ইরানে আদিবাসী আর্মেনিয়দের বড়দিন পালন
ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় প্রদেশ ইসফাহরানের আদিবাসী আর্মেনিয়দের শহর ‘নিউ জোলফা’র ‘দি বেথেলহেম চার্চ’ নামের গির্জাতে সাফাদিভ কালে (১৫০১ থেকে ১৭৩৬ সাল) বড়দিন ও এপিফানি (খ্রিস্টধমে দীক্ষাদান উৎসব) পালিত হত। তারা এখন আর্মেনিয়ান-আমেরিকান সম্প্রদায়, যারা প্রাচ্যদেশীয় অর্থডক্স খ্রিস্টরীতি অনুসরণ করেন। গেল ৬ জানুয়ারি তারা বেথেলহেম গির্জায় একই সঙ্গে বড়দিন ও এপিফানি পালন করেছেন। ইরানের দক্ষিণাঞ্চল এবং ইসফাহরান প্রদেশের খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মযাজক বিশপ ফাদার শিপন খাসজিয়ান এই উৎসব ও ধর্মীয় রীতিগুলো পালনে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন।
উৎসবগুলোতে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়েছে। আরো ছিল-পবিত্র বারি সিঞ্চন, খ্রিষ্টধর্মে শিশুদের দীক্ষাদান, রোগাক্রান্তদের রোগ মুক্তির জন্য বিশেষ প্রার্থনা এবং করবগুলোতে চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে থাকা খ্রিস্টানদের আত্মার জন্য প্রার্থনা। সব খ্রিস্টানদের নিয়ে বড়দিন এবং এপিফানির ধর্মীয় নিয়মগুলোও পালন করা হয়েছে।
এপিফানির উৎসবের নিয়মানুসারে শিশু প্রভু যিশুকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার নিয়মে একটি ক্রুশ প্রধান ধর্মযাজকের আর্শীবাদ নিয়ে পানিতে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
ইসফাহরান প্রদেশের সবচেয়ে সুন্দর গির্জাটিই হলো ‘দি বেথেলহেম চার্চ’। এছাড়াও এই গির্জাতেই আছে ইসফাহরানের আদিবাসী আর্মেনিয় খ্রিস্টানদের নিউ জোলফা নামে খ্যাত ১৬টি গির্জার মধ্যে সবচেয়ে বড় খ্রিস্টান কবরস্থানটি।
‘দি বেথেলহেম চার্চ’ নির্মাণ করেছেন খাজেশ পেত্রোস ভেলিজানিয়ান নামের একজন বিখ্যাত আদিবাসী খ্রিস্টান বণিক। তিনি আধুনিক ইরানের যাত্রা শুরু করে দেওয়া সাফাভিদ কালের মানুষ। ইরানের সাফাভিদ অঞ্চলের শাসক, শাহ আব্বাস-১ রাজার রাজত্বকালে (১৫৮৮ থেকে ১৬২৯ সাল) পেত্রোস সেখানে ছিলেন। তার গড়া গির্জাটির পাশে আছে আরও দুটি ঐতিহাসিক গির্জা।
শাহ আব্বাস-১ তার দীর্ঘরাজত্বকালে খ্রিস্টানদের আদিনিবাস থেকে এই দলটিকে জোলফা নামের উত্তর সীমান্তের শহরটি থেকে একটি গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই গ্রামটি এখন ‘নিউ জোলফা’ নামে বিখ্যাত। তিনি তাদের মধ্যে নানা ধরণের গুণাবলী পেয়েছিলেন। পরে এই খ্রিস্টানরাই বণিক, উদ্যোক্তা, শিল্পী হিসেবে গড়ে উঠেছেন। তিনি তাদের ধর্মীয় জীবনযাপন ও আচারের নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন।
এই আদিবাসী খ্রিস্টান আর্মেনিয়দের দোতলা ‘দি বেথেলহেম চার্চ’। তাদের গির্জার বিশেষ দ্রষ্টব্য হলো তার আয়তকার ঐতিহাসিক গম্বুজ। এর দুটি দিক আছে। দুটিই সোনায় মোড়ানো, তাতে বিভিন্ন গুরুত্বপূণ দিবসগুলো খোদিত আছে। গির্জার ভেতরের দেওয়ালগুলো প্রাচীনামলের বিশেষ প্লাস্টার করা। সেগুলোতে উৎকীর্ণ আছে পবিত্র বাইবেলে বর্ণিত নানা বিষয়ের চিত্রমালা। বিশেষভাবে রয়েছেন ১২ জন সাধু এবং প্রভু যিশুর পুণরুত্থানের প্রাচীন চিত্রশিল্পীর চিত্রমালা। সবই এখন ঐতিহাসিক মর্যাদা লাভ করেছে।
ইরানের কিছু প্রদেশে বড়দিনের ১২টি বিশেষ দিন প্রভু যিশুর জন্মদিন পালনের মাধ্যমে শুরু হয়। এভাবে তারা বড়দিন পালন শুরু করেন। ২৫ ডিসেম্বর থেকে প্রভুর জন্ম থেকে ‘ফিস্ট অব এপিফানি’ বা এপিফানির ভোজের মাধ্যমে ৬ জানুয়ারি তাদের বড়দিনের উৎসবমালা সম্পন্ন করেন। ফলে এই নতুন বছরের ৬ জানুয়ারি শিশুদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষাদানের মাধ্যমে বড়দিন পালিত হলো, যেটি আদিবাসী আমের্নিয় খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব।
এবারের ৫ জানুয়ারি রাত থেকে পরদিন ৬ জানুয়ারি বিশেষ ধর্মীয় উৎসব ও রীতিগুলো সম্পন্ন করেছেন তারা। এর মধ্যে পবিত্র জল ও তেল মিশিয়ে দর্শনাথী ও খ্রিস্টানদের মধ্যে বিতরণ, ধর্মীয়ভাবে বিশুদ্ধ পানি অসুস্থদের পান করানো ও পোশাক পবিত্রকরণ।
আর্মেনিয় খ্রিস্টানদের রীতি অনুসারে তারা বড়দিনের আগের রাত কাটিয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অথবা যাকে ভালোবাসেন তার সঙ্গে, রাতের আগে বা কেউ সম্প্রতি মারা গিয়েছেন তার আত্মার শান্তি কামনায় ও গির্জাতে।
সরকারি হিসেবে আনুমানিক দেড় লাখ খ্রিস্টান ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানে বসবাস করেন। তারা আর্মেনিয় ও অ্যাসিরিয়ানস বা অ্যাসিরিয়াবাসী। ‘প্রভু যিশুর জন্মদিন’-পালন করেন অ্যাসিরিয়ানস খ্রিস্টানরা। ‘ফিষ্ট অব এপিফানি’ বা ‘এপিফানির ভোজ’ পালন করেন আর্মেনিয় খ্রিস্টানরা। আর বড়দিন তারা দুই ধরণের খ্রিস্টানরাই একত্রে এই বহু প্রাচীন রীতি পালন করেন।
ওএফএস/এএস