একযোগে ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দিলে ব্যাহত হবে নাগরিক সেবা
ছবি: সংগৃহীত
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সরকারের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে ইউপি চেয়ারম্যানদের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকে কেন্দ্রীয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলটির অধিকাংশ নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে গেছেন। এ তালিকার একটা বড় অংশ আওয়ামীপন্থি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরাও। যাদের অনুপস্থিতি সরাসরি নাগরিক সেবা প্রদান বাধাগ্রস্ত করছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যে দেশজুড়ে সকল ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এদিকে উপস্থিত এবং দ্বায়িত্বপালনরত ইউপি সদস্যরা পূর্নমেয়াদেই থাকতে চাচ্ছেন। তাদের মতে একযোগে সকল চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণ করলে দেশের স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে এবং সেই সাথে নাগরিক সেবা ব্যহত হবে বলে মনে করছেন তারা। তাদের মতে, সবাইকে অপসারণ না যারা পলাতক কিংবা অনুপস্থিত রয়েছেন তাদের বিষয়ে সরকার চাইলে পদক্ষেপ নিতে পারেন ।
এদিকে আগামী সোমবার (২১ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানব বন্ধনের ডাক দিয়েছেন বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে এখন ইউনিয়ন পরিষদ আছে ৪ হাজার ৫৮০টি। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৬৪ জন চেয়ারম্যান নিয়মিত অফিস করছেন। তবে কত সংখ্যক ইউপি সদস্য বা মেম্বার অনুপস্থিত, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এমন বাস্তবতায় শুধু দেড় হাজার নয়, সাড়ে ৪ হাজার ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারকেই অপসারণের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ নিয়ে দোটানায় রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারও। তৃণমূলের এসব জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করার পর সেখানে বিপুলসংখ্যক প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। এতো কর্মকর্তা কোথায় পাওয়া যাবে কিংবা সেই প্রশাসকেরা আদৌ কাজ করতে পারবেন কি না, এ নিয়ে আলোচনা চলছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। তবে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
অবশ্য স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে না দিয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে পরিষদ পরিচালনা করলে সেটি বেশি কার্যকর হবে। তবে জানা যায় অনেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিএনপি জামাত বা স্বতন্ত্র হলেও সকল প্যানেল চেয়ারম্যান আওয়ামী পন্ত্রী। প্রভার বিস্তার করার জন্যই সকল প্যানেল চেয়ারম্যান ছিল আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত । নাম প্রকাশে একজন বিএনপিপন্থী চেয়ারম্যান বলেন দেশের ৪ হাজার ৫৮০টি ইউনিয়ন পরিষদ আছে কিন্তু একটি ইউনিয়নেও আওয়ামী পন্ত্রী ছাড়া প্যানেল চেয়ারম্যান পাওয়া যাবে না।
তবে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না জানিয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এম এস করিম উদ্দিন ঢাকা প্রকাশকে বলেন, যেসব ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান অনুপস্থিত, সরকারের উচিত হবে প্রথমে তাঁদের নোটিশ দেওয়া। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের পরিষদে উপস্থিত হওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া। এ সময়ে না এলে আসন শূন্য ঘোষণা করা। পরে প্রতিটি এলাকায় সর্বজনবিদিত কাউকে চেয়ারম্যান হিসেবে বসানো যেতে পারে। এছাড়াও যেসকল চেয়ারম্যান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে ছিলেন না তাদেরকে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে অন্য আরও কয়েকটি ইউনিয়নের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, এইসব চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা আছে তাদের দায়িত্ব দিলে ইউনিয়ন পরিষদের নাগরিক সেবা বঞ্চিত হবে না।
এদিকে নোয়াখালী, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, ফেনী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক। কেউ কেউ হত্যা মামলার আসামি। কেউ গ্রেপ্তার এড়াতে, কেউ হামলা থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে রয়েছেন।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, চেয়ারম্যান পলাতক, এমন বেশ কিছু ইউপিতে প্যানেল চেয়ারম্যান বসানো হয়েছে। কোথাও কোথাও দেওয়া হয়েছে প্রশাসক। ৭৮৬টি ইউনিয়ন পরিষদে এরই মধ্যে প্যানেল চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। এই সব প্যানেল চেয়ারম্যানের অধিকাংশই আবার আওয়ামী পন্থী।
বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দিলে কিংবা চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারি সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। চেয়ারম্যানরা বলছেন, তাঁদের অপসারণ করলে গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। চুরি, ডাকাতি বেড়ে যাবে। নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের (মেম্বার) অপসারণ না করার দাবি জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। এর প্রেক্ষিতে সারাদেশের ইউপি চেয়ারম্যান-সদস্যদের নিয়ে আগামী সোমবার (২১ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি।
স্থানীয় সরকার বিভাগের তথ্যমতে, ইউপি চেয়ারম্যানরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা বিতরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন। ওয়ারিশ সনদ, চারিত্রিক সনদ, জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুনিবন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে। গ্রামে বিভিন্ন সালিস, নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরোনো রাস্তা সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে।
এদিকে যেসব ইউনিয়নে প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সেই সব ইউনিয়নের নাগরিক সেবা চরম ব্যাহত হচ্ছে। সময়মত পাওয়া যাচ্ছে না কোন নাগরিক সেবা। এছাড়াও প্রশাসনিক কর্মকর্তারও ইউনিয়নের দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়।
যে কারণে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের কথা উঠেছে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের কথা কেন উঠল, সেই অনুসন্ধানে কয়েক বিষয় সামনে এসেছে।
১) বিগত স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ আছে। একতরফা ওই নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হয়নি, বিরোধীরা সুযোগ পাননি। এ কারণে অনেকে ওই নির্বাচন বাতিল করে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ চান।
২) বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের অপসারণে বড় ধরনের চাপ রয়েছে।
৩) দেড় হাজারের মতো ইউপি চেয়ারম্যান অনুপস্থিত। সেখানে কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে সব চেয়ারম্যান, মেম্বারকেই অপসারণের চিন্তাভাবনা চলছে।
অপসারণ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, ৪ হাজার ৫৮০ ইউনিয়নে ১২ জন করে ইউপি সদস্যের বিকল্প হিসেবে ৫৪ হাজার ৯৬০ জন প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। সেখানে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক কিংবা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ-ও বলছেন, এভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ইউনিয়ন পরিষদ চালানো মুশকিল হবে। তাঁদের নিজেদের কাজ রয়েছে। আদতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। তার চেয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে পরিচালনা করলে সেটি ভালো হবে।
এর আগে গত আগস্টে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি সব পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলরদের পাশাপাশি পৌরসভার কাউন্সিলরদেরও অপসারণ করা হয়।
সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান মনে করেন, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত হবে না। এতে নাগরিক সেবা ব্যাহত হবে। চেয়ারম্যানদের পরিবর্তে যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হবে, তাঁরা নাগরিকদের সেবা দিতে পারবেন না। তিনি বলেন, যাঁরা পলাতক, সরকার চাইলে শুধু তাঁদের অপসারণ করতে পারে। যেসব ইউপিতে চেয়ারম্যানরা আসছেন না, সেখানে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে কাজ করা যেতে পারে। তবু প্রশাসক নিয়োগ নয়।
যদিও সরকারি মহল থেকে এ বিষয়ে এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থবির হতে পারে, যা সারা দেশের জনগণের ভোগান্তি বাড়াবে। অনেকেই মনে করছেন, শুধু পলাতক আওয়ামীপন্থি চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হতে পারে এবং স্থানীয় পর্যায়ে সেবার মানও পুনরায় স্থিতিশীল হবে।
তবে সরকারের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত, কারণ রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং জনমতের চাপকে সঠিকভাবে বিবেচনা করতে হবে। জনগণের সেবা পুনঃস্থাপন করার জন্য সরকারকে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে