আধি
মিমি, মিমি ফারজানা নামটি দেখেই সেলিম ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠায়। ফেসবুকে কোনো ছবি দেয়া ছিল না, তবে মিমি নাম দেখলেই সেলিমের মনটা কেমন কেমন করে। এক সপ্তাহ পরে রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করে মিমি। হুম এই সেই মিমি!
মিমি ও সেলিম দুইজন দু’জনার ভালো বন্ধু ছিল। দু’জনকে দু’জনাই ভালোবাসতো। পারিবারিক কারণে তাদের পরিণয় হয়নি। সেলিম মেধাবী ছাত্র ছিল, বাম রাজনীতির সাথেও যুক্ত ছিল। সে গ্রামের সাধারণ পরিবারের ছেলে। সেলিম যতটা বন্ধু বাৎসল ছিল, ততটা মিমিকেও ভালোবাসতো। সেই সময় সেলিম-মিমিকে একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকেই দেখেছে। তাদের বিচ্ছেদ ভালো ছিল না; দু’জনার মনেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিলেন। মিমি ঢাকার মেয়ে। আর, সেলিম এখন সুইডেন প্রবাসি। মিমি এখন বাংলাদেশে থাকে। মিমির স্বামী রুশো বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।
সেলিম মিমিকে ভোলেনি। কাকতালীয় ১৫ বছর পরে আবার যোগাযোগ হয়। সেদিন মিমির সাথে সেলিমের দীর্ঘ সময় কথা হ’ল। অনেক কথা জমা ছিল মিমির মনে! অনেক কথা বলেও বলা হল না। সেলিম আরও কথা বলতে আগ্রহী। মিমি অপেক্ষায় রইল সেলিম আবার কবে কল করে, আর সেলিম মিমির সাথে কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে রইলো।
তবে এখানে মিমিই ব্রেক দিল। মিমি সেলিমকে কল করে পরিবারের খোঁজ নিল। সেলিমের ছেলে আর মিমির ছেলে একই বয়সী। ছোটবেলায় মিমির বিদেশে যাবার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল; আজও রয়েছে বিদেশ ভ্রমণের। মিমির স্বামী অত্যন্ত কর্ম পাগল মানুষ। তিনি মিমিকে তেমন সময় দিতে পারেন না। মিমির অবশ্যি আক্ষেপ নেই। আর, আক্ষেপ করেই লাভ কি? স্বামীর সাথে সম্পর্ক মিমির বরাবরই ভালো।
সেলিমের সাথে নতুনভাবে যোগাযোগ হবার পরে মিমির মনের জমে থাকা কালো মেঘ বেশ খানিকটা সড়েছে। এখন মাঝে মাঝে মিমি সেলিমের সাথে কথা বলে। সেলিম মিমির ছেলের খবর নেয়। মিমির ছেলে এ লেভেল শেষ করেছে। এখন বিদেশে এডমিশন নিতে আগ্রহী। মিমিও চায় তার ছেলে বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া করুক। কিন্তু, মিমির স্বামী ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে তেমন আগ্রহী নন।
একদিন অচেনা মোবাইল নম্বর থেকে মিমির মোবাইলে কল আসে। অপর প্রান্তে পরিচিত কণ্ঠস্বর! সেলিম হোটেল পূর্বানীতে মিমির জন্য অপেক্ষা করছে! মিমি ভাবতেও পারেনি সেলিম এভাবে তাকে সারপ্রাইজ দেবে। অতঃপর সেলিমের সাথে মিমির দেখা হয়। অনেকটা সময় তারা এক সাথে ছিল, অনেক গল্পও করেছে।
সুইডেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মিমির ছেলের এডমিশন হতে পারে। সেলিম স্পসরশিপ দেবে। তাতে ছেলের কাছে মিমিও মাঝে মাঝে যেতে পারবে। তবে একমাত্র ছেলেকে ছাড়তে চায়নি মিমির স্বামী। দশ বছর পর সেলিম দেশে এসেছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু -বান্ধব সবার সাথেই সে যোগাযোগ করেছে। সেলিমের কোন পিছুটান নেই। সে বিদেশে স্থায়ী হয়েছে, আর দেশে ফিরবে না। অবশ্য দেশে এতো দিন পরে এসে কি করবে? নতুন করে শুরু করা মুশকিল বটে। বরং যে দেশে আছে সেটাই ভালো। সেলিম অল্প দিনেই সুইডেন ফিরে যাবে। যাবার পূর্বে সে তার সময়ের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, প্রশাসনের উচ্চ্কর্তাসহ অনেক প্রভাবশালীর সাথেই সৌজন্য সাক্ষাৎ করে নিল। অতঃপর একদিন ফ্লাইটের সময় হয়ে গেল। মিমির কাছে বিদায় নিয়ে সেলিম নিজ ভুমি ত্যাগের জন্য প্রস্তুতি নিল। যাবার সময় মিমিকে কানে কানে বলে গেল তোমার ছেলেকে সুইডেন পাঠানোর মন স্থির কর। আমি পাশে থাকব।
রুশোর এই মাসেই বিদেশ যাবার ছিল। তা' আর যাওয়া হল কই? গত মাসেই তিনি দিল্লি থেকে ফিরেছেন সাথে মিমিও ছিল। রুশো চৌধুরী দেশের একটা লিডিং কোম্পানিতে নির্বাহী পদে চাকুরীরত রয়েছেন। তিনি ফিন্যান্স ও প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্টের হেড। অফিসে দক্ষ আর বিশ্বাসী হিসেবে রুশোর পরিচিত রয়েছে। টেন্ডার ও ব্যয় নিয়ে তার অনেক সময় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। অফিসের কাজে অনেকের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, তবুও রুশো নিজ কাজে সাহসী ছিলেন।
