আলতাব আলী পার্ক
এটি ‘আলতাব আলী পার্ক’, এখন যেভাবে আছে, তেমনটি রয়েছে ১৯৯৮ সাল থেকে। তার আগে একে বলা হতো “সেন্ট মেরি’জ পার্ক”। এই জায়গাটি ১৪ শতকের একটি সাদা গীর্জার, তাকে ডাকা হতো সেন্ট মেরি’জ। স্থানীয়রা সাদা গীর্জার মাধ্যমে পার্ককেও এই নামে বলতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ১৯৪০ সালে এখানে বিদুৎ গতিতে বোমাবষণ করা হয়েছিল। এই উল্লেখযোগ্য কীর্তিটিও আছে ঐতিহাসিক গীর্জাটির গায়ে। যুদ্ধ শেষ হবার কয়েক বছরে পর থেকে গীর্জাটির ঘন্টাধ্বনির ধর্মঘট শুরু হলো। এরপর তো থেমেই গিয়েছে। ফলে এখন কয়েকটি সমাধি পাথরই অবশিষ্ট আছে। যেখানে শুরু আছেন নানা বয়সের খ্রিস্টান মানুষরা।
এই ব্রিটেনে কঠোর অভিবাসন আইন চালু হলো ষাটের দশক থেকে এবং পরের দশক এই ভাবনাটির বৈধতা দিলো যে, স্পিটালফিল্ডসে নতুন বসতি স্থাপন করা বাঙালিরা এই জায়গাটির অন্তর্গত নন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জারি হলো তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তাতে অভিবাসীরা আক্রমণের একটি সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে গেলেন এবং তাদের সবকিছুর জন্য দায়ী করা যেত।
১৯৭৮ সালে সত্যিকারের রক্ত এই পার্কে ঝরেছে। ৪ মে স্থানীয় রাজনীতিগুলো অনুষ্ঠিত হওয়ার সন্ধ্যায়, মাগারেট থ্যাচার ক্ষমতায় আসার আগের ক্ষণে, সেই দিনটিতে; স্থানীয় একজন বস্ত্রকলের শ্রমিক, যার নাম আলতাব আলী; জন্মেছেন বাংলাদেশে; খুন হয়েছিলেন একটি বর্ণবাদী আক্রমণে। এরপর তিনি পড়েছিলেন একটি রক্তের পুকুরে হোয়াইট চ্যাপেল রোডে। তিনি হানবুরি স্ট্রিটে কাজ করতেন, ব্রিক লেন থেকে সামান্য দূরে। এই পার্ক পেরিয়ে ক্যানন স্ট্রিটে গেলে তার বাসা। বাসার দিকে যেতেই তিনি একদল বর্ণবাদীর আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। যখন তিনি মারা যান বয়স ছিল মোটে ২৫ বছর। তিনজন কিশোর সন্ত্রাসী তাকে বাড়িতে কাজ সেরে ফেরার সময় খুন করেছিল।
বাস্তবে, পুরো সত্তর জুড়ে বাঙালি সমাজের প্রতি বর্ণবাদী আক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল। তাদের বাড়ির দিকে ইট পর্যন্ত ছুঁড়ে মারা হতো-এতটাই ঘৃণার পাত্র হয়ে গিয়েছিলেন তারা। মানুষ, পশুর মল তাদের দরজাগুলোতে লাগিয়ে দেওয়া হতো। গালাগাল, হামলা চলতো জনে-জনে। ফলে প্রতিটি বাঙালি পরিবারই যত দ্রুত সম্ভব তাদের সারাজীবনের সাধনার বাড়িঘর ফেলে অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য হতেন।
