‘মানুষের ভেতরের শক্তিকে কখনো দুর্বলভাবে দেখবেন না’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষ্যে ব্রিটেনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল পাঁচ বিশিষ্ট অভিবাসী বাংলাদেশীর নামে সেখানে পাঁচটি ভবনের নামকরণ করেছে। তাদের অন্যতম সমাজসেবক তাসাদ্দুক আহমেদ এমবিই। এই মানুষটি কে ছিলেন? কেমন ছিলেন?
১৯৬০ সালে, জার্মান স্ত্রী রোজমেরিকে নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মী তাসাদ্দুক আহমেদ প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দেশের ডাক’। এটিই বাঙালিদের জন্য ব্রিটেনে প্রথম প্রকাশনা। চার বছর পর আয়-রোজগারের প্রাথমিক পরিকল্পনা নিয়ে এই দম্পতি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘দি গাঙ্গেজ’। সোহোর জোরার্ড স্ট্রিটের রেস্তোরাটি তার সময়ে লন্ডনের সবচেয়ে ভালো ও নামকরা রেস্তোরাগুলোর অন্যতম ছিল। তারা তৈরি করেছিলেন ‘দি গুড ফুড গাইড’। ব্রিটিশ-বাঙালি রেস্তোরা ব্যবসায়ীদের বিশ্বখ্যাত ‘তন্দুরি ওভেন’র ভবিষ্যত গড়ে দেওয়া প্রথম দিকের ভালো রেস্তোরাগুলোর অন্যতম এটি।
‘দি গাঙ্গেজ’ পরে চলে গিয়েছিল পেডিংটনে। সেখানে এটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আসা মানুষদের আলোচনার আশ্রয়স্থল। রাজনীতিবিদ, কবি ও ব্রিটিশ রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তনের কমীরা সাম্প্রতিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতেন। আর তারা বাংলাদেশের জন্য নানা পরিকল্পনা করতেন। যে দেশটির জন্ম হয়েছিল অনেক পরে-১৯৭১ সালে। তারা রেস্তোরাটিতে, ব্রিটেনের রাজধানীর সবচেয়ে ভালো এশিয়ান খাবারগুলোর কিছু খেতেন। এভাবে তাদের আলোচনাগুলো উন্নতিও লাভ করতো। এই খাবারগুলোর মেন্যু তৈরি করেছিলেন ও রেস্তোরাটি চালাতেন সমাজের ভালো করতে চাওয়া একজন মানুষ; তিনি ও তার স্ত্রী একটি পত্রিকার প্রকাশক। আকর্ষণীয়ভাবে সেসব ভাবনা, অঙ্গীকার ও আলোচনাগুলো তারা তাতে ছাপতেন। তাদের সংগঠনের অভ্যন্তরীন বুলেটিনেও তেমন আকর্ষণীয়ভাবে ছাপানো হতো।
এই সব কাজের প্রাণ যে মানুষ, তিনি ১৩ জন ভাইবোনের সবার বড়। বিরাট সেই পরিবারের বড় ছেলেটির জন্ম হয়েছিল ভারতবর্ষের আসামে; তারা মধ্যবিত্ত ছিলেন। এই ছেলেটির ভেতরে রাজনীতির প্রতি তুমুল আগ্রহের জন্ম হলো ধাপে, ধাপে, বিশ্রামহীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। এরপর সিলেটে কলেজে পড়ার সময় তিনি ‘অল আসাম মুসলিম লীগ স্টুডেন্টস ফেডারেশন’র মহাসচিব হলেন। তাসাদ্দুক আহমেদ গণভোটে সিলেট পূর্ব পাকিস্তানে যোগ দেবার জন্য প্রচারাভিযান করেছেন। সেটিই হয়েছে। এরপর তো বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশ হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান।
তবে কেবল রাজনীতি নিয়ে পড়ে থাকেননি তিনি, লেখাপড়া করেছেন ভালোভাবে। গ্রাজুয়েশনের পর তাসাদ্দুক চলে এলেন রাজধানী ঢাকায়। এখানেই কর্মজীবনের শুরু হলো তার। ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্রগুলোতে সাংবাদিক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন তিনি। তবে তখন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধানত সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষার মানুষরা পশ্চিম অংশের ব্যাপকভাবে উর্দু ভাষাভাষীদের কাছ থেকে নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। তাদের অধিকারগুলো উপেক্ষিত হচ্ছিল। পশ্চিম-পাকিস্তানভিত্তিক সরকার নানাভাবে তাদের বঞ্চিত করছিল। এরপর তাসাদ্দুক কমিউনিজমের দিকে চলে গেলেন। তবে তার নামে একটি গ্রেফতারি পরোয়ারা হচ্ছে জানতে পেরে ১৯৫২ সালে পালিয়ে চলে গেলেন লন্ডনে।
