মরা মাছের মতো ঘোলা চোখে চেয়ে দেখা জীবন
আধুনিক তথাকথিত প্রেমিক/প্রেমিকাদের দেখে আমারও প্রেম জাগলো। আজ তার ৮ম মৃত্যুবার্ষিকী, মানে আমার ১০ বছরের প্রেমিকা, ১১ বছরের সহধর্মিণী, মানে মোট ২১ বছরের সাহচর্য। তাকে যেদিন প্রথম দেখেছি সেদিনই বলে ফেলছিলাম ভালোবাসার কথা। তারপর ওই যে একুশ বছরের লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প। হাজার কথা, হাজার কবিতা, হাজার হাসি-কান্না সব মিথ্যা করে তিনি পাখি হয়ে উড়াল দিলেন।
সে সময় মোবাইল ছিল না, রাত জেগে ভিডিও কলে কথা বলে পরে ভাইরাল হবার ভয় ছিল না। ডেইলি সকাল ১০টায় পোস্ট অফিসের সামনে দেখা করে ইচ্ছেমত জায়গা বেছে মনের ফানুস উড়াতাম, দিনের আলোয় জোনাক খুঁজতাম, সাঁঝের মায়ার আগেই ঝিঁ ঝিঁর ডাক শুনতাম। প্রতিদিন দেখা হতো তবু আমরা চিঠি আদান-প্রদান করতাম। কত রকমের চিঠি, গোটা প্যাড ভরে চিঠি, লাল, নীল, সবুজ, হলদু আর শুকনা গোলাপ পাঁপড়ি পাতার ভাঁজে ভরা চিঠি। হাজার দেড়েক লাল-নীল চিঠি আজও আমার ট্রাংকে, তবু আমার কথা ফুরায়নি, তোমার ফুরিয়েছে। তুমি মিথ্যাবাদী, তাই উড়াল দিয়েছ ওই আকাশে। আমার বলার ছিল, আছে, থাকবে... । তোমার তুলনা তুমিই। এখনো আমার হৃদয়ে আছ— যেভাবে আগেও ছিলে।
আমার জীবনে আর যেই আসুক তোমার যায়গা তোমারই। তুমি চলে গেছ তবু ওই কৃষ্ণচূড়ার নিচে দাঁড়িয়ে শান্ত চোখে বলি, লাভ ইউ ‘হিম’। তোমার নামের সাথে কাজের কত মিল, কত চুপচাপ শান্ত, ধীর স্থির ছিলে তুমি, আমার ঠিক উল্টো টা। আমরা যখন ঘুরে বেড়াতাম তখন আমি খুব চাইতাম তুমি চোখে কাজল দাও, কাজল কালো ডাগর চোখে আমার দিকে তাকাও। আমি চাইতাম তোমার পায়ের আলতা হই, তাতেও তোমার আপত্তি। কোনো কসমেটিকস তোমাকে ছুঁয়ে দেখেনি কখনো। তখনো তুমি নাক ফুঁড়োওনি, তবু আমি খুব শখ করে নাকফুল অর্ডার দিয়ে বানালাম। তুমি কত কষ্ট করে নাক ফোঁড়ালে আমার জন্য। তোমার নাক ফোঁড়ানোর কষ্টে আমার চোখে জল। কি ন্যাকা ন্যাকা প্রেম ছিল আমাদের তাই না।
তোমার পুরনো চিঠিগুলো আমি এখনো মাঝে মাঝে পড়ি…। কি মিথ্যাবাদী তুমি, কত কথা, কত স্বপ্ন দেখিয়ে ওই আকাশে ঠাঁই নিলে তুমি। দশ বছর ধরে চলা প্রেম আমাদের স্বামী-স্ত্রীতে সংসারে রুপ নিল। বিয়ের ৪ বছরের মাথায় তোমার কোল আলো করে আমাদের ছেলে সন্তান এল। বছরে বছরে জমতে থাকা আমাদের স্বপ্নগুলো রঙিন পাখায় ভর করতে লাগল, ডানা মেলল এতদিনের সব রং-রুপ, যার জাল বুনেছিলাম আমরা তিলে তিলে এতদিন ধরে।
