আমার সীমান্ত
কথায় আছে না যে মেয়েটা প্রেমকে ভয় পায় তার জীবনে প্রেম আসে। একেবারে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া প্রেম, নিঃশেষ করে দেওয়া প্রেম। হুম, আমার মতো হাবাগোবা, ঘরকুনো মেয়েটাও প্রেমে পড়েছিল। ভীষণ ভীষণ প্রেমে পড়েছিল।
সালটা ২০১২। আমি সবেমাত্র অনার্স ১ম বর্ষে উঠেছি। সব সময়ই আমি একটু চুপচাপ স্বভাবের। একটু একা থাকা, একটু কম কথা বলা আমার বরাবরই পছন্দ। তা ছাড়া, আমার বাবা পুরান ঢাকার ধর্মপ্রাণ মানুষ। আমরা দুইবোন সর্বদাই ধরাবাঁধা নিয়মে বড় হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা শুরু হলো। নতুন পরিবেশ, নতুন সবকিছু। আমার মতো ঘরকুনো মেয়েটা মানিয়ে নিতে পারছিলাম না এই চাকচিক্যময় পরিবেশের সঙ্গে। একটা বান্ধবী হলো। মোহনা নামে। সেই সঙ্গে পেলাম একটা বন্ধু মহল। চলছে সময়। ক্লাস, বন্ধুমহল, নতুন পরিবেশ নিয়ে বেশ আছি আমি। কে জানতো আমার মতো মেয়েটাকে প্রেম সায়রে ভাসাতে একজন আসতে যাচ্ছে!
সময়টা ফেব্রুয়ারি। বসন্ত উৎসব চারপাশে। মোহনার জোরাজোরি তে চিরপরিচিত থ্রিপিস ছেড়ে শাড়ি পরলাম আমি। হলে রুমমেট এক বড় আপুকে বিশ টাকা দিয়ে লাল-হলদে শাড়ি পরে নিলাম। মোহনা পাশেই ছিল। সাজগোছ আমার তেমন পছন্দ নয়। মোহনা আমার কোমড় সমান চুলগুলো ছেড়ে দিলো। আমি চোখ পাকাতে বলল, ‘জান্নাত, তোকে আজ রানি লাগছেরে। আমি ছেলে হলে নির্ঘাত তোকে নিয়ে পালাতাম।’
লজ্জা পেলাম আমি। আমার ফর্সা গাল লাল হয়ে গেল। মেয়েটা এত দুষ্ট! আপুও মুচকি হেসে সায় দিলেন ওকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বড় করে অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। আমি জীবনে কখনো শাড়ি পরিনি। এইবারই প্রথম। তাই শাড়ি ধরে আস্তে আস্তে হাঁটছিলাম। মোহনা দৌড়ে আমাকে ফেলে রেখেই চলে গেল। নিচে কুঁচি ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই কারও সঙ্গে ধাক্কা খেলাম। ‘ক্ষমা করবেন।’
বলে উপরে তাকাতেই দেখি একটা বাসন্তী রঙা পাঞ্জাবি পরা ছেলে। চোখদুটো কী যে মায়াবী! চুলগুলো একটু বড়, অগোছালো। আমার মনে হলো চুলগুলো বুঝি এমন অগোছালোই সুন্দর। গোছালো হলে বেমানান লাগতো তাকে। আমার দিকে কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি কপাল কুঁচকে তাকালাম। কী গভীর তার দৃষ্টি! অদ্ভুত বিপদে পড়লাম তো! একটু কাশির আওয়াজ করলাম আমি। স্টেজে রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে যাচ্ছেন শিল্পীরা।
‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।
আমি সকল দাগে হব দাগি॥
তোমার পথের কাঁটা করব চয়ন, যেথা তোমার ধুলার শয়ন
সেথা আঁচল পাতব আমার- তোমার রাগে অনুরাগী...
ছেলেটার ধ্যান ভাঙল বোধহয়। নির্লিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘কোন ইয়ার?’
এমন প্রশ্নে কিছুটা থতমত খেলাম আমি। আমতা আমতা করে বললাম,
‘ফার্স্ট।’ ‘ডিপার্টমেন্ট?’