প্রথমে লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিলে একজন ল্যাবরেটরি টেকনেশিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন। তবে তার মৌলিক আগ্রহ পড়েছিল রাজনীতিতে। তাসাদ্দুক আহমেদ ‘দি পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানে। নতুন ও কেবল শুরু হওয়া বাংলা ভাষার আন্দোলনের একজন প্রধান সংগঠক হয়ে গেলেন। জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে তিনি বিশ্বাস করতেন, ভাষা সঠিকভাবে নির্ধারণ করে দিচ্ছে এমন একটি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও অনুশীলন; ধর্ম নয়। বাংলা ভাষার জন্য ১৯৫২ সালের আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের সমাপ্তি টানার পূর্ব লক্ষণ ও বাংলাদেশের উত্থানের কারণ-তার মনে হতো।
বিভিন্ন পরিকল্পনার অগ্রদূত ছিলেন তিনি। পাকিস্তান সরকার সেই দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেবার বিনিময়ে রপ্তানিকারকদের কমিশন দিয়েছিল। আহমেদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘অ্যাংলো-পাক এন্টারপ্রাইজেস’। যেটি লন্ডনের রান্নাঘরগুলোতে কাজ করা অভিবাসী শ্রমিকদের ও নামমাত্র মজুরিতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে বাধ্য হওয়া শ্রমিকদের অতিরিক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী লাভ প্রদান করেছিল। পরিপূরক হিসেবে তারা যেন তাদের পরিবারগুলোর কাছে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারেন সে ব্যবস্থাটি করেছে।
১৯৮২ সালে তার প্রিয়তমা স্ত্রী রোজমেরি মারা যান। ফলে গাঙ্গেজ বিক্রি করে দেন হতাশ ও বিষন্নতায় আক্রান্ত তাসাদ্দুক। চলে গেলেন ইস্ট এন্ডে; এটিই লন্ডনের বাংলাদেশীদের হৃদপিন্ড। এখানে তিনি বিপুল পরিমাণ সংগঠনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তার সবই স্বেচ্ছাসেবায়। ব্রাডে সেন্টার থেকে শুরু করে কাজ করেছেন স্পিটালফিল্ডস স্মল বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনে (এসএসবিএ)। ব্রাডে সেন্টার সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনা করতো আর এসএসবিএ স্থানীয় নামমাত্র শ্রমের মজুরদের কম ভাড়ায় আধুনিক বাসা-বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিত।
এসএসবিএ’র মাধ্যমে তাসাদ্দুক আহমেদ ব্রিটেনের যুবরাজ প্রিন্স চার্লসের একজন বন্ধু হয়ে গেলেন। তারা দুজনেই ইস্ট এন্ডের উন্নয়নের বিষয়ে একই ধরণের পরিকল্পনা করেছিলেন। সেগুলো বিনিময় করেছেন তারা। বিদ্যালয়গুলো থেকে ঝড়ে পড়াদের জন্য সেখানে একটি নৈশ বিদ্যালয় ছিল। নিজেদের সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অল্প বয়সের প্রজন্মটির জন্য ছিল ভাষা শেখার ক্লাসগুলো আর নারীদের জন্য ছিল একটি সামাজিক শিক্ষা কেন্দ্র।
বহু শিক্ষাক্রম এবং শিক্ষায় জোর দিয়ে তাসাদ্দুক আহমেদ বাঙালিদের যেমন বাংলাদেশী সমাজ থেকে বের করে আনতে পেরেছিলেন, তেমনি বাইরের মানুষদের এই সমাজের ভেতরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৯৮ সালে একটি স্ট্রোক হলো তার। মস্তিস্কের এই রোগে হঠাৎ তার চৈতন্য ও চলাফেরার শক্তি লোপ পেয়েছিল। তার আগ পযন্ত তিনি তার প্রতিদিন স্পিটালফিল্ডস ঘুরে বেড়ানোর কাজটি করে গিয়েছেন। এখানে কাজ করেছেন নিজের ভেতরের অসীম অনুপ্রেরণা, আশাবাদ, মানবতা ও ভালোবাসায়।
বলেছিলেন-‘একজন মানুষের ভেতরের শক্তিকে কখনো দুর্বলভাবে দেখবেন না।’ আরেকবার বলেছেন, ‘একজন দুজনে পরিণত হন ও আপনি বেশিদিন একা থাকেন না। দুজন সাতজনে পরিণত হন ও এটি একটি দলে পরিণত হয়। সাতজন ৭০ জনে রূপ লাভ করে ও এটি একটি আন্দোলনে পরিণত হয়। ফলে আপনি যা করতে চান, তার যেকোনোকিছুই করতে পারেন।’
এত গুণের তাসাদ্দুক আহমেদ একজন রেস্তোরা ব্যবসায়ী হিসেবেও খ্যাতিমান ব্রিটেনে। তবে প্রধান পরিচয় তিনি সে দেশে বাঙালি কমিউনিটির জন্য কাজ করেছেন।
তাকে ১৯৮৯ সালে একজন এমবিই (অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার) পদকে ভূষিত করা হয়। ২০০০ সালে দি ফ্রিডম অব টাওয়ার হ্যামলেটস সম্মাননা গ্রহণ করেন।
২০০১ সালের ২ এপ্রিল মারা গিয়েছেন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে, ৭৮ বছর বয়সে।
গার্ডিয়ান অবলম্বনে ২৫-১-২০২১।