অপ্সরা
লিলির বাম গালে একটা তিল ছিল। হাসলে ওকে বেশ সুন্দর লাগতো। যখন ও হাসতো, তখন ওকে জয়সলমীরের অস্তমিত সূর্যের মতো মনে হতো! তিলের জন্য লিলিকে আমি আদর করে নায়িকা বলে ডাকতাম। লিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিল। খুব ঠান্ডা মেজাজ আর সহনশীলতা ছিল ওর মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম থেকেই লিলিকে আমার ভাললেগে যায়। আমি ওর পিছু নেই এবং সফল হই।
লিলির বাবা ছিলেন একজন অধ্যাপক। জ্ঞান আর নীতির ভান্ডার! আমার কাছে ওনার কথা কখনও পছন্দ হতো না। আর, লিলির মা ছিল প্রচন্ড ধার্মিক। লিলির পরিবারের সাথে আমার ম্যাচিং না হলেও আমি লিলিকে পছন্দ করতাম। আমি আমার ছা'পোষা পরিবারকেও যে পছন্দ করতাম তাও নয়। আমি সব সময় সাধারণ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছি। নিজের মতো করেই নিজে বড় হতে চেয়েছি। লিলির বাবা শুধু মাত্র একটা কারণে লিলিকে আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজি হয়েছিল। তা' হল মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট! দুই পরিবারেরই অভিন্ন সংস্কৃতি।
যখন প্রথম বার আমার শ্রীঘরে যাওয়া হয়, লিলি তখন বাবার বাড়ি চলে গেল। তার বাবা নাকি আমার জন্য সমাজে মুখ দেখাতে পারছিলেন না! আরে বাবা মানুষ বড় হতে গেলে একটু-আধটু ওসব না করলে চলে? লিলি তা' বোঝেনি আর লিলির বাবা-মা তারাও কি বুঝেছেন? আমার পরিবারের মানুষরাও কম কিসে? আমার এগিয়ে যাবার অন্তরায় আমার বড় ভাই তার সাথে সম্পর্ক চ্যুত করেছি। মাকে প্রায়ই ভুলে গিয়েছিলাম। আমার সাথে মা' দেখা করতে নারাজ; আমারও দেখা করার সুযোগ নেই। কিন্তু, লিলিকে ভুলিনি! কি দোষ ছিল আমার? আমার ভালোবাসায় তো' কোন ভুল ছিল না।
আমার পঞ্চম বার গারদে থাকার সময় ছিল দীর্ঘ। লিলি আর তার পরিবার মেনে নিতে পারেনি। চালান শেষ করার সময় সাদা পোশাক পড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরা গ্রেপ্তার করে। আমি চিন্তাও করিনি কেউ আমাকে ধরতে পারবে। এবারের পরিকল্পনা নিচ্ছিদ্র ছিল। সফল হলেই মালয়েশিয়াতে একটা ফ্ল্যাট পেতাম। মানুষ তো এভাবেই বড় হয় নাকি? আমার উন্নতি মানুষের সহ্য হল আর কই!
মামলাটি আন্ডার ট্রায়াল ছিল এক বছরের বেশি সময়। শাস্তি হলে ১৪ বছর জেল! লিলি ও তার পরিবার মেনে নিতে পারেনি। আমি জানতাম ট্রায়ালে যাই হোক না কেন, জেল থেকে বেরুতে খুব বেশি সময় আমার লাগবে না। সবই সময়ের ব্যাপার! আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ন্যুনতম সময় দেওয়া উচিৎ ছিল। লিলি অপেক্ষা করেনি। আমার অনিবার্য ভবিষ্যৎ আন্দাজ করে, অন্যর বুকে সুখ খুঁজেছে। আমিও পারতাম আরও উপপত্নী রাখতে। আমি কি রেখেছি? আমি শুধু লিলিকে চিনেছি। আমি অস্ত্রের চালানের কাজ ধরেছিলাম লিলিকে নিয়ে মালয়েশিয়া সেটেল্ড হব বলে। আমার প্রেম লিলি বোঝেনি!
