এই সিনিয়র!
ভার্সিটির প্রথম দিন ছিল।
সকাল নয়টার মধ্যে ভয়ার্ত মন নিয়ে এক পা দু'পা করে ক্যাম্পাসে ঢুকে নিজেকে ভীষণ অসহায় আবিষ্কার করলাম।
একটু পর খুঁজতে খুঁজতে নিজের ডিপার্টমেন্টে পৌঁছে গেলাম। চোখের সামনে সব অপরিচিত মানুষের ভিড়।
সাহস যুগিয়ে কথা বলে পরিচিত হলাম ক'জন নতুন বন্ধুর সঙ্গে। ডিপার্টমেন্টের ইমিডিয়েট সিনিয়র ভাই আপুরা সে’দিন আমরা যারা এসেছিলাম সবাইকে ডেকে নিলো পরিচয় পর্বের জন্য।
পরিচয় পর্বটা হচ্ছে সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্কের আনুষ্ঠানিকতা। যদিও অনেক সিনিয়রের কাছে বিষয়টা সম্পর্কে আগাম ধারণা নিয়েছিলাম তবুও বড্ড নার্ভাস এবং ভয় করছিল সেই মুহূর্তে।
পরিচয়ে নেওয়ার মাঝে কেউ ভুল করলে ভাইয়ারা বকা দিচ্ছেন, কারও থেকে গান শুনছেন, কেউ কবিতা আবৃত্তি করছে কেউ বা কৌতুক করছে।
হঠাৎ শায়লা নামের এক ইমিডিয়েট সিনিয়র আপু আমার নাম জেনে নিয়ে আমায় বলল,
-রাফিদ, তুমি একটা গান গেয়ে শুনাও তো।
তার এই যত্ন করে বলা কথাটা শুনে নিমিষেই সব নার্ভাস ও ভয় কীভাবে যেন কেটে গিয়েছিল আমার। খুব স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গান গেয়ে সে'দিন সবার কাছে বেশ বাহবা পেয়েছিলাম।
রাতে শায়লা আপুর বলা সেই কথা’টা এবং তার মায়াবী চেহারা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। এভাবে ক’দিন কেটে যায়, এরই মধ্যে সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠি। ইমিডিয়েটসহ অনেক সিনিয়র ভাই আপুর সঙ্গে ফেইসবুকে ফ্রেন্ড হয়ে যাই। ফেইসবুকে আপলোড করা শায়লা আপুর ছবিগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতাম। তাকে দেখলেই একটা ভালোলাগা অনুভব হতো। পৃথিবীর একটা সুন্দর সুখ হচ্ছে কাউকে একটুখানি দেখার সুখ, যার উপলব্ধিটুকু ভীষণ শান্তির। তার ছবিতে প্রতিনিয়ত রিয়্যাক্ট প্রতিনিয়ত, তার ছবিকে কেন্দ্র করে সুন্দর করে গুছিয়ে মন্তব্য করতাম। মাঝে মাঝে ডে স্টোরির রিপ্লে দিতাম। সবকিছুতে শায়লা আপুর মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতাম।
ডিপার্টমেন্টের যেকোনো প্রয়োজনে আমি শায়লা আপুকেই নক করতাম।এভাবেই ধীরে ধীরে নিজের অজান্তেই আপুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। কি করব ঠিক ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাকে দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম, সব মিলিয়ে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতি। এভাবে শায়লা আপুর খুব কাছের জুনিয়র হয়ে উঠেছিলাম।
ক'দিন ধরে সিনিয়র জুনিয়র সম্পর্কে তৈরি হয় নাটক মুভিগুলো দেখছিলাম। মানুষ যখন কোনো কিছু ভেবে ভালোলাগা অনুভব করে তখন সে সব কিছুতেই সেই অনুভূতি টুকু মেলাতে চায়। সিনিয়র জুনিয়র কনসেপ্টের নাটক মুভিগুলোতে দেখতাম কীভাবে তাদের সম্পর্কের শুরু টা হয়, কীভাবে তারা তাদের দূরুত্ব কে পিছনে ঠেলে কাছে আসে। সারাদিন মাথায় এই চিন্তাগুলোই ঘুরপাক খেতো।
একদিন আপুর থেকে আমার কোর্সের একটা বই চেয়ে নেই যেহেতু তিনি ইমিডিয়েট সিনিয়র তাই তাদের গত বছরের বই গুলো আমাদেরও পড়তে হবে। দু'দিন পর সেটা ফেরত দেওয়ার সময় এক বন্ধুর পরামর্শে আর এদিকে নাটক মুভিগুলোর আইডিয়া কাজে লাগিয়ে বইয়ের প্রথম পেজে একটা চিরকুট আর গোলাপ দিয়েছিলাম।
চিরকুটে লিখেছিলাম,
শায়লা আপু, আপনাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। আমি জুনিয়র হিসেবে বলছি না। বর্তমানে তো অনেক জুনিয়র সিনিয়ররা সম্পর্কে জড়াচ্ছে, তাদের সম্পর্কগুলো পূর্ণতাও পাচ্ছে। মনের বোঝাপড়া বড় বিষয়। আপনার সব কথা মেনে চলব, আমাকে একটু সুযোগ দিয়ে দেখুন প্লিজ। আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি আপু।
ইতি, আপনার স্নেহের রাফিদ
বইটা ফেরত দেওয়ার পর বার বার মনে হচ্ছিল এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ আমি কীভাবে করে বসলাম! বইটা জমা দেওয়ার পরদিনই আপু আমাকে ডিপার্টমেন্ট থেকে দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে রাগান্বিতভাবে বলল, এসব করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইছো? মাথায় সারাদিন এসব ঘুরে। আর কাউকে পেলে না শেষমেশ নিজ ডিপার্টমেন্ট সিনিয়র কে!