সবই তো ভালো চলছিল আমাদের। হঠাৎ আমার চাকরির পোস্টিং হলো সুদূর আফ্রিকার নাইজেরিয়া। তুমি সরাসরি বললে যেও না অতদূরে, আমার যশ সম্পত্তির দরকার নেই, ডাল ভাতেই চলবে। তুমি অতদূর গেলে আমরা হারাব, হারিয়ে যাব, সে কি কান্না তোমার। তবু আমি চলে গেলাম কালো সোনার দূর দেশে...। সেখান থেকে আবার দুবাই। দুবাই থেকেই খবর পেলাম রাতে তোমার জ্বর আসে, গরমেও ঠান্ডা লাগে। আমি সব ছেড়ে দেশে ফিরলাম, তোমার মেডিক্যাল চেকআপ হলো। ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ল তোমার। সমস্ত আকাশ তখন আমার মাথায়। তখনো বুঝিনি কোন অভিমানে তুমি আকাশে তোমার ঠিকানা লিখে ফেলেছ। তখনো বুঝিনি আমি একটু দূরে যাওয়াতে এত অভিমান জমেছিল তোমার— যে তুমি অনেক দূরে চলে যাবে। এত অভিমান কেমনে করলে হিম। তোমার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড বসালাম দেশে। দেশের বাইরে নিলাম, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি। আমার অবর্তমানে তোমার শরীরে মালা বেঁধেছে ব্লাড ক্যান্সার, তার গভীরতা চূড়ান্ত। তবু আমি বিশ্বাসই করলাম না— তুমি চলে যাবে। আমি বললাম তোমার কিছু হবে না, তুমি ফিরবে। তুমি বললে না, তুমি ফিরবে না, তুমিও দূরে যাবে আমাকে ফেলে, সে জন্য এত দূরে হিম…।
যে চোখে তুমি দূর্বা ঘাসে শিশির খুঁজতে, যে তুমি সাদা আকাশে রংধনু খুঁজতে, তোমার সে স্বপ্নময় রঙিন চোখ পাথর হয়ে থমকে গেল। কেমোথেরাপির রাসায়নিক বিকিরণের কষ্ট, রাতভর মেডিক্যালের বিছানায় তোমার চিৎকার, মৃত্যু যন্ত্রনা আমার কানে বাজে। আমাদের অবুঝ বাচ্চাটা তোমার সে কান্না, তোমার আমার সে কষ্ট তখনো সে বুঝে না, তবু ফ্যাল ফ্যাল করে আমাদের চেয়ে চেয়ে দেখে। রাগে, কষ্টে, দুঃখে আল্লাহর উপর অনেক রাগ হতো আমার। নামাজ রোজা সবই করতে তুমি, এবাদত বন্দেগির কোনো কমতি তোমার ছিল না, কি সুন্দর কোরআন তেলাওয়াত করতে, কি সুন্দর করে হাদিস পড়ে শোনাতে আমাকে, তবু আল্লাহ তোমাকে কেন এত কষ্ট দিল।
মৃত্যুর তিন চারদিন আগে তুমি কাউকে চিনতে না। কাউকে বুঝতে না, আমি তখন আর ঘরে থাকি না, কিছুই সহ্য হয়না আমার। আমি বাইরে বাইরে পালিয়ে বেড়াই। হঠাৎ হঠাৎ তোমার কাছে গেলে তুমি বেঘোরে আমার হাত, জামা খামচে ধরতে— যেন তুমি বা আমি না পালাতে পারি...। তখনো আমার মনে স্বপ্ন আল্লাহ তোমাকে অবশ্যই ফেরাবেন। মনে মনে বলি, দরকার হলে আমাকে নিয়ে তোমাকে ফেরাক, আমার বাচ্চার মাকে ফেরাক, আমার ভালবাসাকে ফেরাক...।
সব ফেলে সত্যি তুমি উড়াল দিলে ওই আকাশে। ভালো থেকো আকাশের সবটুকু নীল গায়ে মেখে, ভালো থেকো সূর্যের হাসি তোমার ঠোঁটে এঁকে। ২০০৩ এ একটা কাঁথা শেলাই করে দিয়েছিলে আমাকে তুমি নিজ হাতে। সে কাঁথা গায়ে দিয়ে এখন আমি তোমাকে আঁকছি কাগজে কলমে আজ এত বছর পরেও….
আরএ/