রাজনীতিবিদরা ও স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো এই সহিংসতার জন্য বেশিরভাগ খোঁচা দিয়েছে উগ্র-প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয় ফ্রন্টের স্কিনহেডদের। এই স্কিনহেডরা আসলে লন্ডনের শ্রমজীবি তরুণের দল। দ্বিতীয় শ্রেণীর এই মানুষদের আন্দোলন পরে সারা বিশ্বে কম, বেশি ছড়িয়ে গিয়েছিল। তারা এছাড়াও অভিবাসীদেরও দোষ দিয়েছিলেন সাদা চামড়ার মানুষদের সঙ্গে না মেশার আগ্রহকে। এমনকি তারা পুলিশ যখন তাদের পরিবারগুলোর নিরাপত্তার জন্য বাড়িতে প্রয়োজনে আগুন জ্বালানোর মাধ্যমে জানানোর প্রস্তাব দিয়ে নিরাপদে রাখার নিশ্চিয়তা দিয়েছিল; সেসবও ভালোভাবে গ্রহণ না করার দোষে দুষেছে। এই কৈফিয়তগুলো অবশ্যই কেবলমাত্র লুকিয়ে রেখেছিল মূলধারাকে বলির পাঁঠা হওয়া থেকে, তাতে ষাটের শেষেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর গম্ভীর গর্জন প্রশমিত না হয়ে বিস্ফোরিত হয়েছে এবং মন্দাও আঘাত করেছে ব্রিটেনকে।
শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর নেতারা ও টিইউসি (ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস) অভিবাসীদের বের করে দেওয়ার জন্য কড়া পরিমাপন দাবী করেছিলেন। তারা সরকারের ব্যর্থতার কথা না বলে বা সেদিকে তত মনোযোগ না এনে কালো ও এশিয়দের কম দামে আরো বেশি কাজের জন্য নিয়ে সাদাদের চাকরি থেকে বের করে দেওয়ার হিড়িকের দৃষ্টিভঙ্গিটির দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করছিলেন। বেশি শ্রমিক কম কাজ আছে-এমন একটি অবস্থায় বেপরোয়া ছুটে চলছেন, এই ধারণাটিও ব্রিটেনে জনপ্রিয় হয়ে গেল। এই সময় ব্রিটিশদের চাকরি ব্রিটিশদের জন্য-এটি জনপ্রিয় শ্লোগানেও পরিণত হয়ে গেল। মতবাদগুলো সেই দেশের ভূমিতে সহিংস বর্ণবাদী আক্রমণগুলোকে অনুপ্রাণিত করেছে।
৭০’র দশকের মধ্যভাগে বর্ণবাদবিরোধীদের ছায়ায় দি এশিয়ান ইয়ুথ মুভমেন্টের, স্থানীয় তরুণদের কয়েকটি আন্দোলন হয়ে গেল। সেগুলো এই বিশ্বাস এনে দিল-নিজেদের রক্ষা তাদেরই করতে হবে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের মৌলবাদী কালোদের সংহতি আন্দোলনগুলোর ধারণা থেকে উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। এরপর তারা বর্ণবাদীদের কাছ থেকে রাস্তাগুলো পুণরুদ্ধার করতে কাজ করেছেন। হোয়াইট চ্যাপেল রোডে ও ব্রিক লেনে যখন বর্ণবাদীরা বাঙালিদের দোকানগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিতে গেলেন, তখন বাঙালি যুবক, এশীয় তরুণ ও বণবাদবিরোধী ব্রিটিশরা তাদের মুখোমুখি হয়ে গেলেন। ব্রিটেনের ইতিহাসের এই পর্বে সম্পদ আসলে কোনো অথ বহন করতে পারেনি, এই কালে বর্ণবাদবিরোধীতা মানে হলো, আপনি কেবল একটি জাতে বিশ্বাস করেন, সেটি ‘মানবতাবাদ’। বণবাদবিরোধীরা মৌলবাদীতার সঙ্গে তাদের পার্থক্যগুলো মানুষের কাছে প্রচারণায় নিয়ে এসেছিলেন। কেবল তাই নয়, তারা যেকোনো ও সব ধরণের বৈষম্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন স্বোচ্চারভাবে; দাবী তুলেছেন, সব মানুষের জন্য; তার গায়ের রঙ, পেশা; দেশ; অবস্থান; নাগরিকতার সার্টিফিকের উধ্বে উঠে সবার জন্য সমান চিকিৎসার; আর যখন এটি চাকরি ও মজুরির প্রশ্ন হলো-এই তারুণ্যের শক্তি সাদা, কালো ও এশিয় নাগরিকদের জন্য সমভাবে বন্টনের দাবী করেছেন।
