চম্পা বকুল তলে
আমার স্কুল সহপাঠী নারায়ণ পূজা পার্বনে প্রায়ই ওদের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যেত। নারায়ণের মা নারিকেলের নাড়ু আর গুড়ের বাতাসা খেতে দিত। সেবার ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর লক্ষীপূজায় গিয়েছিলাম ওদের বাড়িতে। নাড়ু আর বাতাসার সাথে মাসীমা ক্ষীরও খেতে দিয়েছিল। ক্ষীর খেয়ে বলেছিলাম, ' দারুণ মজা হইয়াছে।' মাসীমা এই কথা শুনে বলেছিল, 'তুমি আবার আসিও। তোমাকে আরও ভাল করে ক্ষীর রান্না করে খাওয়াব। ' কিন্তু আমার আর যাওয়া হয় নাই। সেইটাই ছিল শেষ যাওয়া। পরে শুনেছি, সেই মাসীমা ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
এই নারায়ণের সাথে আমার দেখা হয় তিরিশ বছর পরে কূঁড়াগাছা মেলায়। ও আমাকে জোর জবরদস্তি করে নিয়ে যায় ওদের বাড়ি। স্কুল থেকে আগে যে পথ দিয়ে ওদের বাড়ি যেতাম, সে পথ ছিল ধূলির। সেই পথই দেখলাম ইট সুরকি বিছানো। একটি রিক্সায় করে চলে যাই ওদের ব্রহ্মগাছা গ্রামে। পথে দিয়ে চলছিলাম, আর দেখছিলাম পথের দুইপাশের চিত্রগুলি। সবকিছুই কেমন যেন অচেনা লাগছিল। সেইসময়ে পথের ধারে পাকুড় গাছতলায় দেখেছিলাম, খালি মাঠের উপরে একটি নাট্যশালা। আজ দেখলাম --- সেই নাট্যশালাটি সেখানে নেই। ভেঙে সেখানে স্কুল করা হয়েছে।
নারায়ণদের বাড়িতে পৌঁছে মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে নতুন কোনো ঘর দুয়ার ওঠে নাই। যা দেখেছিলাম তাই আছে। সবকিছুই কেমন জীর্ণ পুরাতন হয়ে গেছে। মুখর করা বাড়িটি কোলাহলহীন মনে হচ্ছে। সাদা ধূতি শাড়ি পড়ে কোনো পৌঢ়া মহিলা আজ আর বের হলো না। কাছে এসে মায়ের মতো আদর করে বলল না --- ' বাবা, তুমি কেমন আছ?'
একটু পরে নারায়ণ ওর স্ত্রীকে আমার সামনে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেয়। সাথে ওর দুটো বাচ্চাকেও। আমি ওর স্ত্রীর মুখের দিকে ভাল করে একবার দৃষ্টি মেলে তাকালাম, যাকে ভেবে এই চেয়ে থাকা, সেই মেয়ে এই মেয়ে নয়। তারপরেও তাকেই দেখলাম, বললাম, বৌদি, 'আমি নারায়ণের স্কুল সহপাঠী বন্ধু। তিরিশ বছর পর আমাদের দেখা। '
বাড়িতে তেমন কাউকে না দেখতে পেয়ে নারায়নকে বলি, অপর্ণা দিদির কোথায় বিয়ে হয়েছে? নারায়ণ বলে, দিদি এখন জলপাইগুড়িতে থাকে। ওখানেই তাঁর ঘর সংসার। '
---- সুধীন দাদা কোথায়?
---- সেও ওপারে চলে গেছে। শিলিগুড়িতেই বিয়ে করেছে।
---- তোর ছোট ভাই নৃপেন কোথায় থাকে?