‘ইংলিশ।’
‘বাবা-মা বড়দের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয় শিখায়নি?’
‘মানে?’
‘আবার মানে মানে করছো! সালাম দাও। আমি তোমার চারবছরের সিনিয়র।’
অসহায় কন্ঠে বললাম, ‘আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম।’
তখন কে যেন পিছন থেকে ছেলেটাকে ডাক দিল।
‘এই সীমান্ত। কি করিস?’
সীমান্ত যেই পিছু ফিরলেন। আমি দৌড়ে পালিয়ে এলাম। শাড়ির কুঁচির দিকে নজর নেই আমার একেবারে হলে। শুরুটা বোধহয় এখানেই।
চলছে সময়। এর মাঝে দুয়েকবার সীমন্তর সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার। আমি পালিয়ে পালিয়ে থাকি। তাকে দেখলে সেই সীমানায় আমি যাই না। কিন্তু একটা জিনিস টের পাচ্ছি। আমার কিছু একটা পরিবর্তন হচ্ছে। রাতে ঘুম আসেনা, সীমান্তকে দেখলেই বুক ধুকপুক করে। এই অনুভূতি একেবারেই নতুন আমার জন্য। এটা কী ভয় নাকি অন্যকিছু!
‘ভাবি, আফনার গোলাফ ফুল নেন।’
টিএসসিতে বসে বন্ধু মহলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। প্রতিদিনের মতো আজ আবারও একটা বাচ্চা মেয়ে একটা গোলাপ ফুল এগিয়ে দিল আমায়। আমি কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই দৌড়। মাহিন টিটকারির সুরে বলল,
‘কি ব্যাপার বলো তো জান্নাত। প্রতিদিন একটা করে গোলাপকে দেয় তোমায়! আছে নাকি কোনো প্রেমিক।’
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আর প্রেমিক!
জ্বরের কারণে ক্লাসে দুইদিন যাবত যেতে পারিনি। আজ এলাম। ক্লাস শুরু হতে সময় বাকি এক ঘণ্টা। বন্ধুমহলে আড্ডা দিতে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই কেউ একজন খপ করে আমার হাত টেনে ধরলো। চমকে উঠলাম আমি। পিছু ফিরে দেখলাম সীমান্ত।
‘আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।’
আমার সালামের জবাব দিলেন না তিনি। এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলেন কেবল।
‘আসো নাই কেন দুইদিন?’
‘জ্বর ছিলো।’
উনি উনার ডান হাতটা আমার কপালে ছুঁয়ালেন চিন্তিত ভঙ্গিতে। বিরবির করে বললেন, ‘জ্বর এখনো হালকা আছে।’
‘ওষুধ খেয়েছো।’
‘হুম।’
‘চলো।’
‘কোথায়?’
‘সিনিয়রদের প্রশ্ন করতে নেই।’
কী ছিল তার কন্ঠে! সেদিন সারাদিন ঘুরলাম আমরা। ফুচকা খেলাম, হাওয়াই মিঠাই খেলাম। শেষে আমার হাতে একমুঠো সাদা রঙা চুড়ি পরিয়ে দিলেন সীমান্ত। কানেকানে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘সীমান্তের জেলখানায় বন্দী হলে ম্যাডাম। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছাড়ছি না।’
অতঃপর হলের সামনে আমাকে নামিয়ে দিল সে। চলে আসবো তখনো দাঁড়িয়ে। আমি পিছু ফিরলাম। সে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। কি হলো আমার! যাকে এত ভয় পেতাম তার সঙ্গে সারাদিন ঘুরলাম! তার মনের জেলখানায় বন্দী হয়ে গেলাম আমি! মনের টান নাকি জানি না। পিছু ফিরে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম তার সামনে। সামান্য হাসি ফুটল তার মুখে।
‘কী চাই?’
‘জানি না।’
বলেই পিছু ফিরে দৌড়ে চলে এলাম আমি। আমাদের ভালোবাসার যাত্রা শুরু হলো অবশেষে। একসঙ্গে সময় কাটানো, ঘুরাঘুরি। বেশ কাটছে আমাদের দিন। সীমান্ত বন্ধু প্রিয় মানুষ। তার বন্ধু সবাই আমাকে ভাবি ভাবি ডাকে। সিনিয়রদের মুখে এমন ডাক শুনে কী যে লজ্জা লাগে আমার!
