নিউ ইয়র্ক সিটি কাউন্সিলম্যানের উপর 'বাংলাদেশিদের গোস্বা'
নিউ ইয়র্কের জামাইকায় লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ উদ্বোধনের পর কুইন্সের ডিস্ট্রিক্ট-২৪ এর কাউন্সিলম্যান জিম জিনারিও'র উপর গোস্বা করেছেন জ্যামাইকার বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতারা।
গোস্বার কারণ গত ১ ফেব্রুয়ারি লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে তিনি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেছেন। এ বিষয়টি নিয়ে তার অফিসে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানাতে যেতে চান বাংলাদেশি কমিউনিটির সিনিয়র নেতারা।
কাউন্সিলম্যান জিম জিনারিওর সঙ্গে দেখা করে কমিউনিটির নেতারা তুলে ধরতে চান গত ২১ ফেব্রুয়ারি লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশিদের সম্পর্কে তিনি যে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেছেন, তা সঠিক নয়। কারণ বাংলাদেশিরা বিশৃঙ্খল কোনো জনগোষ্ঠী নয়। বাংলাদেশিরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ধারণ করে। বাঙালির রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। বাংলাদেশিরা ডিসিপ্লিন ইমিগ্র্যান্ট। বাংলাদেশি আমেরিকানরা এখানকার শিক্ষা খাত থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। জিম জিনারিও লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে সেখান থেকে বাংলাদেশিদের বের হয়ে যেতে বলায় বাংলাদেশি আমেরিকানরা অপমানিত হয়েছেন। কারণ বাংলাদেশিরাও এখানে আমেরিকান নাগরিক। তারা কোনো অংশেই আমেরিকান নাগরিকদের চেয়ে কম নন। বাংলাদেশিদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য তার কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে ধরা হবে। এসব তথ্য তুলে ধরেছেন কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব নাসির আলী খান পল, আসালের সভাপতি মাফ মিসবাহ, মূলধারার রাজনীতিক মোর্শেদ আলম ও জেএমসির সাবেক সভাপতি আওয়াল সিদ্দিকী। সাম্প্রতি জ্যামাইকার হিলসাইডে একটি ক্যাফেতে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সেখানে ২১ ফেব্রুয়ারি লিটল বাংলাদেশ এভিনিউর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনা তুলে ধরেন এবং এর পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সাংবাদিকদের অবহিত করেন। পাশাপাশি লিটল বাংলাদেশ এভিনিউর অনুষ্ঠান সফল করার জন্য যারা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই সাতজনকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারা হলেন মোহাম্মদ তুহিন, মোহাম্মদ আলী, রাব্বী সৈয়দ, ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার, বাহলুল সৈয়দ উজ্জ্বল, রেজাউল করিম চৌধুরী ও ড. দিলীপ নাথ। নেতারা সেদিনের অনুষ্ঠানে যে সমন্বয়হীনতা ছিল, তা তুলে ধরেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠান হলে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় এবং বাংলাদেশিদের যাতে সেখানকার কোনো জনপ্রতিনিধি অপমান করার সুযোগ না পান, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্য সবার প্রতি নেতারা আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশি কমিউনিটির বিপুলসংখ্যক নেতা উপস্থিত ছিলেন। নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সাংবাদিকেরাও উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতারা ঐকমত্য পোষণ করে বলেন, আমরা যারা এখানে আছি, তারা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের একেকজন অ্যাম্বাসেডর। তাই আমাদের এমনভাবে কাজ করতে হবে, যাতে আমাদের কারো কারো মধ্যকার অনৈক্যের কারণে সাফল্যের বিষয়টি ম্লান হয়ে না যায়। এবং আগামীতে এ ধরনের কোনো অনুষ্ঠান হলে সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে আমরা যেন তা সফল করতে পারি। পাশাপাশি তারা সেদিনের অপমানের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী ২০২৩ সালের সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে ডিস্ট্রিক্ট-২৪ থেকে বাংলাদেশি একক প্রার্থী দাঁড় করানো ও তাকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে একমত হন। নেতাদের মতে, এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বাংলাদেশি প্রার্থীকে বিজয়ী করা সম্ভব, অন্যদিকে জিম জিনারিওর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়াও সম্ভব।
উল্লেখ্য, গত ২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে বাংলাদেশি অধ্যুষিত নিউইয়র্কের জ্যামাইকার হিলসাইডের ১৬৯ স্ট্রিট থেকে একটি অংশের নামকরণ করা হয় ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’। এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কমিউনিটির নেতাদের অনৈক্যের সুযোগে কাউন্সিলম্যান জিম এফ জিনারিও পুরো কমিউনিটিকে অপমান করেছেন বলে অভিযোগ এনেছেন সিনিয়র নেতারা।
স্বাগত বক্তব্য দেন অনুষ্ঠানের আয়োজক ও বিশিষ্ট রিয়েল এস্টেট ইনভেস্টর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, একুশে ফেব্রুয়ারি ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুরো কমিউনিটি অপমানিত হয়েছে। অব্যবস্থাপনা আর বিশৃঙ্খলাপূর্ণ না হয়ে অনুষ্ঠানটি সুন্দর ও সার্থক হতে পারত। কমিউনিটির অনৈক্যের কারণেই এই ব্যর্থতা। তাই আগামী দিনে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি বা অনৈক্য নয়, মূলধারার রাজনীতিতে যাতে বাংলাদেশিদের পথ সুসংহত হয়, তারই প্রেক্ষাপট তৈরির জন্য আজকের এই অনুষ্ঠান। তিনি বলেন, আগামী দিনে সিটি কাউন্সিলে আমরা আরো শাহানা হানিফ চাই। নিউইয়র্ক সিটির কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট ২৪ থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশিই আমাদের মূল লক্ষ্য।
কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব নাসির আলী খান পল বলেন, লিটল বাংলাদেশ এভিনিউর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যা হয়েছে, সে জন্য কাউকে ব্লেম দিচ্ছি না। সেদিনের ঘটনায় বাংলাদেশ কমিউনিটি, বাংলাদেশ, দেশের পতাকা অপমানিত হয়েছে। আমাদের অনৈক্য আর নেতৃত্বের ব্যর্থতাই এ জন্য দায়ী। আমরা আলোচনা করে একটি দিন ঠিক করে জিনারিওর অফিসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে যাব। তার সঙ্গে দেখা করে পুরো বিষয়টি জানাব। তবে সেদিন কী হয়েছে সেটা আজকের বিষয় নয়, আগামী দিনে যাতে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি না হয় এবং বৃহত্তর স্বার্থে আমরা কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, সেটাই মূল বিষয়। তিনি বলেন, আজকের বাংলাদেশি কমিউনিটি একদিনে গড়ে ওঠেনি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কমিউনিটি সমৃদ্ধ হয়েছে। তাই কমিউনিটির মান-সম্মান আমাদের মান-সম্মান। এ জন্য ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
মোর্শেদ আলম বলেন, আমরা দেশে রাজনীতি করেছি বলেই প্রবাসজীবনে এসে কমিউনিটি অ্যাকটিভিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছি, যাতে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি। আমরা বড় কমিউনিটি কিন্তু ঐক্যবদ্ধ নই। দু-চারজন ভুল করতে পারেন, সে জন্য সবাইকে একতরফাভাবে হেয় করা ঠিক হয়নি। আগামী দিনে যাতে কমিউনিটির মধ্যে আর অনৈক্য দেখা না দেয়, সে জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
মাফ মিসবাহ উদ্দিন বলেন, সেদিনের অনুষ্ঠানটি একটি কমিটি করে সুন্দরভাবে করা যেত। শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু সেখানে ফুল দেওয়া হয়নি, এটা দুঃখজনক। এমন একজনের হাতে পতাকা দেওয়া হয়েছে, যিনি বাঙালি নন। বাংলাদেশি আমেরিকানদের দিয়ে গান করালে ভালো হতো। তিনি বলেন, সময় এসেছে বাংলাদেশি কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। আমাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা আর অনৈক্যের কারণে আমরা নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
আওয়াল সিদ্দিকী বলেন, ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যা হয়েছে, তার আর পুনরাবৃত্তি হতে দেওয়া যাবে না। কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ অর্জন কমিউনিটির বড় পাওয়া। প্রয়োজনে আমরা আবার একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করে এই অর্জন সেলিব্রেট করতে পারি।
বাহলুল সৈয়দ উজ্জ্বল বলেন, আজকের লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ কারো একার অবদান নয়। এ জন্য সব বাংলাদেশিই কৃতিত্বের দাবিদার।
কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট এবং জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার অনুষ্ঠানটি আয়োজনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ নামকরণ অবশ্যই একটি বড় অর্জন। তবে এই সম্মান একদিনে কিংবা একজনের চেষ্টায় অর্জিত হয়নি। তিনি অনুষ্ঠানটির সব ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তিনি বলেন, ২০ বছর আগের একটি উত্তরীয় জিম জিনারিওকে দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল, সেটি তখন দিতে পারিনি। এবার দিয়েছি। তাকে ক্রেস্ট উপহার দিয়েছি। এখানে তাকে চাইলে অন্য সংগঠনও ক্রেস্ট, উত্তরীয়, ফুল দিতে পারত, কোনো সমস্যা ছিল না। আমি যা কিছু করেছি অনুষ্ঠানটি সফল করার জন্য করেছি। কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না। দেলোয়ার আরও বলেন, লিটল বাংলাদেশ এভিনিউর সাইনটি ভুল দিকে অ্যারো সাইন করে লাগানো হয়েছে। আসলে এটি হোমলন স্ট্রিট নয়, হিলসাইড এভিনিউই ‘লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ’ নামে প্রতীকী নামকরণ করা হয়েছে। বিষয়টি কাউন্সিলম্যান জিম এফ জিনারিওকে অবহিত করা হয়েছে। অচিরেই এটি ঠিক করা হবে।
মোহাম্মদ তুহিন বলেন, সবার অবদানের ফসল আজকের লিটল বাংলাদেশ এভিনিউ। তাই একে অপরের দোষ-ত্রুটি ধরে পেছনের দিকে নয়, আমাদের সামনের দিকে এগোতে হবে।
অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আলী বলেন, আমাদের আগামী দিনের টার্গেট আসন্ন নির্বাচনে ডিস্ট্রিক্ট-২৪ থেকে বাংলাদেশি-আমেরিকানকে নির্বাচিত করা। সেই লক্ষ্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
রাব্বী সৈয়দ বলেন, অনুষ্ঠানটি আয়োজনে আমাদের ব্যর্থতা রয়েছে সত্য, তবে তা ইচ্ছাকৃত নয়। আগামী দিনে যাতে সফলভাবে অনুষ্ঠান করতে পারি ও ঐক্য ধরে রাখতে পারি, সে ব্যাপারে আমাদের সচেষ্ট থাকতে হবে।
অনুষ্ঠান শেষে নাসির আলী খান পল লিটল বাংলাদেশ এভিনিউর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজনে যে সাতজনের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল, তাদের একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তা নিরসন করেন।
আরএ/