ফেনী মুক্ত দিবস আজ, দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন

আজ ৬ ডিসেম্বর, ফেনী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ফেনীর মাটিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর নৃশংস বর্বরতায় ক্ষত-বিক্ষত ফেনী শহরে বিজয়ের নিশান উড়িয়ে উল্লাস করে স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী ফেনীর সর্বত্রে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ ও নিপিড়ন চালায়। জেলার বিভিন্ন স্থানে ৮টি বধ্যভূমিতে শহীদদের লাশ সনাক্ত বা তাদের কবর চিহ্নিত করে স্বজনহারারা।
১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশের মতো ফেনীও ফুঁসে উঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চ ভাষণের পরপরই ফেনীতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য খাজা আহাম্মদের (এমএলএ) নেতৃত্বে ফেনীর সংগ্রাম কমিটির সদস্য, ছাত্র, যুবক, সামরিক ও আধা সামরিক সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে মিত্র বাহিনী গঠন করা হয় এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একিনপুর ও চোত্তাখোলায় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অত্র অঞ্চল (ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা) কে ২ নম্বর সেক্টরের আওতায় এনে কমান্ডার হিসেবে বীর উত্তম খালেদ মোশাররফ ও সাব সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বীর বিক্রম জাফর ইমাম দায়িত্ব পালন করেন। ফেনী অঞ্চলের মুক্তি বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত তৎকালীন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ভারতের বিলোনীয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল থেকে যুদ্ধ করতে করতে এগুতে থাকে। একটা পর্যায়ে ফেনীর পাক হানাদার বাহিনীর একটি অংশ নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের রাস্তার অপর অংশ শুভপুর ব্রিজের উপর দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়।
অপরদিকে যুদ্ধের তীব্রতা ও আক্রমণের দিক পরিবর্তন করে দাগনভূঞার কোরাইশমুন্সীতে অবস্থিত বিএলএফের অফিস পাঁছগাছিয়ায় স্থানান্তর করা হয়। বিএলএফ তথা মুজিব বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা দাগনভূঞা, রাজাপুর, সিন্দুরপুর হয়ে শহরের দিকে এগুতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাক হানাদার বাহিনী ৫ ডিসেম্বর রাতে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। সেই সময় ফেনীর মহাকুমার অবাঙালি প্রশাসক বেলাল এ খান পাক বাহিনীর সঙ্গে চলে যান। ফেনী হানাদারমুক্ত হওয়ার কারণে ঢাকা-চট্টগ্রামের সঙ্গে সড়ক ও রেলপথে হানাদার বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এতে করে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুক্তিযুদ্ধে ফেনীর অনেকগুলো রণাঙ্গনের মধ্যে মুন্সীর হাটের মুক্তারবাড়ী ও বন্ধুয়ার প্রতিরোধের যুদ্ধ ইতিহাস খ্যাত হয়ে আছে। এই রণাঙ্গনে সম্মুখ সমরের যুদ্ধ কৌশল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানী মিলিটারী একাডেমিগুলোতে পাঠ্যসূচির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যা এই রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অহংকার ও গর্বের বিষয়।
এ ছাড়াও সোনাগাজীর নবাবপুরে সম্মুখ যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানি সেনা সুবেদার মেজর জেনারেল গোল মোহাম্মদের নেতৃত্বে সোনাগাজীর বিভিন্ন এলাকায় লুটপাট, ত্রাস, ধর্ষণ ও হত্যার উৎসবে মেতে পড়ে। এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড সম্মুখ আক্রমণ ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন ও পাকিস্তানি ২০ জন সৈনিক নিহত হয়।
এরপর জুলাই-আগস্ট মাসের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল গেরিলা আক্রমণ শুরু করে। দাগনভূঞা, সিলোনীয়া, সিন্দুরপুর, মাতুভূঞা, দুধমুখা সেবারহাটের নুইয়ানীর পুল, বসুরহাট, সোনাগাজী, ধলিয়া বাজার, বক্তারমুন্সি, ছোট ফেনী নদীর পাড়, সাতবাড়িয়া, ভৈরব চৌধুরী, মনকাজী, বাঞ্ছারামপুর, মতিগঞ্জ, ফেনী সদর, বার্ণপাড়া, সিও অফিস, ছাগলনাইয়া, শুভপুর, চাঁদগাজী, জিনার হাট, ভূঞার হাট, কাশিপুর, পরশুরামের গুথুমা ক্যাম্পে, হাতিলুটা ফাজিলপুর, পশ্চিম লক্ষ্মীপুর, শিবপুর, কালিদহ, ছনুয়ায় ব্যাপক প্রতিরোধ ও গেরিলা হামলা জোরদার করা হয়।