আমি তৃতীয় বার জেল থেকে বেরোলে আমার বড় ভাই আমাকে শাসন করেছিলেন! আমাকে জীবন ধারা পরিবর্তন করে স্বাভাবিক হতে বলেন! আমি কি অস্বাভাবিক মানুষ? এই পথে আরও অনেকেই হাঁটছে। তারা সফল হচ্ছে বলেই না আমরা তাদের উত্তরসূরী। আর, একবার মানিয়ে নিতে পারলেই যা আয়েশি জীবন! এরপর বড় ভায়ের সামনে আর কখনো যাইনি। আমার মা বলেছিলেন, সুন্দর করে সংসার করার জন্য। একটা ভালো পরিবারে বিয়ে হয়েছে, তাদেরও সম্মান রয়েছে। ওরা সবাই আমাকে বুঝতে ভুল করে! আমি তো প্রতিনিয়ত আমার উন্নতির জন্যই কাজ করে যাচ্ছি।
আমি দ্বিতীয় বার গ্রেফতার হবার কয়েক দিনের মাথায় জামিন পাই। এরপর লিলি আমাকে সাথে নিয়ে তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। কারও কোন কথা শোনার আগেই শ্বশুড়বাড়িতে পুলিশ! অভিযান নেতৃত্বদানকারি ডিবির অফিসার আমার শ্বশুরের ছাত্র ছিলেন। অফিসারের খুব কষ্ট হচ্ছিল আমাকে পাকড়াও করার সময়। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল স্মাগলিং। এতে কোন প্রমাণ ছিল না। শুধুই সন্দেহ করেই হেনেস্তা করা।
আমি তখন জেলে। মামলার শুনানির দিনের অপেক্ষায়। একদিন শুনলাম রুবেলের সাথে লিলির বিয়ের কথা! ডিভোর্স এর কাগজ এসেছিল। তবে লিলি অপেক্ষা করতে পারতো। শেষ বার আমাকে বলে বিদায় নিয়ে পারতো। কিছুই করেনি; আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি করার জন্য, কি করে যাচ্ছি!
লিলির তিলকে চুমু খেয়েছিল রুবেল! সেই তিলে! সাহস কত হারামজাদার? এই তিলকের দাম কোটি টাকার বেশি!
ঐ তিলকে শুধু আমার অধিকার! আর কারো না। তুই তিলক অপবিত্র করে দিয়েছিল। এই তিলক আর থাকবে না। আমি জেলে আর লিলি অন্যজনকে বিয়ে করেছে! ওর তিল থাকে কি করে? আপনারাই বলুন? আমি কি অন্যায় বলছি? আমি লিলিকে শেষ দেখা দেখছিলাম। আমার শিষ্য শূট্যার মিজান অস্ত্র তাক করে ফেলেছে। লিলি সব ব্যাখ্যা করতে চাইছে, ভুল ছিল কোথায়? বার বার ওর বর্তমান স্বামী রুবেলের জীবন ভিক্ষা চাইছে। লিলি তোমাকে ক্ষমা চাওয়া মানায় না! তুমি আমার স্ত্রী; তুমি টর্নেডো কামালের বউ! একটু হাস লিলি। আমি তোমার তিলকটা আবার দেখি। লিলির তিলক রক্তে লাল হয়ে গেল! সে লুটিয়ে পড়লো রাস্তায়। কখন যে মিজান মেশিন চালিয়েছে মনে নেই। লিলি লাল রক্তে লাল!! আমার লিলির শরীর লাল হয়ে গেছে। লিলির রক্তে রাস্তাও লাল হয়ে গেল।
বস লোকজন আসছে। মিজানের সাথে আমিও গাড়িতে ঊঠে বসি। আমাকে ধরে কোন শালা?
লিলির বাম গালে তিলক ছিল। হাসলে গালে টোল পড়তো। আমি পাগল হয়ে যেতাম! লিলির তিলটা ছিল বাংলাদেশের নায়িকা দিতির মতোই! সব মিলিয়ে লিলি আমার কাছে অপ্সরা ছিল। ওর মতো সুন্দর মেয়ে জীবনেও দেখিনি! হয়তো সুন্দর দেখেছি, কাঊকেই লিলির মতো মনে হয়নি। আমার জীবনে লিলি চক্রাকারে ঘূর্ণনায়মান বাসের মতো।
মরুভূমিতে দিনশেষে তপ্ত বালিতে হিমেল হাওয়া বয়। আমার জীবনের শেষে হিমেল হাওয়া হয়ে লিলি কখনো আসবে না। অপ্সরা লিলির জন্য ভালোবাসা অফুরান।
ডিএসএস/