নিউ ইয়র্কের পাতাল ট্রেনে হামলার টার্গেট এশীয়রা
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের পাতাল ট্রেন (সাবওয়ে) স্টেশনগুলোতে অপরাধ প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা। প্রতিনিয়ত এসব ঘটনায় হামলার শিকার হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এ ধরনের ঘটনার ফলে পাতাল ট্রেনে চলাচল করতে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে অনীহা দেখা দিয়েছে। সন্ধ্যা নামতেই পাতাল ট্রেন (সাবওয়ে) স্টেশনগুলোতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নিতান্ত বাধ্য না হলে কেউ পাতাল ট্রেন ব্যবহার করতে চান না।
করোনাভাইরাস মহামারি থেকে এই মহানগরী যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল ঠিক তখনই সাবওয়েতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণভাবে বেড়ে চলেছে। দুই সপ্তাহ আগে নতুন মেয়র পাতাল ট্রেনে চলাচল নিরাপদ করার কঠোর বার্তা দেন। পাতাল ট্রেন স্টেশনগুলো থেকে ছিন্নমুল মানুষদের উচ্ছেদ করতে অধিক সংখ্যক পুলিশ সদস্য নিয়োগের ঘোষণাও দেন তিনি। এর পরও পাতাল ট্রেন স্টেশনে অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘নিউ ইয়র্ক পাতাল ট্রেন গণপরিবহনের পরিবর্তে বরং এক আতঙ্কের নাম, সাম্প্রতিককালে সিটিতে যত সংখ্যক সহিংসতা সংঘটিত হচ্ছে, তার অধিকাংশই ঘটছে পাতাল ট্রেন স্টেশনে।'
এ ছাড়া আরও লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, যতগুলো অপরাধ পাতাল ট্রেন স্টেশনে ঘটছে, তা ট্রেনের ভেতর ঘটে থাকুক অথবা প্ল্যাটফর্মসহ সাবওয়ে স্টেশনে ঘটে থাকুক না কেন, প্রায় প্রতিটি ঘটনায় হামলার শিকার বাংলাদেশি, চাইনিজসহ এশীয় কমিউনিটির সদস্য। প্ল্যাটফর্ম থেকে ধাক্কা দিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ফেলে দেওয়া, হাতুড়ি দিয়ে আঘাত, ছুরিকাঘাত এবং ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে এশীয় চেহারার যাত্রীর ওপর ঘুষি মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলার মত ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহিক ছুটির দিনে সাবওয়েতে কমপক্ষে ছয়টি ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত দিনে সাবওয়েতে ৫৫টি অপরাধের ঘটনা পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে। ২০২১ সালের একই সময়ের তুলনায় পাতাল ট্রেন (সাবওয়ে) স্টেশন অপরাধ বৃদ্ধির হার ২০৫.৬ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাবওয়ে অপরাধ ঘটেছিল ১৮টি। পরিসংখ্যানে আরও দেখা যায় যে, চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫৮ দিনে পুলিশের কাছে নিউইয়র্ক সিটি সাবওয়েতে সংঘটিত ৩৭৫টি অপরাধের ঘটনা সম্পর্কে রিপোর্ট করা হয়েছে, পূর্ববর্তী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের একই সময়ে ২১৭টি অপরাধের ঘটনা পুলিশকে অবহিত করা হয়েছিল। ধারণা করা হয় যে, পুলিশে রিপোর্ট করা হয় না, এমন অনেক অপরাধ রয়েছে।
নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাছে এসব ঘটনার অধিকাংশকেই হেটক্রাইম বা ঘৃণিত অপরাধের অংশ বলে অভিযোগ করা হয়। কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে হামলাকারীরা তাদের শিকারের ওপর হামলা করেই দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন, কোনোকিছু লুণ্ঠনের চেষ্টা করেন না। ভুক্তভোগীরাও অভিযোগ করেছেন যে তাদের যারা হামলা করেছেন প্রায় ক্ষেত্রে তারা তাদের নোংরা ভাষায় বর্ণবাদী গালি দিয়েছেন এবং আমেরিকা থেকে চলে যেতে বলেছেন, তা না করলে আরও কঠোর পরিণতি হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন। এর বাইরে সিটিজুড়ে সংঘটিত অপরাধের মধ্যে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা রয়েছে। তবে পুলিশ মনে করছে সিটিতে সার্বিকভাবে ভয়াবহ অপরাধের ঘটনা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং জন জে কলেজ অব ক্রিমিনাল জাস্টিসের খণ্ডকালীন প্রফেসর জোসেফ গিয়াকেলন বলছেন, দীর্ঘস্থায়ী কোভিড ১৯ এর ভয়াবহতা থেকে নিউইয়র্কাররা যখন নিজ পায়ে দাঁড়াতে যাচ্ছেন, তখন তাদের অপরাধের কথা ভাবতে হচ্ছে যে, অপরাধের শিকার তারও হতে পারেন। পুলিশ সাবওয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন সিটি প্রশাসন যদি চায় যে মানুষ কাজে ফিরে যাক তাহলে গণপরিবহনকে অপরাধমুক্ত করতে হবে। কারণ সাবওয়ে নিউইয়র্ক সিটির জীবনসূত্র। যাত্রীরা যদি সাবওয়ে ব্যবহার করতে ভয় পান এবং এখন সাবওয়ে অপরাধের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তাতে তাদের দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
এনওয়াইসি সাবওয়েডটকমে সিটির সাবওয়ে স্টেশনগুলোর মধ্যে ১০টি স্টেশনকে অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক স্টেশন হিসেবে বর্ণনা করে এই স্টেশনগুলো ব্যবহারকারী যাত্রীদের বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট।
বিপজ্জনক উল্লেখযোগ্য স্টেশনগুলো হচ্ছে- ম্যানহাটানের টাইমস স্কোয়ার স্টেশন, সেভেনথ এভিনিউ ৪২ স্ট্রিট, ব্রডওয়ে স্টেশন, ২৩ স্ট্রিট, সেভেনথ এভিনিউ, গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন, ৪২ স্ট্রিট, পার্ক এভিনিউ, ব্রডওয়ে জংশন স্টেশন, ফুলটন স্ট্রিট, ব্রুকলিন, প্রসপেক্ট পার্ক এভিনিউ, লিঙ্কন রোড, ব্রুকলিন, ১৪৯ স্ট্রিট, গ্র্যান্ড কনকোর্স স্টেশন, ব্রঙ্কস, বাওরি স্টেশন, ডিলেন্সি স্ট্রিট, ব্রড চ্যানেল স্টেশন, ওয়েস্ট রোড, কুইন্স, হারলেম স্টেশন, ১২৫ স্ট্রিট, লেক্সিংটন এভিনিউ, ৭১ ফরেস্ট হিলস এভিনিউ স্টেশন, কুইন্স। এসব স্টেশনে নিকট অতীতে হত্যাসহ ভয়াবহ অপরাধের ঘটনা ঘটেছে এবং এখনও পুরোপুরি অপরাধমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। সেজন্য ট্রেন চলাচলের সময় সতর্ক থাকার জন্য পুলিশ যাত্রীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আরএ/