লজ্জা করে না তোমার।এত দুঃসাহস কই থেকে আসে? জানাব তোমার ব্যাচমেট দের যে তুমি এসব করে বেড়াও।
কাঁদতে কাঁদতে আপুর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম সেদিন। বার বার অনুরোধ করেছিলাম কাউকে কিছু না বলতে। মুখের উপর গোলাপ চিরকুটটা ছুড়ে ফেলে তিনি চলে গেলেন।
এভাবে কেটে গেল আরও দুই দিন। আপুর দিকে ভুলেও তাকাতাম না। সবসময় তাকে ইগনোর করে চলতাম। ভুলতে চেষ্টা করতাম বিষয়টাকে। তবে একটা জিনিস বুঝতাম জীবনের প্রথম ভালো লাগা ভুলে যাওয়া কঠিন তবে মনে রেখেই বা কী লাভ!
একদিন হঠাৎ ক্যাম্পাসে এক ইমিডিয়েট সিনিয়র ভাই আমাকে একা ডেকে নিলো ভার্সিটির বাসে। ভয়ে কাঁপতেছিলাম প্রচুর। এরই মাঝে তিনি হঠাৎ গালে থাপ্পর বসিয়ে দিলেন আর একটা চড় মারতে গিয়ে থেমে গেলেন। রাগান্বিত হয়ে বললেন, তোর সাহস হয় কীভাবে! এতটুক ছেলে, ভার্সিটিতে পা দিস নাই এক মাস হলো। তাতেই এতকিছু?
কলার চেপে ধরে বললেন, সিনিয়র আপুর সঙ্গে প্রেম করবি তাই না? তোর প্রেম ভরে দিব আমি আজ।
আমার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছিল। পাশে থাকা আর একটা ভাই কোন মতো তাকে ম্যানেজ করে আমায় চলে যেতে বলল।
ভাবিনি, ভার্সিটি জীবনে এসে কাউকে ভালো লাগাটা এতবড় ভুল হয়ে দাঁড়াবে। শুধু সিনিয়র বলেই কি এমন!
সেদিন রাতে এতসব অপমান বোধ থেকে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করছিলাম। বাসার কারও ফোন রিসিভ করতাম না।রাতে ডিপার্টমেন্টের বন্ধু রাকিব ফোন করে। ও আজকের বিষয়টা দেখে ফেলেছে। আমি ওকে জানাতে চাচ্ছিলাম না পরে এক প্রকার জোর করেই রাকিব সব শুনে নেয়। তারপর আমার পরিস্থিতি বিবেচনা করে এক মুহূর্ত দেরি না করে আমার হোস্টেলে এসে আমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় মন ভালো করার জন্য।
এভাবে চার দিন কেটে যায়। এসব মানসিক চাপে আমি একদম ভেঙ্গে পড়েছিলাম।
এর ভেতর আপুর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। তার দিকে ভুল করেও তাকাতাম না। সবসময় চেষ্টা করতাম তাকে এড়িয়ে চলার। ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখ, ভার্সিটির গেট দিয়ে ঢুকতেছিলাম এমন সময় শায়লা আপুকে দেখি রিকশা থেকে নামতে। আমার সামনে নামছিলেন তাই অনিচ্ছা স্বত্তেও তাকে চোখে পড়ে যায়। রিকশা থেকে নামার সময় হঠাৎ পা ফসকে রিকশা থেকে রাস্তায় পড়ে যান, পাশ থেকে আসা আর একটা গাড়িতে বেশ জোরে ঢাক্কা খান মাথায় আর কাঁধে।
তাৎক্ষণিক ভাবে তার কপাল ফেটে রক্ত পড়তে থাক। কোনোকিছু না ভেবে আমি এক দৌড়ে আপুকে ওই রিকশা তুলে হসপিটালে রওনা দেই। এর ভেতর আপু জ্ঞান হারিয়ে বেহুশ হয়ে যান। ডাক্তার আপুকে চেক করে বলেন ব্লিডিং বেশি হওয়াতে এখনি এ পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন দুই ব্যাগ। ভাগ্য ক্রমে আমার ব্লাডও ছিল এ পজিটিভ। ডাক্তারকে বললাম আমার গ্রুপে পজিটিভ, যতটুক রক্ত লাগে আমার থেকে নিন।
