ধেয়ে আসছে করোনার তৃতীয় ঢেউ!
দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়ান্ট অমিক্রন । যা ভাবাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের। নতুন এই স্ট্রেনটি মারাত্মক রকম সংক্রামক। আর এর জেরে বিশ্বজুরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। সেই সঙ্গে বাড়ছে করোনার সংক্রমণের হারও।পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কপালে ভাঁজ পড়েছে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের। তাদের আশঙ্কা, সম্ভাব্য তৃতীয় ঢেউয়ের দামামা বেজে গিয়েছে।
গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রস অ্যাডানম গেব্রেয়েসাস করোনার সুনামি আসতে চলেছে বলে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করেছেন।বলেছেন, ডেল্টার চেয়ে দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে অমিক্রন। বিভিন্ন দেশে অমিক্রনের কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে।
ডাব্লিউএইচও-র বক্তব্য, ডেল্টা প্রজাতির ভাইরাস এখনো চলে যায়নি। তারই মধ্যে অমিক্রন চলে আসায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। দুইটি ভাইরাস একত্রে ছড়িয়ে পড়ছে।
ফ্রান্স, ইউক্রেন, ডেনমার্ক, ইটালি, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিসসহ ইউরোপের একাধিক দেশ অমিক্রনে জর্জরিত। সংক্রমণ বাড়ছে জার্মানি অস্ট্রেলিয়াতেও। খবর এসেছে চীনের উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় জিয়ান শহরে বাড়ছে করোনার সংক্রমণ। শহরজুড়ে জারি করা হয়েছে কড়া বিধিনিষেধ। শহরের ১ কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দা ১২ দিন ধরে গৃহবন্দী অবস্থায় আছেন।
এদিকে ভারতেও গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে এবং দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও করোনা পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন।পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে এরই মধ্যে আবার বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সোমবার থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের চলাচলেও কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেধে দেওয়া স্থিতিশীল সীমার মধ্যেই আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বোঝার একটি নির্দেশক হলো রোগী শনাক্তের হার। কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। এ হিসেবে বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল আছে বলে ধরা যায়।গত বছরের মাঝামাঝিতে করোনার ডেলটা ধরনের দাপটে দেশে করোনায় মৃত্যু, রোগী শনাক্ত ও শনাক্তের হার বেড়েছিল। তবে আগস্টে দেশব্যাপী করোনার গণটিকা দেওয়ার পর সংক্রমণ কমতে থাকে। গত ডিসেম্বরের প্রথম কয়েক সপ্তাহ ধরে করোনা শনাক্ত ১ শতাংশের ঘরেই ছিল। তবে কিছুদিন ধরে সংক্রমণে আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। সোমবার শনাক্তের হার পরীক্ষার বিপরীতে বেড়ে হয়েছে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আগের দিন এই হার ছিল ২ দশমিক ৯১ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, আগামী মার্চ-এপ্রিলে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেশে বেড়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, অমিক্রন নিয়ে সারা দুনিয়াতেই একটি আশঙ্কা আছে। আমরাও ভীত। আমরা ধারণা করছি, মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে সংক্রমণ বাড়তে পারে; গত দুই বছরের চিন্তা যদি আমরা করে থাকি। এ কারণে আমরা সারা দেশের হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা জোরদারের জন্য কাজ করছি।
এদিকে সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে অমিক্রন প্রতিরোধের বিষয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের জানান, অমিক্রন প্রতিরোধে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হচ্ছে। গাড়ি, ট্রেন, মসজিদ সব জায়গায় মাস্ক পরতে হবে। দোকানপাটে গেলে মাস্ক পরতে হবে। না পরলে জরিমানা করা হবে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। এছাড়া ‘ল্যান্ড পোর্ট, সি পোর্ট সব জায়গায় স্ক্রিনিং করা হবে। টিকা যারা নিয়েছেন তারা রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে পারবেন, অফিস করতে পারবেন। তারা যে টিকা দিয়েছেন তার প্রমাণ থাকবে। টিকা না নিলে রেস্টেুরেন্টে খাওয়া যাবে না।
মার্চ-এপ্রিলে কেন?
লক্ষ্যকরে দেখাগেছে, ২০১৯ সালে নভেম্বরে চীনে করোনাভাইরাস শনাক্তের পর বিশ্বজুরে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হয় মার্চে। এছাড়া ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে গত শীতে ইউরোপ আমেরিকাতে ব্যাপক আকারে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে। তখন বাংলাদেশের পরিস্থিতি ছিল খুবই স্বভাবিক।কিন্তু বাংলাদেশে গত বছর মার্চের পর থেকে ডেল্টা দাপট দেখায়। একারণে গত দুই বছরের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন মার্চ-এপ্রিল মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে। কারণ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে পরপর দুই বছর একই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে।
আশার কথা:
অমিক্রনে করোনার অন্য ধরনগুলোর মতো ফুসফুসে প্রদাহ খুব কম। সেকারণে হয়ত এর সংক্রমণ অনেক বেশি হলেও গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংখ্যা কম হতে পারে।
করোনার তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে অনেক আগেভাগেই। কিন্তু সবার আগে প্রয়োজন জনসচেতনাতা। আগের ঢেউ দুটিতে জনসাধারণের উদাসিনতা স্পষ্ট ছিল। এবারও যদি তাই ঘটে তবে তৃতীয় ঢেউ সামাল দেয়া কঠিন হবে বৈ কি।
২০২০ সালের মার্চে বাংলাদেশে প্রথম করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে মোট করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ১৪০। সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৮ হাজার ৮১ জনের। এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৭৭১ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ২১৪ জন সুস্থ হয়েছেন।