স্থায়ী কনস্যুলেটের দাবি ৭ বছরেও পূরণ হয়নি মিশিগানবাসীর
আমেরিকার দ্বিতীয় বাংলাদেশি ঘনবসতিপূর্ণ স্টেট মিশিগান। নিউইয়র্কের পরই বাংলাদেশের মানুষ বেশি বসবাস করেন মিশিগানে। সেখানে বাংলাদেশি কনস্যুলেট অফিস প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘ দিনের। কিন্তু সেই দাবি আজও উপেক্ষিত। মিশিগান প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, মিশিগানে কনস্যুলেট অফিস স্থাপন করা হলে, সার্বিকভাবে বাংলাদেশিরা উপকৃত হবেন।
মিশিগানের ড্রট্রেয়েট হ্যামট্রামিক, ওয়ারেন, স্টাররিং হাইটস, ট্রয়, ডিযারবন, এন হারবার, শেলভি এই সব এলাকায় কমবেশি ৮০ থেকে ৯০ হাজার প্রবাসী বসবাস করেন। ইমিগ্র্যান্ট হিসাবে যারা বাংলাদেশ থেকে আসেন তারা প্রথমে কিছুদিন নিউইয়র্কে থাকেন তারপর সহজ জীবনযাত্রার শহর মিশিগানে বসতি স্থাপন করেন। বর্তমানে মিশিগান ছাড়াও নিউইয়র্ক এর একটি শহর বাফোলোতে অনেকেই যাচ্ছেন। তবে কাজের সহজলভ্যতা, জীবন যাত্রার স্বল্প ব্যায়, বাংলাদেশি ট্র্যাডিশনে থাকার নানা কারনে মিশিগান বর্তমানে সবার পছন্দ। মিশিগানে দশ-পনের মাইলের মধ্যে ৪৭ টি বাংলাদেশি গ্রোসারি রয়েছে। মিশিগানে প্রতি মাইলে একটি মসজিদ রয়েছে। বাংলাদেশি মালিকানাতে ২৫ টি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশি প্রবাসী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শতাধিক।
মিশিগানে 'বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ' সহ বর্তমানে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি প্রক্রিয়াধীন। সেখানে যে সকল প্রবাসীরা রয়েছেন তাদের মধ্যে ৫০ হাজারের মতো প্রবাসী বাংলাদেশি এখনও সবুজ পাসপোর্ট বহন করেন। এবং প্রতিদিন দুই-তিন শত প্রবাসী বাংলাদেশে ট্রাভেল করেন।
মিশিগানের কনান্ট স্ট্রীট সহ নানা জায়গায় মানি ট্রান্সফারের দোকান রয়েছে কম-বেশি ৩৭ টি। সেখান থেকে প্রবাসীরা যে পরিমান রেমিট্যান্স প্রেরন করেন তার একটি আনুমানিক পরিসংখ্যানে দেখা যায় শুধু মিশিগান থেকে বাংলাদেশি প্রবাসীরা প্রতি মাসে দেশে পাঠান ৬৫ কোটি টাকা।
তবে নানা উৎসবে সেটা ৭০/৭৫ কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। মিশিগানের বেশ কয়েকজন রেমিট্যান্স স্পেশালিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
মিশিগানে গ্রোসারির সংখ্যা ৪৭ টি। এর মধ্যে ৩৪ টি গ্রোসারিতে প্রতিদিন নুন্যতম এক হাজার থেকে দশ হাজার ডলার ট্রানজেকশন হয়ে থাকে। কনান্ট ট্রাভেল, টাকা মানি এক্সচেঞ্জ, কুইক সেন্ড, ওয়ালী এন্টারপ্রাইজ ও সোনালী একচেঞ্জসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রেমিট্যান্স প্রেরনে প্রথম সারির।
এদিকে 'সোনালী একচেঞ্জ' নামের সরকারী প্রতিষ্ঠানটি বিকাল ৪ টায় বন্ধ হয়ে যায়। আবার বেশিরভাগ সময় সেটা ৪ ঘন্টা খোলা থাকে। নানান কাগজপত্রের জটিলতায় সেখান থেকে দেশে টাকা পাঠাতে অনেকেই আগ্রহ দেখান না।
মিশিগানে কনস্যুলেটের দাবিতে মিশিগান প্রবাসীরা দীর্ঘ দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবি তারা দেশে বৈধভাবেই রেমিট্যান্স পাঠান ৬৫ থেকে ৭০ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও অন্তত ৩০ কোটি টাকা প্রবাসীরা নিজে বহন করে নিয়ে যান। সব মিলিয়ে দেশে মিশিগান থেকে প্রতিমাসে রেমিট্যান্স আসে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
