পান না বয়স্কভাতা, ৭০ বছরেও দিনেশের ভরসা ছাতু বিক্রি
পরিবারের ছয় সদস্যের ভার এখনো ৭০ বছর বয়সী দিনেশের উপর। ভারে করে হাতে বানানো বুটের ডালের ছাতু, তিলের খাজা ও গুড়ের মুড়কি বিক্রি করেই সংসার চালান তিনি। তার ছাতুর চাহিদা খুব বেশি থাকলেও তিন কেজির বেশি বিক্রি করতে পারেন না। বয়স ভর করেছে শরীরে। একদিকে বেশি ছাতু বানাতে পারেন না, আরেকদিকে বেশি ভার বইবার সক্ষমতাও আর নেই। কষ্ট হলেও বাদ দিতে পারেন না এভাবে ঘুরে ঘুরে ছাতু বিক্রি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং বয়স ৭০ বছর হলেও পাননি প্রতিবন্ধী বা ভয়স্কভাতার কোনো কার্ড।
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার ভুজারীপাড়া গ্রামে দিনেশ কর্মকারের বাড়ি। সংসার চালাতে ৭০ বছর বয়সী দিনেশ কর্মকার এখনো ভার কাঁধে করে ছাতু বিক্রি করে যাচ্ছেন প্রায় ৬০ বছর ধরে। বাবার মৃত্যুর পর ১২ বছর বয়স থেকেই সংসারের হাল ধরেন তিনি। তার বাবাও ছাতু বিক্রি করতেন। মাথার উপরের ছাতাটা যখন চলে গেল কিশোর বয়সে নতুন কিছু চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। বাবার ভারে করে বুটের তৈরি সুস্বাদু ছাতু নিয়ে গ্রামে বেরিয়ে পড়া শুরু।
ডোমার উপজেলার ভুজারীপাড়া গ্রামের রমেশ কর্মকারের ছেলে দিনেশ কর্মকার। ছোট বেলায় কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে তার নাক বন্ধ হয়ে যায়। নাক বন্ধ হলেও দমে না গিয়ে চালিয়ে গেছেন ব্যবসা। প্রতিদিন ছাতু, গুড়ের মুড়কি ও তিলের খাজা তৈরি করে বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তিনি বিক্রি করেন এসব পণ্য। ভেজালমুক্ত এসব খাবারের জন্য তার সুনাম এলাকা জুড়ে। সারাদিন এসব খাবার বিক্রি করে তার তিন থেকে ৫০০ টাকা আয় হয়। আর এই আয় দিয়েই চলে তার ছয়জনের সংসার। তার সংসারের রয়েছে স্ত্রী, ৩ ছেলে ও ২ মেয়ে। সন্তানদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াতে পেরেছেন।
দিনেশ কর্মকার বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি ছাতু বিক্রি করতাম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাতু ছাড়াও গুড়ের মুড়কি ও তিলের খাজা বিক্রি করা শুরু করি। অরজিনাল বুটের তৈরি ছাতুর চাহিদা অনেক থাকলেও আমার পক্ষে ৫ কেজির বেশি ছাতু করা সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী মিলে বুট ভিজিয়ে যাতায় ছাল বের করে ছাতু তৈরি করে থাকি। হাতের তৈরি এসব ছাতু, মুড়কি ও তিলের খাজা তৈরি করতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু বাপ-দাদার এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে মন চায় না বলেই এখনো ছাতু বিক্রি করি।
সারাদিন হেঁটে হেঁটে ছাতু বিক্রি করতে অনেক কষ্ট হয় জানিয়ে তিনি বলেন, কষ্ট হলেও সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব কিছু ভুলে যাই। অবাঙালির প্রিয় খাবার ছাতু এখন বাঙালিরও প্রিয় খাবারে পরিণত হয়ে গেছে। তাই দিনে দিনে ছাতুর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আমার বিক্রিও বেড়ে গেছে। তবে আমি হাতে তৈরি করে থাকি বলে আমার পক্ষে দিনে ৫ কেজির বেশি ছাতু তৈরি করা সম্ভব হয়ে উঠে না। এ ছাড়া এই বয়সে বেশি ভার বহন করাও সম্ভব হয় না।
তিনি বলেন, ডোমারের বাইরেও তার ছাতুর ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। নীলফামারীর বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষজন ফোন করে ছাতুর অর্ডার করে। ডোমার উপজেলার এমন কেউ নেই যে তার হাতের তৈরি ছাতু খাননি।
কাউন্সিলর রুবেল ইসলাম বলেন, তার হাতের বুটের তৈরি ছাতু আমি কিনে রেখে বাড়ির সবাই মিলে প্রতিদিন খাই। ছাতু শেষ হলে তাকে ফোন করে ছাতুর অর্ডার করে থাকি। আমার মেয়ের খুব প্রিয় এই বুটের ছাতু।
ভুলুয়া নামে এক ব্যবসায়ী জানান, তার হাতের তৈরি ছাতু খেয়ে আমরা রমজান মাসে ইফতার করে থাকি। আমার বাবা ও মা ছাতু ছাড়া ইফতারি করেন না তাই বেশি করে ছাতু কিনে রাখি আমরা।
দিনেশ কর্মকার বলেন, আমি প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক হলেও এখন পর্যন্ত আমি সরকারি কোনো সুবিধা পাইনি। প্রতিবন্ধী বা বয়স্কভাতা আমার কপালে জুটেনি। প্রতিদিন ৫ কেজি করে বুট নিয়ে যাই। সেই বুট থেকে ৩ কেজি ছাতু হয়। এই তিন কেজি ছাতু আর ৫ কেজি মুড়কি নিয়ে প্রতিদিন বিক্রি করতে বের হই। কোনো কোনো দিন তিলের খাজাও সঙ্গে থাকে।
সন্ধ্যার আগে সব মাল শেষ হয়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, সবাই জানে আমার এসব পণ্যতে কোনো ভেজাল থাকে না। তাই আমি যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে এসব পণ্য বিক্রি হয়ে যায়।
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকতা ডা. রায়হান বারী জানান, ছাতু দেহের সার্বিক উন্নতিতে বড় ভূমিকা রাখে। এতে থাকা বিভিন্ন প্রকারের খনিজ, ভিটামিন ও ফাইবার নানা ভাবে আমাদের উপকার করে থাকে। হজমে সাহায্য করার পাশাপাশি প্রতিদিন ছাতু খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর হয়। এটি নিয়মিত খেলে ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে রাখে। রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি শরীর ঠান্ডা রাখে। এসব ছাড়াও বাচ্চাদের জন্য ছাতু নানাভাবে উপকার করে থাকে বলেও তিনি জানিয়েছেন।
ডোমার সদর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মাসুম আহম্মেদ জানান, আমি নতুন নির্বাচিত হয়েছি। তিনি কেন কার্ড পাননি আমার বোধ্যগম্য হচ্ছে না। কার্ড পেয়ে না থাকলে এবার তাকে প্রতিবন্ধী অথবা বয়স্ক ভাতার একটি কার্ড করে দেওয়া হবে।
এসএন