেচ খাল খননের ১ কোটি ২০ লাখ ৮৬ হাজার ঘনফুট বালু বিক্রির জন্য প্রকাশ্য নিলাম আহ্বান করে জেলা প্রশাসন ও ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড। এসব বালু ৪টি স্তুপে বিক্রির জন্য নিলাম কমিটি গঠন করা হয়। প্রতি ঘনফুট বালুর ন্যূনতম মূল্য ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।
প্রথম দফা নিলামে ৪ জন ক্রেতা অংশ নিলেও তাঁরা ন্যূনতম মূল্যের চেয়েও কম মূল্য ডাকেন। তাই বালু বিক্রি হয়নি। পরে আবার নিলাম আহ্বান করে বালু বিক্রি কমিটি। দ্বিতীয় দফায় ডালিয়া মৌজার ১২লাখ ১৯ হাজার ঘনফুট বালু ন্যূনতম মূল্যে ১২ লাখ ১৯ হাজার টাকায় নিলামে বিক্রি হয়। অবশিষ্ট ১ কোটি ৮ লাখ বালু অবিক্রীত থেকে যায়। যা পরবর্তীতে নিলামে বিক্রির জন্য প্রক্রিয়াধীন।
নীতিমালা অনুযায়ী খননের উত্তোলিত বালু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ ভরাট, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং অতিদরিদ্র পরিবারের বাড়ি করার জন্য বিনামূল্যে দেওয়ার কথা। অবশিষ্ট বালু নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা হবে। কিন্তু নদী খননের এসব বালু লুট করে নির্মাণ কাজে ব্যবহার করছে ঠিকাদার ।
নিলামে অংশ নেওয়া আপেল ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড কাগজপত্রে যে পরিমাণ বালু দেখিয়েছেন, তার চার ভাগের এক ভাগ বালু বাস্তবে নেই। নিলামের আগেই বেশিরভাগ বালু লুট হয়েছে। তাই বালুর ব্যাপক চাহিদা সত্তেও ব্যবসায়ীরা নিলামে অংশ নিচ্ছে না।
এদিকে তৃতীয় দফায় নিলামের আগেই স্তূপ করে রাখা অবশিষ্ট বালুও রাতের আঁধারে চুরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা মমিনুর রহমান বলেন, এই রাস্তার কাজ শুরুর পর থেকেই ঠিকাদার ও পাউবো কর্তৃপক্ষ সরকারি বালু দিয়ে নির্মান কাজ করছেন।
ডালিয়া গ্রামের সেলিম ইসলাম, নিলামের বালু ১০ থেকে ১২টি ট্রাক্টরে রাতভর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে। আর দিনের বেলায় এই বালু দিয়ে পাউবোর ঠিকাদাররা নির্মাণ কাজ করছে। নির্মান শ্রমিক মোস্তাফিজুর বলেন, ঠিকাদারের নির্দেশে সরকারি বালু দিয়ে রাস্তার কাজ করছি। ঠিকাদার শুধু ইটের খোয়া দিয়েছে। বালু এখান থেকেই নেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, শুনেছি এসব বালু নিলামে বিক্রির কথা। কিন্তু এখনও হয়নি।
ডালিয়া, বাইশপুকুর, চাপানি এলাকার অন্তত ১০ জন বাসিন্দা বলেন,ডালিয়া পাউবো কর্তৃপক্ষ এসব দেখেও না দেখার ভান করে। পাউবোর বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজে এই বালু ব্যাবহার করে ঠিকাদাররা। বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা কমিশন নেয় পাউবোর কর্মকর্তারা। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হলে তারা মাঝেমধ্যে লোকদেখানো অভিযান করে। দুই একদিন পর আবার বালু লুট শুরু হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাব ঠিকাদার সাহিদুল ইসলাম বলেন, রাস্তা নির্মাণ কাজে বালুর জন্য আলাদা বরাদ্দ নেই। আশেপাশে বালু না পাওয়ায় আপাতত এই বালু দিয়ে কাজ করছি।
তবে ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসফাউদদৌলা বলেন, নিলাম ছাড়া ওই বালু নির্মাণ কাজে ব্যবহারের সুযোগ নেই। ইতিমধ্যে নদী খননের বালু দিয়ে রাস্তার নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বালু চুরি রোধে আমরা তৎপর রয়েছি। নিলামে বালু বিক্রি হচ্ছে না কেনো জানতে চাইলে বলেন, বালুর পরিমাণ পুনরায় পরিমাপ করে নিলামের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেলায়েত হোসেন বলেন, নদী খননের বালু নিলাম বাদে কেউ বিক্রি বা নির্মাণ কাজে ব্যাবহার করতে পারবেনা। যদি কোন ঠিকাদার ওই বালু দিয়ে কাজ করে তাহলে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।খুব শীঘ্রই পুনরায় বালুর নিলাম অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান তিনি।
এএজেড