উচ্চ ফলনশীল ব্রি ধান-১০৩ অবমুক্তের অপেক্ষায়
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) উচ্চ ফলনশীল ধানের নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে যা অবমুক্তের অপেক্ষায় রয়েছে। নতুন উদ্ভাবিত এ ধানের জাত রোগ বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রচলিত জাতের চেয়ে কম। এজাতটি বিদ্যমান জাতের তুলনায় বিঘা প্রতি ১ থেকে ২ মন ফলন বেশি, খড়ের ফলনও বেশি। জাতীয় বীজ বোর্ডের সভায় এ ধানের জাত ব্রি-১০৩ অনুমোদনের জন্য অপেক্ষমান।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) সোনাগাজী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিশ্বজিৎ কর্মকার জানান, ব্রি ধান-১০৩ এ আধুনিক উফশী ধানের সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। অঙ্গজ অবস্থায় গাছের আকার ও আকৃতি ব্রি ধান-৮৭ থেকে ভিন্ন। পূর্ণ বয়স্ক গাছের গড় উচ্চতা ১২৫ সেঃ মিঃ। দানা লম্বা ও চিকন। পাতা হালকা সবুজ। ডিগ পাতা খাড়া।
পাকার সময় কাণ্ড ও পাতা সবুজ থাকে। এ জাতের ধানের দানার রং খড়ের মত। ১০০০ টি পুষ্ট ধানের ওজন প্রায় ২৩.৭ গ্রাম। এ ধানের প্রোটিন এবং অ্যামাইলোজের পরিমাণ যথাক্রমে ৮.৩% এবং ২৪%। এ জাতটির গড় ফলন ৬.২ টন/হে.। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে ৭.৯৮ টন/হে. পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।
এ জাতের গড় জীবন কাল ১৩০ দিন (১২৮-১৩৩ দিন)। শস্য কর্তনে ব্রি ধান১০৩ জাতটি উদ্ভাবনের পর হতে বিভিন্ন পরীক্ষায় সারাদেশের গড় ফলন পাওয়া গেছে ৬.২০ টন/হে.।
প্রচলিত জাতের তুলনায় এর বৈশিষ্ট্য হলো, ব্রি ধান১০৩ এর কান্ড শক্ত, পাতা হালকা সবুজ এবং ডিগ পাতা খাড়া, লম্বা ও চওড়া। ধানের ছড়া লম্বা ও ধান পাকার সময় ছড়া ডিগ পাতার উপরে থাকে তাই ক্ষেত দেখতে খুব আকর্ষনীয় হয়। ধান লম্বা ও চাল সোজা।
ড. বিশ্বজিৎ কর্মকার আরো জানান, এ জাতটি রোপা আমন মৌসুমে বৃষ্টি নির্ভর চাষাবাদ উপযোগী। এ ধানের চাষাবাদ অন্যান্য উফশী রোপা আমন ধানের মতই। বীজ বপনের উপযুক্ত সময় হলো ১৫ জুন থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত অর্থাৎ ১ আষাঢ় থেকে ২১ আষাঢ়। এ ধান ২৫-৩০ দিনের চারা গোছা প্রতি ২-৩ টি করে ২৫ সে. মি. ১৫ সে. মি. স্পেসিং দিয়ে রোপন করতে হবে। সারের মাত্রা অন্যান্য উফশী জাতের মতই (ইউরিয়া, টিএসপি, এমপি জিপসাম, জিংক সালফেট @ ১৮০, ৮৫, ১০০, ৭০, ১২.৫ কেজি/হে.)।
সর্বশেষ জমি চাষের সময় সবটুকু টিএসপি, জিপসাম, জিংক সালফেট, দুই তৃতীয়াংশ এমওপি প্রয়োগ করতে হবে ইউরিয়া সার সমান তিন কিস্তিতে যথা রোপনের ১০ দিন পর ১ম কিস্তি, ২৫ দিন পর ২য় কিস্তি এবং ৪০ দিন পর ৩য় কিস্তি প্রয়োগ করতে হবে। বাকী এক তৃতীয়াংশ এওমপি দ্বিতীয় কিস্তি ইউরিয়ার সাথে প্রয়োগ করতে হবে।
ব্রি ধান ১০৩ এ রোগ বালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ প্রচলিত জাতের চেয়ে কম হয়। তবে রোগবালাই ও পোকা মাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে সমন্বিত বালাই দমন ব্যবস্থাপনা ব্যবহার করা হবে।
নতুন জাত উদ্ভাবন সম্পর্কে তিনি বলেন, ব্রি ধান-১০৩ এর কৌলিক সারি BR (Bio) 8961-AC26-16। প্রথমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত জাত BRRI dhan29 এর সাথে FL378 এর সংকরায়ণ করা হয়, পরবর্তীতে anther culture করে এই সারিটি উদ্ভাবন করা হয়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা মাঠে হোমোজাইগাস কৌলিক সারি নির্বাচনের পর ৩ বৎসর ফলন পরীক্ষার করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত কৌলিক সারিটি আমন ২০১৮ মৌসুমে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের মাঠে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়। উক্ত কৌলিক সারিটির ফলন ব্রি ধান৪৯ এর চেয়ে বেশী হওয়ায় প্রস্তাবিত জাত হিসেবে নির্বাচিত হয়।
পরবর্তীতে জাতীয় বীজ বোর্ডের মাঠ মুল্যায়ন দল কর্তৃক T. Aman ২০২১ মৌসুমে ব্রি ধান৮৭ (চেক জাত) এর সাথে কৃষকের মাঠে প্রস্তাবিত জাতের ফলন পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়। কৃষকের মাঠে ফলন পরীক্ষায় সন্তোষজনক হওয়ায় T. Aman মৌসুমের জন্য একটি আগাম জাত হিসাবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করা হয়।
ড. বিশ্বজিৎ কর্মকার উল্লেখ করেন, আমন মওসুমে আবাদযোগ্য ব্রি ধান১০৩ সদ্য উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল জাত যা ইতোমধ্যে জাতীয় কারিগরি কমিটি (National Technical Committee (NTC) তে পাস হয়েছে এবং National Seed Board (NSB) তে পাস হওয়ার অপেক্ষায় আছে। National Seed Board (NSB) তে পাস হওয়ার পর এই বীজ সারাদেশে সম্প্রসারণ করা হবে। তাই এই জাতটি সারাদেশে চাষ করা হলে দেশের মোট ধান উৎপাদনে অনেক বড় অবদান রাখবে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে খাদ্য সংকট মোকাবিলায় এ জাতটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
এ ধানের পরীক্ষামূলক চাষী ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার দক্ষিণ চর চান্দিয়া গ্রামের আদর্শ কৃষক আবু সাঈদ রুবেল বলেন, এ ধান চাষ করেছেন তিনি। প্রথমবার চাষেই সফলতা পেয়েছেন। আমন মৌসুমে ১ হেক্টরে অন্য জাতের ধান ৫ মেট্রিক টন উৎপাদন হলে, এ নতুন জাতটি ছয় মেট্রিক টনেরও বেশি উৎপাদিত হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ মো. মোফাজ্জল করিম বলেন, ২৪ অক্টোবর ঘুর্নিঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে অন্যান্য জাতগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হলেও ব্রি ধান-১০৩ এর তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। নুয়ে পড়েনি।
এএজেড