এভাবে দুই ব্যাগ রক্ত দেই আপুকে। রক্ত দেওয়া শেষে একটু পর আপুকে জানালা দিয়ে দেখলাম। ততক্ষণে আপুর বন্ধুরা হসপিটালে চলে এসেছেন তাকে দেখার জন্য। আমি হসপিটাল থেকে চুপচাপ চলে আসি। এভাবে কেটে গেল ৭ দিন। এর ভিতর আপুর খোঁজ পেলাম তিনি অনেকটা সুস্থ হয়েছেন এবং গত কাল হসপিটাল থেকে রিলিজ ও হয়েছেন।
১৩ ফেব্রুয়ারি রাতের দিকে ফোনে মেসেজের নোটিফিকেশন বেজে উঠে, চেক করে দেখি শায়লা আপুর টেক্সট। ভাবলাম, হয়তো থ্যাংক্স দেবে। যতই রাগ করুক, দুই ব্যাগ রক্ত দিয়ে যে দায়িত্ব নিভিয়েছি তার জন্য ধন্যবাদ দিতেই পারেন।
ইনবক্সে গিয়ে দেখি আপু লিখেছেন, রাফিদ তোমার প্রিয় রঙ কী? আমি অবাক হয়ে গেলাম, ভুল করে দিয়েছে কি না? অথচ নামতো আমারই লিখেছে, ভুল হয় কীভাবে! জবাব দিলাম, নীল রঙ।
আবার জানতে চাইলেন কাল ভার্সিটি যাব কি না আমি শুধু 'হ্যাঁ' বলে রিপ্লে দিলাম।
১৪ ফেব্রুয়ারির দিন ক্যাম্পাস জুড়ে ছেলে মেয়েদের ছড়াছড়ি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম ১৪ ফেব্রুয়ারির আমেজ দেখছি। রঙ বেরঙের শাড়ি, পাণ্জাবিতে সবাই সেজেছে।
নীল পাণ্জাবি পড়ে ক্যাম্পাসে গেলাম। বন্ধুদের সঙ্গে বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। দূর হতে শায়লা আপুকে দেখলাম। নীল শাড়ি পড়ে এদিকেই আসছেন। আমার কাছাকাছি এসে আপু আমায় ডেকে নিলেন। আমায় দেখেই মুচকি হেসে বললেন বাহ দুজনেই নীল রঙ্গের ড্রেস পরেছি। তা আপুকে ঘুরাবে না আজ? আপুর দিকে একটু তাকালাম, নীল শাড়ি আর নীল চুড়িতে আপুকে অসম্ভব সুন্দর লাগছিল।
পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতীক বোধহয় নীল, সেই সৌন্দর্যকে দু'ফুটেরও কম দূরুত্ব থেকে দেখছিলাম।
ইতস্তত বোধ হচ্ছিল তবুও রিকশা ডেকে আপুর পাশে বসেছিলাম। একটু পর আপু রিকশা থামিয়ে আমাকে নিয়ে একটা কোলাহলহীন জায়গায় নিয়ে গেলেন। আমাকে অবাক করে দিয়ে মাটিতে বসে তিনি একটা গোলাপ হাতে বললেন,
একবছর তো সমস্যা না। জুনিয়রের সঙ্গে প্রেম হলে শাসনে রাখা যাবে। লাভ আছে। জুনিয়ররা বয়ফ্রেন্ড হিসেবেও কেয়ারিং ও ভীষণ।
আমি ভয় ভয় চেহারায় এসব শুনে আপুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আপু ধমক দিয়ে বললেন এভাবে কতক্ষণ বসিয়ে রাখবে ফুলটা নাও পড়ে যাবে তো।
ফুলটা নিয়ে আপুকে ধন্যবাদ দিলাম। আপু বললো, গাধা একটা।
এভাবে কেউ ফুল দিয়ে প্রপোজ করলে তাকে ধন্যবাদ দেয়। আর আমাক তুমি কি না ভালোবাসো? আমার সঙ্গে প্রেম করবা? এই তার নমুনা!
তারপর কানে গিয়ে বললেন, আমরা দু'জন যখন একসঙ্গে থাকব তখন শুধু শায়লা বলবে।
শায়লা আপু বলবে না বু্দ্ধ।
শক্ত করে আপুর হাতটা নিজের হাতে টেনে বলেছিলাম, এই সিনিয়র, এই হাতটা সারাজীবন হাতের ভাঁজে থাকুক। থাকবে তো?
আপু তার অন্য হাতটাও উপরে রেখে বললেন, বিশ্বাস রাখো, থাকবে ইনশাআল্লাহ।
এভাবেই চলছে আমাদের পথচলা।
এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের সম্পর্কের তিন বছর পূর্ণ হবে।
ডিএসএস/