৬ ডিসেম্বর ভোর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম বীর বিক্রমের নেতৃত্বে ফেনীর পূর্বাঞ্চল দিয়ে দলে দলে ফেনী শহরে প্রবেশ করতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। জড়ো হওয়া মুক্তি সংগ্রামীরা মিছিল থেকে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দেয়। শ্লোগান শুনে প্রথমে শহরবাসী বিশ্বাস করতে পারেনি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিলে দেখে উৎপুল্ল হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে সাধারণ মানুষ মিছিলে শরিক হতে শুরু করেন। স্বত:স্ফূর্ত প্রতিরোধের লক্ষণ দেখে পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাক হানাদার বাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনী ফেনীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পালিয়ে এসে ফেনী শহর হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এভাবেই দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তিকামীরা লাল-সবুজের এক টুকরো পতাকা ফেনীর মাঠে উড়ায়। এই রনাঙ্গনে ১০ নভেম্বর ২ জন পাকিস্তান সেনা অফিসারসহ ৭২ জন পাক সেনা আত্মসমথর্ন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য ফেনীর ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় খেতাবে ভূষিত করা হয়। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ৪ জন বীর উত্তম, ৭ জন বীর বিক্রম এবং ২০ জন বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা ফেনী সরকারি কলেজ, তৎকালীন সিও অফিসসহ কয়েকটি স্থানে স্বাধীনতাকামী নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল। সেই অমর শহীদের স্মৃতির ভাস্কর্য হিসেবে ফেনী কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ও জেল রোডের পাশে বীর শহীদের নামের তালিকাসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও বিলোনীয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
এদিকে ফেনী মুক্ত দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন উপলক্ষ্যে ফেনী জেলা প্রশাসন দিনব্যাপী বর্নাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ। মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ থেকে ফেনী জেলা শিল্পকলা একাডেমী পর্যন্ত বর্ণাঢ্য র্যালি। এরপরে সকাল ১১টায় ফেনী জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণে আলোচনা সভা ও সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় ফেনী কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী। সভাপতিত্ব করবেন ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান।
এ ছাড়াও দিবসটি উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ মিনার ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আলোকসজ্জা করা হয়েছে।
অন্যদিকে ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার এনায়েত নগর গ্রামের প্রতিষ্ঠিত তরুণ সংঘের উদ্যোগে ৪৫ কিলোমিটার পদযাত্রার আয়োজন করা হয়েছে। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তুলে ধরা ও ফেনী মুক্ত দিবসকে প্রতিষ্ঠিত করতে এই প্রয়াস। এই বছর পদযাত্রা শুরু হবে পরশুরাম থেকে নোয়াখালীর দাগনভূঞা পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার।
এ ব্যাপারে তরুণ সংঘের সভাপতি মোহাম্মদ ইয়াকুব রকি জানান, ১৯৭১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ ও প্রশিক্ষণের জন্য মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে চলাকে হৃদয়ের অনুভূতিতে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন তরুণ সংঘ। বিগত বছরের মতো এবারও ফেনী মুক্ত দিবসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তারুণ্যের পদযাত্রার আয়োজন করেছে।
ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান বলেন, ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এদিন বীর মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীকে পাক হানাদার মুক্ত করেছিল। দিনটিকে আমরা নানা উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করে থাকি। এ বছরও দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে পুষ্পস্তবক অর্পণ, র্যালি, আলোচনা সভা ও পদযাত্রা। সেদিন ফেনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারা যে অসামান্য বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন সেটিকে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব।
এসআইএইচ