---- ও কোলকাতায় চিৎপুরে থাকে। আমি এই পুরো বাড়িতে এখন একাই থাকি।
নারায়ণ আরও বলছিল, জানিস, কেমন যেন শ্মশানের মতো শূন্যতার মনে হয় -- এই বাড়ি। এই লোকালয়। কতো আপন মানুষ যে স্বর্গীয় হয়ে গেল। কতো আত্মজন যে চলে গেল এই দেশ পারাপার ছাড়িয়ে ওপারে, অন্য পরভূমে। অন্তর হাহাকার করে ওঠে। তোকে যখন মেলায় দেখলাম, মনটা কি যে আনন্দে ভরে উঠল। কতো কথা মনে হচ্ছে তোকে দেখে। কতো স্মৃতি। '
আমি নারায়ণের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, কেমন যেন বিষাদে ছেয়ে উঠেছে ওর মুখখানি। আমি ওকে বলি --- তোদের বাড়ির পিছনে তো ইছামতী নদী আছে, চল্, একটু বেড়িয়ে আসি তীর থেকে। তখন সন্ধ্যা নেমে আসছিল। আমি আর নারায়ণ হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই ইছামতীর তীরে । হায়! নদী আর নদী নেই। হয়ে গেছে মরা খাল। সামান্য কিছু জল স্থির হয়ে আছে তলাতে। সেই কাজল জল, সেই স্রোতধারা, সেই উথাল ঢেউ কিছুই আজ আর নেই।
ভেবেছিলাম মনটা আমাদের ভাল হবে নদী দেখে। তা আর হলো না। চৈত্রের এই সন্ধ্যা রাতে আকাশে উঠেছিল একাদশীর চাঁদ। বুনো জোনাকিরা জ্বলে উঠেছিল নদীর কাশবনে। ঝিঁ-ঝির ডাক শুনতে শুনতে আকুল হয়ে নারায়ণকে বলছিলাম --- 'তোর সেই দীপা বর্মণের খবর কী, যাকে তুই ভালবেসেছিলি। বৌঠানের মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম -- এই তো দীপা নয়।'
আমরা নদীর কূল থেকে সন্ধ্যার আঁধারে হেঁটে হেঁটে ফিরে আসছিলাম। যে পথ দিয়ে গিয়েছিলাম নদীর কূলে, সেই পথ দিয়ে নারায়ণ আমাকে আনলো না। অন্য একটি পথ দিয়ে সে আমাকে নিয়ে আসছিল। পথের দুপাশটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল। জ্যোৎস্নার আলো আঁধারিতে চিনতে পারছিলাম পরিচিত গাছগুলো। আজ থেকে তিরিশ বছর আগের সেই বকুলের গন্ধ, পথের পাশের ঝাড় থেকে আসছিল চম্পা ফুলের সেই সুবাস। আমার মনে পড়ছিল এই রকম সুবাস পেয়েছিলাম তিরিশ বছর আগে দীপা বর্মণদের বাড়ি যেতে।
নারায়ণ যে বাড়িটির সামনে আমাকে নিয়ে আসে, সে বাড়িও আমার চেনা। ইটের এই বাড়িটি তখনও পুরনো ছিল। আজ দেখলাম, এর পলেস্তারা সব খসে গেছে। ভাঙ্গা ইটের ফাঁকে পরগাছা জন্মে গেছে। নারায়ণ আমাকে বলে --' চিনতে পারছিস বাড়িটি?' আমি বললাম, চিনতে পারছি । এই বাড়ি দীপাদের। সেইবার লক্ষীপূজায় এখানে কীর্তণ গানের আসর বসেছিল। সেদিন আকাশে ছিল কোজাগরী চাঁদ। সারা পৃথিবী খাঁ-খাঁ জ্যোৎস্নায় ভরে উঠেছিল। পূজার প্রসাদ সেদিন দীপা তোকে না দিয়ে আমাকে দিয়েছিল। আজ তোকে বলছি --- সেদিন সেই অসম্ভব সুন্দর জ্যোৎস্নায় দীপা গোপনে ধরেছিল আমার একটি হাত। দীপা বলেছিল -- ' দাদা, তুমি আমাকে একটু চম্পা বকুলের ছায়াতলে নিয়ে যাবে? এই কোজাগরী চাঁদ, এই রাত, রাতের এই রোশনাই তোমার জন্য মায়াময় মনে হচ্ছে।' আমি জানি, দীপা ছিল তোর। তাই দীপার সেই হাত আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম সেদিন।'
নারায়ণ আমাকে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়। দেখি, চল্লিশোর্ধ্ব একজন রমণী বারান্দায় শীতল পাটি বিছিয়ে বসে আছে। তার পাশে লন্ঠন জ্বলছে। নারায়ণ লন্ঠনটি তুলে ধরে সেই রমণীর মুখের দিকে। এবং বলে, দেখত চিনতে পারিস কিনা এই মুখ। ' আমি চিনেছিলাম, সেই মুখ। এ যে দীপা বর্মণ। সে কোনো কথা বলল না, নির্বাক তাকিয়ে থাকল আমার মুখের দিকে। ফুরিয়ে যাওয়া কেরোসিনের লণ্ঠনটি নিভু নিভু করে জ্বলছিল তখন। একটা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস আমার বুকের গভীরে থেকে ঝরে পড়ল। দীপা ওর অপলক দৃষ্টি নীচে নামিয়ে নিল। হয়ত চোখের কোণে অশ্রুকণা চিকচিক করছিল। সেই আধো আঁধার রাত্রিতে তা আমি দেখতে পাইনি।
গন্ধে আকুল করা চম্পা বকুল তলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সেই রাতে বাড়ি ফেরার সময় নারায়ণ বলছিল --- ' তিরিশ বছর ধরে জানতে পারিনি -- দীপা কেন এমন বদ্ধ পাগল হয়েছে। আজ তোর কাছ থেকে জানতে পারলাম, দীপা কেন এমন পাগল হয়ে গেছে।'
ডিএসএস/