‘অর্জিত জ্ঞানের সঠিক ব্যবহারই শিক্ষার সফলতা’
অর্জিত জ্ঞান, নেশা ও পেশার সমন্বিত রূপের আরেক নাম সফলতা। এ তিনের সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটিয়েছেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার আটিয়া ইউনিয়নের গোমজানি গ্রামের তরুণ কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ। সফলতাও ধরাশায়ী হয়েছে তার কাছে।
কৃষি নিয়ে পড়ালেখা করা শাকিল বলেন, ‘অর্জিত জ্ঞানের সঠিক ব্যবহারই শিক্ষার সফলতা। দেশ ও দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে কৃষিকে বাঁচাতে হবে, বাঁচাতে হবে দেশের কৃষককে।’
কৃষি, কৃষক ও বাংলাদেশ- শব্দ তিনটি পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে পড়েছে। সেটি বোঝা অনেকের পক্ষে সম্ভব না হলেও গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন শাকিল আহমেদ। তাই তো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার পাট চুকিয়ে তনু-মন নিয়োগ করেছেন কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে।
২০২০ সালে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি বিভাগে পড়ালেখা শেষ করেন শাকিল আহমেদ। চাকরিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শুরু থেকেই নিজেকে উজাড় করেছেন কৃষিতে। শুধু জীবিকার তাগিদ নয়, রয়েছে কৃষির উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের তাগিদও। আছে কৃষক ও কৃষি বাঁচানোর আর্তি।
শাকিল জানান, করোনাকালে শুরু করেন কৃষি জমিতে সবজি ও ফল চাষ। এক জমিতে ৮-১০ ধরনের ফসল চাষ করে কীভাবে পুরো জমি কাজে লাগানো যায়, তা বাস্তবায়ন করেন। প্রথমে স্কোয়াশ চাষ করেন। এরপর তার প্রকল্প ক্রমাগত বাড়িয়েছেন। সেই সঙ্গে বিষ প্রয়োগ ছাড়াই প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পোকা দমন, রাসায়নিক সারের বদলে কম্পোস্ট সার ব্যবহার করেন। এ ছাড়া রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত খাদ্যের পরিবর্তে পোকা পালন করে মাছ ও মুরগির প্রাকৃতিক খাদ্য সরবরাহ করেন।
সেই সঙ্গে মালচিং পদ্ধতিতে চাষাবাদে পানি ও সারের অপব্যবহার রোধ করা এবং অনলাইনে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করে পরামর্শ দিয়ে আধুনিকায়নে কৃষিকাজে বিশেষ ভূমিকা রেখে অল্প দিনেই প্রশংসিত হয়েছেন এ তরুণ উদ্যোক্তা।
শাকিল একই গ্রামের মো. আব্দুল করিমের ছেলে। দেশের কৃষি ও কৃষক রক্ষায় নিজেই কৃষক হয়ে মাঠে কাজ করছেন। কৃষি ও কৃষকদের আধুনিকীরণ করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তিনি। তাকে অনুসরণ ও তার পরামর্শ নিয়ে স্থানীয় কৃষকরা ক্রমশ আধুনিক হচ্ছেন। অধিক লাভবান হচ্ছেন কৃষি কাজে।
রাষ্ট্রের অন্তিম মুহূর্তে রাষ্ট্র বৈদেশিক খাদ্য রপ্তানি করতে ব্যর্থ হলে তখন দেশের মানুষের খাদ্যের যোগান দেবে কৃষক। সেই কৃষকদের আধুনিক করতে চাকরির পেছনে না ছুটে ছুটছেন কৃষি ও কৃষকদের পেছনে। বিসিএস করে কৃষি কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন নেই শাকিলের। স্বপ্ন কৃষকদের আধুনিক করা।
কৃষিবিদ শাকিল আহমেদ বলেন, ‘করোনাকালে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল, তখন পরিবার থেকে অল্প পুঁজি নিয়ে এক টুকরো জমিতে শুরু করি স্কোয়াশ চাষ। আধুনিক চাষাবাদে ফলন হয় পর্যাপ্ত। ফলে প্রথম বছরেই ৫০ হাজার টাকা লাভ হয়। ২০২১ সালের বন্যায় ডুবে যায় সবজির জমিগুলো। বসে না থেকে পুকুর কিনে মাছের ওপর বিনিয়োগ করি। ফলে অর্থ সংকটে পড়ি। এ সময় কিছু বিনিয়োগকারীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। কিছু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই সময় ফার্মনেট এশিয়া নামে একটি অনলাইনভিত্তিক কোম্পানি চালু করি। যার কাজ কৃষক, ভোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে সংযুক্ত রাখা। এখানেও সাড়া পাই যথেষ্ট।’
বর্তমানে ৪২ শতাংশ জমিতে স্কোয়াশ, ৪০ শতাংশে ক্যাপসিকাম, ৫০ শতাংশে শসা এবং ১২৫ শতাংশে মিশ্র ফল ও সবজির সমন্বিত চাষ করছেন শাকিল। সমন্বিত সবজি চাষে একই জমিতে রয়েছে পেঁপে, টমেটো, শসা, বেগুনি বাঁধাকপি, ব্রোকলি, রক মেলন,বাঁধাকপি, লাউ ও লাল শাক। একটি জমি পুরোপুরি ব্যবহার করতে সমন্বিত চাষ শুরু করেন। ২৫৭ শতাংশ জমিতে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ৬ লাখ টাকা।
এরপর ১০ লাখ টাকা বিক্রির টার্গেট নিয়ে কাজ করছেন তিনি। বর্তমানে তার উৎপাদিত সবজি ও ফল স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়েও রাজধানীতে যাচ্ছে। শতাধিক কৃষক শাকিলের পরামর্শ ও সহযোগিতা নিয়ে কৃষিকাজে ব্যাপক সফলতা পাচ্ছেন। স্থানীয় কৃষক বাহাদুর, সেলিম মিয়া, কালাম মিয়া ও সোহরাব মাস্টার জানিয়েছেন শাকিলের সহযোগিতার কথা।
এ বিষয়ে দেলদুয়ার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোয়েব মাহমুদ বলেন, শাকিল একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমি শাকিলের কৃষি প্রকল্পগুলো কয়েকবার পরিদর্শন করেছি। তার এসব উদ্যোগের পাশে সবসময় কৃষি অফিস থাকবে। এরই মধ্যে নানা ধরনের পরামর্শ শাকিলকে দেওয়া হচ্ছে। তার এমন উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়।
এফএস/এসএন