আলতাব আলীর হত্যাকাণ্ডের পর তার কফিন একটি লম্বা ও দীর্ঘ শোক যাত্রার মাধ্যমে নিয়ে আসা হলো হোয়াইট হলের পথ ধরে। হোয়াইট হল আছে লন্ডনের কেন্দ্রের ওয়েষ্ট মিনিস্টার শহরের একটি রাস্তা। তাতে ছিলেন ও প্রতিবাদ করেছেন হাজার হাজার এশিয় তরুণ, তরুণী এবং ব্রিটেনের বর্ণবাদবিরোধীরা। তারা তখন তুলে ধরেছেন, এই ক্ষোভ ও উত্তাপ নতুন সরকারের পতন ঘটিয়ে দিতে পারে, কেননা বর্ণবাদী আক্রমণগুলো থেকে এখন যেকোনো কিছুই সম্ভব। আবার পুলিশের একটি অবস্থায় বর্ণবাদী আচরণ ও অভিবাসীদের দেশগুলোর সরকারদের তাদের নাগরিকদের জন্য অপরাধ করার সুযোগ নেওয়াও বিচিত্র নয়। এই ধারণাগুলো মিথ্যে নয়।
আবার এ এমন গণ সংহতি, যেটি স্থানীয় বর্ণবাদবিরোধীদের, সেটি ব্রিক লেনে বড় আকারের বণবাদী কমকাণ্ডকে বেড়ে উঠতে দেয়নি। সেগুলোকে দমিয়ে দিয়েছে। যদিও স্থানীয় এলাকায় সহিংসতা চলেছে। পরের দশক ১৯৮০ তেও দাঙ্গার ভয় থেকেছে বলে অবশেষে এই সময়ে ব্রিটেনের বিভাজনকারী, মানুষের কাছ থেকে মানুষকে আলাদা করে দেওয়া বর্ণবাদী রাজনীতিবিদ ও দলগুলোকে এবং তেমন ধারণার মানুষদের আগের যুগ, যেটিতে আলতাব আলী মারা গিয়েছেন; সেটি থেকে মৌলবাদের একটি নব দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আলতাব আলীকে সম্মানিত করেছেন ব্রিটেনের সরকার ও সাধারণ মানুষ তার নামে পাকটি করে। ছোট্ট এই পার্কটি আছে ১০, অ্যাডলার স্ট্রিট, হোয়াইট চার্চ লেন ও হোয়াইট চ্যাপেল রোডের মাঝে; লন্ডন ই ১-এ। এখানে শুয়ে আছেন রিচাড পার্কার, রিচাড ব্রানডন, স্যার জন কাস, স্যার জেফরি ডানস্ট্যান (এই পরচুলা বিক্রেতা ১৮ শতকে ব্রিটেনের নির্বাচনী আনন্দ শোভাযাত্রা বা কার্নিভালের মাধ্যমে মুখে, মুখে নির্বাচিত করার সময়-গ্যারেট নামে পরিচিত; তাতে ‘গ্যারেট’ মেয়র হয়েছিলেন)।
১৯৯৮ সালে এই সেন্ট মেরি’জ পাকের নাম রাখা হয় আলতাব আলীর নামে-‘আলতাব আলী পাক’। সেই মানুষটিকে স্মৃতিতে রাখা হলো চিরদিনের জন্য। ইস্ট এন্ডে আলতাবকে মারা হয়েছে, যেখানে এর চেয়ে কম সহিংসতার অনেক আক্রমণ ঘটেছে। পার্কের প্রবেশ পথে একটি খিলান আছে, সেটি বানিয়েছেন ডেভিড পিটারসেন; তৈরি করেছেন বর্ণবাদী আক্রমণগুলোতে আলতাব ও অন্য শিকারদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। খিলানটিতে বাঙালি স্টাইলও আছে। তাতে পূর্ব লন্ডনের নানা ধরণের সংস্কৃতিও একত্রে চলা ফুটেছে। রবীন্দ্রনাথের অমর উক্তি খোদিত আছে। আছে লন্ডনের বাঙালিদের একুশের শহীদ ও বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অর্ঘ্য একটি শহীদ মিনার। পাশেই আছে পাতাল রেল সড়ক।
বর্ণবাদের শিকার শহীদ আলতাব আলীর নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বা ৫০ বছর উপলক্ষে লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিল একটি বিশেষ ভবন উৎসগ করেছেন। তার নামে ভবনটি আছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ, ওমর শাহেদ; ২৫-১-২০২২।