মিশিগানের ৯০ হাজার প্রবাসীদের মধ্যে ২০০ থেকে ৩০০ প্রবাসী প্রতিদিন বাংলাদেশে ভ্রমন করছেন। মাসিক হিসাবে ৫/৬ হাজার প্রবাসী মিশিগান থেকে বাংলাদেশ ভ্রমনকালীন সময়ে নিজে বহন করেন নুন্যতম পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজার ডলার। নন ডিক্লারেশনে দশ হাজার বহন করা যায়।
গত দুই সপ্তাহ নানা মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিমাসে মিশিগান থেকে ১০০ কোটি টাকা বাংলাদেশে রেমিটেন্স হিসাবে যাচ্ছে।
অনেক প্রতিষ্ঠান নিরাপত্তা জনিত কারনে সঠিক তথ্য দিতে চান নি। তবে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তিনি মাসে এক থেকে দেড় মিলিয়ন ডলার প্রেরন করে থাকেন। এই সকল রেমিট্যান্স প্রতিষ্ঠানে সকাল ১০টা থেকে রাত ২টা পর্যন্ত মানি ট্রান্সফার হয়ে থাকে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, লোকজন লাইনে দাঁড়িয়ে গভীর রাতে মানি ট্রানজেকশন করছেন। অনেকেই ফ্যাক্টরীতে জব করেন, সেখান থেকে সোজা টাকা পাঠাতে কনান্ট স্ট্রিটে চলে আসেন। প্লাসিড, স্মল ওয়ার্ল্ড, রিয়া, সোনালী একচেঞ্জসহ নানান কোম্পানীর মাধ্যমে রেমিট্যান্স যাচ্ছে বাংলাদেশে । আবার সরকারের দুই শতাংশ প্রনোদনা অনেককে লিগ্যাল চ্যানেলে টাকা প্রেরণে উৎসাহ দিচ্ছে। অনেকে মোবাইল অ্যাপস দিয়েও টাকা পাঠিয়ে থাকেন।
অ্যাপস জুম, রেমিট, মেজরিটিসহ প্রায় দশটি অ্যাপস এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশে টাকা পাঠাচ্ছেন নিয়মিত। তবে এই টাকা পাঠানোর কোন সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
আমেরিকার প্রবাসীরা বাংলাদেশে কি পরিমান রেমিট্যান্স প্রেরন করেন সেই হিসাব করলে দেখা যাবে এই সংখ্যা কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। মিশিগানের প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে পরিমান রেমিট্যান্স পাঠান সেই হিসাব করলে অনেক আগেই সেখানে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের একটি অফিস স্থাপিত হতে পারত। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তির কারনে কম রেমিট্যান্স প্রেরনকারী ফ্লোরিডার মায়ামী কনস্যুলেট পেয়ে গেলেও মিশিগানে আজও কনস্যুলেট অফিস হচ্ছে না।
মিশিগানে বসবাসকারি বাংলাদেশেীদের দাবি, রেমিট্যান্সের অগ্রাধীকারী হিসাবে অচিরেই মিশিগানে কনিস্যুলেট অফিস স্থাপন করা হোক।
মিশিগানের কয়েকজন প্রবীন কমিউনিটি নেতা জানান, মিশিগান প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা পালন করছেন, অথচ আমাদের একটি নায্য দাবী পূরন হচ্ছে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কমিটেড ছিলেন, অথচ তিনি সেই দায় এড়িয়ে চলছেন। মিশিগানের কনস্যুলেট অনেক রাজস্ব আদায় করতে সক্ষম হবে নিঃসন্দেহে।
উল্লেখ্য, আগামী মার্চে ফ্লোরিডায় কনস্যুলেট চালু হবে। সেখানে চারজন কর্মকর্তা অবস্থান করছেন, অফিসও নেওয়া হয়েছে। মিশিগানে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা জোর দাবি করছেন, মিশিগানে কনস্যুলেট অফিস হলে সেটি বেশি কার্যকর হবে এবং রাজস্ব আদায়ে অগ্রণী ভুমিকা রাখবে।
প্রায় এক লাখ মিশিগানবাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর নিকট মিশিগানে স্থায়ী কনস্যুলেটের দাবি প্রবাসীদের নায্য দাবি বলে জানান।
লেখক: জুয়েল সাদাত
ফ্লোরিডা প্রবাসী সাংবাদিক
জেএস/এনএইচবি/এএস