ড্রইং রুমের ছোফাতে মিমি নির্বাক বসে রয়েছে। মিমিকে ঘিরে অনেক পুলিশ। মিমির ছেলের ঘুম এখনো ভাংগেনি। রুশোর কোম্পানির মালিক অন দ্যা ওয়ে। মিমির মোবাইলটা বেজে উঠলো। ওপাশ থেকে বলা হল, সব মালিকের ইচ্ছে, মন খারাপ কর না। ধৈর্য ধর; আমি তো রয়েছি না! অল্প কথা বলে সেলিম লাইন কেটে দিল। ঘটনাটি প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় কল্যাণে সবার জানা হয়ে গেছে। মিমির প্রচন্ড মন খারাপ। সে ভেংগে পড়েছে। রুশোর এভাবে চলে যাওয়া সে মেনে নিতে পারছে না। স্বামী, সংসার আর পুত্রকে নিয়ে মিমি অনেক স্বপ্ন ছিল। রুশো চলে যাবে এভাবে কেন? রুশো খুন হবে তা' মিমি কখনও কল্পনাও করেনি। কে খুন করেছে? কেন খুন করেছ? রুশোর তো কোন শত্রু ছিল না।
রুশোর মার্ডার কেস নিয়ে পুলিশ বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। রুশো মারা যাবার পরে প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না, যা রুশো চৌধুরীর কাছে ছিল। এখন কি উপায়? মিমি রুশোর অফিসের কিছুই জানতো না। কেউ কি প্রফেশনাল জেলাসির জন্য রুশোকে মেরে দিল? মার্ডার কেসটা স্পর্শকাতর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হল।
মিমি মাঝে মাঝে কোর্টে হাজিরা দিতে যায়। আবার কখনো উকিলের কাছে, কখনো থানা থেকে ডেকে বসে। এখনো হত্যার কোন ক্লু না পেলেও মিমি হত্যার বিচার পাবার ব্যাপারে আশাবাদি। এই খুনের মামলায় সবাই মিমিকে সহায়তা করছে।
সময় ও নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। মিমির ছেলের সেমিস্টার লস হতে চলেছে। মিমি সেলিমের সাথে যোগাযোগ করে। এখন ছেলের সাথে বাইরে যেতে মিমির আর কোন বাধা নেই। সেলিম এমনটাই চেয়েছিল। মিমির কোনো পিছুটান না থাকুক, সে শুধু সেলিমের হয়ে যাক। সেলিম কিছুদিন সময় নিল আর ছেলেকে আবেদন করতে বলল। ছেলে আগেই আবেদন করেছে মিমি জানায়। মিমি বিদেশে যাবার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। কয়েকমাস ছেলের সাথে থেকে তারপর আবার দেশে ফিরবে। এর মধ্যে মামলাও এগিয়ে যাবে। ছেলের মেইলে কনফার্মেশান লেটার এসেছে। এখন অর্থনৈতিক দুরবস্থায় সেলিম সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। আসলে বিপদেই বন্ধুর পরিচয়।
একটা মোবাইল নম্বর যা থেকে রুশো চৌধুরীর সাথে কথা বলা হয়েছে ভিন্ন নামে, ভিন্ন পরিচয়ে। সেই মোবাইল থেকে ভিন্ন ভিন্ন সিম ব্যবহার করেও কথা বলা হয়েছে। এই মোবাইল থেকে মিমির বন্ধু সেলিমকেও কল করা হয়েছে। আইপি এড্রেস মিলে গেছে! পুলিশের সন্দেহভাজনের তালিকায় এখন সেলিমের নামও চলে এসেছে। মিমিকে পুলিশ সন্দেহ করছে কি না তা' আপাতত বোঝা যাচ্ছে না। তবে সেলিমের ব্যবহৃত সিম থেকে মিমির সাথেও কথা বলার প্রমাণ মিলেছে। তদন্তের স্বার্থে পুলিশ বিষয়টি গোপন রেখেছে।
এদিকে বিমানের টিকেট মিমির হাতে এসে গেছে। এখন শুধু বিদেশ যাবার পালা। বিদেশে থাকাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা সেলিম করেছে। বিদেশ যাত্রার ব্যাপারে মিমিকে কোন বেগ পেতে হয়নি। সব কাজ সেলিম করে দিয়েছে। এখন শুধু দিন গণনার পালা, আর মাত্র তিন দিন পরে মিমির ফ্লাইট। চোখের পলকে তিন দিন চলে যাবে।
গাড়ি চলছে এয়ারপোর্টে অভিমুখে। বিদেশ যাত্রা মিমির ব্যক্তিগত, তাই পুলিশকে ইনফর্ম করেনি। আর, বিদেশ যাত্রা তো মাত্র কয়েক মাসের জন্য। গাড়ি চলমান থাকা অবস্থায় মিমির মোবাইলটা বেজে উঠলো। মিমি কল ধরতে পারেনি। এয়ারপোর্টে যাবার পরে মিমি কল ব্যাক করলো। পুলিশ সেলিম সম্পর্কে মিমিকে তথ্যগুলো শেয়ার করলো। মিমির শরীর ঘেমে উঠলো! মিমি পুলিশের তথ্য বিশ্বাস করতে চাইছিল না। কোথাও ভুল হচ্ছে মনে হয়। মিমি আর তার ছেলে বিমানের অভিমুখে রওনা হল। মিমি এই মুহুর্তে তার ছেলের ভবিষ্যত নষ্ট করতে চায় না।
ডিএসএস/