পেরিয়ে গেলো সময়। সীমান্তর মাস্টার্সে ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া শেষ। সীমান্তর বাবা ব্যাংকার। মা নেই। বাড়িতে ছোট একটা বোন। ব্যাংকে জবের জন্য ট্রাই করছে। কিছুদিনের ভেতরই হয়ে যাবে হয়তো। হঠাৎই বাড়ি থেকে ফোন এলো আমার। বাবা অসুস্থ। জরুরি যেতে বলেছেন আমায়। আমি হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে গেলাম। বাবার অবস্থা খারাপ। হসপিটাল, দৌড়াদৌড়ি। সব মিলিয়ে কেটে গেল এক মাস। সীমান্ত এই এক মাসে আমাকে ঠিকমতো দুবারও কল দেয়নি আমায়। আমি দিলেও ফোন বন্ধ। মনটা কু ডাকছে, ছটফট করছে বারেবারে। বাবা কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। বিয়ে দিতে চান আমায়। আমি কিছু বলতেও পারছি না। হলে ফিরে এলাম আমি। সীমান্তর মোবাইল বন্ধ। তার বাড়ি আমি চিনি না। এদিকে বাবা বাসা থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছেন। একদিন সীমান্ত টিএসসির মোড়ে ডাকল আমায়। কেমন শুকিয়ে গেছে সে। চোখের নিচে কালো দাগ।
‘আমি এই সম্পর্কটা থেকে বের হয়ে যেতে চাইছি।’
সীমান্তর এই বাক্যটা শুনে পৃথিবী থমকে গিয়েছে আমার। আমি চিৎকার করলাম, কাঁদলাম। সীমান্ত কোনো কথা না বলেই নিষ্ঠুরের মতো চলে গেলো। বাসায় বিয়ে ঠিক করা হয়েছে আমার। সিয়াম নামে এক ছেলের সাথে। সে পেশায় একজন ডক্টর। সবদিক দিয়েই সুপুরুষ। কিন্তু আমার মন যে একজনেই মত্ত!
বিয়ের আগের রাতে আমার শত কান্না, আর্তনাদ শুনে সীমান্ত এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমার কোনো কথা সে শুনেনি। আমি বারবার জানতে চেয়েছি তার কি হয়েছে। সে বলেনি। একটাই কথা তার বাবা নিজের বন্ধুকে ওয়াদা করেছে। ওয়াদা রক্ষার্থে সেখানেই বিয়ে করতে হবে তার। শেষ বারে কপালে একখানা চুমু খেয়ে বলেছে আমায়,
‘ভালো থেকো জান্নাত।’
জেদের বসেই বিয়েটা করে ফেললাম আমি। পেরিয়ে গেলো দশদিন। সবাই ভালো। সিয়ামও। কিন্তু আমার মন যে একজনেতেই। একটা ফোন পেয়ে ছুটে গেলাম এয়ারপোর্ট। সীমান্তর বন্ধু মুবিন ভাইয়া কল করেছিল। আমি যেতে যেতেই যাত্রীরা সবাই প্লেনে উঠে গেছে।
‘তুমি দেরি করে ফেলেছো জান্নাত। সীমান্ত চলে গেছে।’
আমি কান্না মাখা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
‘ওর কি হয়েছে ভাইয়া?’
‘ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজ। হয়তো আর বাঁচবে না। তবুও আংকেল জোর করে আমেরিকা নিয়ে গেছেন।’
স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। চিৎকার, কান্নাকাটি! কেউ থামাতে পারল না। এক সময় নিজেই শান্ত হয়ে গেলাম। যখন বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট থেকে তখন মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো প্লেনটা। তাতে আমার সীমান্ত আছে। কিন্তু হাত বাড়ালে আর ছুঁতে পারব না তাকে! আমার সীমান্ত আমার থেকে দূরে চলে গেছে। অনেক অনেক দূরে।