রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার বরফ গলছে!
আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ চায় আওয়ামী লীগ। এজন্য অনেক কিছুতেই ছাড় দিতে প্রস্তুত আওয়ামী লীগ। তার ইঙ্গিত ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় ফোরামের বৈঠকে দিয়েছেন। দলীয় নেতারাও ছাড় দেওয়ার সুরে কথা বলছেন। তাদের একটাই লক্ষ্য নির্বাচনকে সমালোচনামুক্ত করতে যে করেই হোক বিএনপিসহ সর্বাধিক দলের অংশগ্রহণ করতে হবে। শেষ মুহুর্তে বিএনপি যদি নির্বাচনের মাঠে না নামে তাহলে কিভাবে নির্বাচনকে সমালোচনার ঊর্ধে রাখা যায় সেই পরিকল্পনাও রয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির। তাই নির্বাচনের আগে দুই দলের অনড় অবস্থানের বরফ গলবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় যেন আর কেউ নির্বাচিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই একাধিক রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের মাঠে নামিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতাপূর্ণ একটি ভোট যুদ্ধ চাচ্ছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের মাঠে নতুন খেলোয়ার নামাতেও কৌশলের কমতি রাখছে না আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ দিন পর রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন জটিলতার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর অচিরেই নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদন চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। ফলে গণ অধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলনের মতো কিছু নতুন রাজনৈতিক দল আগামী নির্বাচনের মাঠে দেখা যেতে পারে যদি তারা নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারে।
রাজপথের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি বহুদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিল সরকারের বাঁধার কারণে তারা কথা বলতে পারেন না, সভা সমাবেশ করতে পারেন না। তারা শুধু দেশেই না দেশের বাইরেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অভিযোগগুলো তুলেছেন। তাই দেশে এবং দেশের বাইরে যেন কোনো অভিযোগ তুলেতে না পারে সেজন্য আওয়ামী লীগের তরফ থেকেও বরফ গলার সুর।
গত ৭ মে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি কেন্দ্রীয় নেতাদের বলে দেন। বিরোধীদলের ব্যাপারে ওই সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, তারা (বিরোধী দল) মিছিল-মিটিং সমাবেশ করুক। তারা স্বাধীনভাবেই করুক। আমাদের তরফ থেকে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একথাটিই জানিয়েছেন।
এরপর থেকে আওয়ামী লীগের নেতারাও একই সুরে কথা বলছেন। এরপর গত ৮ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে ব্রিফিংকালে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে নির্বাচনে আনার ব্যাপারে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী খোলামনে বলেছেন সব দল নির্বাচনে আসুক। সব দলকে নিয়েই আমরা ভোট করতে চাই। বিএনপিসহ সব দলকে নিয়ে ভোট করতে চাই। নির্বাচন ফেয়ার হবে নিশ্চয়তা দিচ্ছি।’
বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কোনো উদ্যোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বলব তাদের নির্বাচনে আসতে। যদিও এটি বলা উচিত না। নির্বাচনে আসা তাদের অধিকার। এটা সুযোগের ব্যাপার না। তারা দেশের একটি বড় দল হিসেবে রাজনীতির আঙিনায় আছে।
একই সুরে কথা বলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ তিনি বলেন, সকল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করার জন্য যা যা করা দরকার সবগুলোই করবে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সরকারি দলের সঙ্গে বৈঠক করতে চায় কথা বলতে চায় তাতেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমরা আলাপ আলোচনা করতে চাই আমরা চাই নির্বাচনটা অংশগ্রহণ মূলক হোক।
আওয়ামী লীগের নেতাদের এই কথায় রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের সুবাতাস বৈছে। বিএনপিও মাঠ গরম করে চলছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সভা সমাবেশ করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন এটি রাজনীতির জন্য সুসংবাদ দেশের জন্যও মঙ্গল বার্তা।
এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, নির্বাচনের এখনও দেড় বছরের বেশি বাকি আছে। এরইমধ্যে হঠাৎ একটা নির্বাচনী মৌসুম তৈরি করছি। মনে হচ্ছে আগামী ডিসেম্বর নির্বাচন। আসলে নির্বাচন কিন্তু আগামী ডিসেম্বর না, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। এই মুহুর্ত পর্যন্ত যে পক্ষ থেকেই যে কথাগুলো আসছে এগুলো এরকমই থাকবে শেষ পর্যন্ত এটা আমার এতটুকু মনে হয় না। আওয়ামী লীগের যে অবস্থান, বিএনপির যে দাবি নিরপক্ষে ছাড়া যাবই না, আওয়ামী লীগ বলছে তত্ত্বাবধায়কের প্রশ্নই ওঠে না, সুশিল সমাজের এক একটার এক একটা মতামত আছে। এটা কি রাজনীতির মাঠ আগে থেকেই গরম করে তুলছি কি-না? প্রশ্ন রাখেন এই অধ্যাপক।
দুই দলের অবস্থান সম্পর্কে ব্যাখা করে অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন ভালো হয় নাই। কে দায়ী এই তর্ক চলতেই থাকবে। বিএনপি বলবে আমরা প্রতারিত। আওয়ামী লীগ বলবে মির্জা ফখরুল তো সকাল ১১ টার সময় বলেছে এভাবে ভোট পড়তে থাকলে আমরা জিতে যাব। এই তর্কের শেষ নাই। ২০১৪ সালের নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ বলবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ২০১৪ এবং ২০১৮ নির্বাচন নিয়ে তর্ক চলতেই থাকবে এক্ষেত্রে যারা কর্তৃপক্ষ থাকে তাদের দিকে প্রথম চোখটা পড়বে। সেই চাপটা হয়তো আওয়ামী লীগের গায়ে লাগবে আরও বেশি। ওই নির্বাচনে বিএনপি যদি দায়ীও হয় তাহলে ক্ষমতাসীনদের দিকে চোখ চলে যায়। এই প্রেসারটা বর্তমান ক্ষমতাসীনরা ফিল করবেন এটার কোন ভুল নাই। আর বিএনপির প্রেসারটা হবে তৃতীয়বার যদি তারা ঠিক ঠাক মতো না যান নির্বাচনে তাহলে পার্টি হিসেবে কি হবে?
বিএনপি ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন ২০০৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কথা বলেন না কেন? সেখানে তো তাদের ফলাফল ভয়াবহ। বিএনপি ২০০৮ এর ফলাফলকে ব্যাখা করে কিভাবে? তাহলে বলতে হবে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন ঠিকমত হয় নাই। তাহলে তারা তত্ত্বাবধায়কের দাবিটা কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করবেন? বিএনপি বলবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই তাহলে তো ২০০৮ সালের নির্বাচন মেনে নিতে হবে। যদি মেনে নেয় তখন তার সমালোচকরা বলবে ২০০৮ সালে যার এই অবস্থা সে তো ২০১৮ সালে তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে। বিএনপির জন্য কঠিন হবে খুব শক্ত অবস্থান তৈরি করা। কাজেই বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ দুই দিলের উপরই ভিন্ন রকম চাপ থাকবে। সেই জায়গায় আমরা আশাবাদী। দুই দলের দুই রকম চাপ ফিল করে নির্বাচনের আগে গিফ এন্ড টেক হবে দুই পক্ষই অনড় অবস্থানে শেষ পর্যন্ত থাকবে বলে মনে হয় না।
এসএম/এএজেড