বছর জুড়ে আলোচিত যারা
আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ, হেলেনা জাহাঙ্গীর
কখনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদেশ সফর সঙ্গী। আবার কখনো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে ছবি। আবার কখনো টিভি উপস্থাপক কখনো বা প্রবাসীদের নিয়ে লাইভ করে আলোচনায় ছিলেন ব্যবসায়ী নেতা হেলেনা জাহাঙ্গীর। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে জয়যাত্রা টিভির কর্ণধার দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র পদ হারান।
শুধু তাই না `আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ’ নামে নতুন সংগঠন করে আবারও আলোচনায় আসেন এই বিতর্কিত ব্যবসায়ী নেতা। সব পদ হারান। পদ হারিয়েই শেষ নয় বিচারের মুখোমুখিও হতে হয় হেলেনা জাহাঙ্গীরকে। পরে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক মাস জেলও খাটেন। তাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে আইপিটিভির নিবন্ধনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। তখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয় লাইসেন্স ছাড়া কোন আইপি টিভি সংবাদ প্রচার করতে পারবে না।
জয়যাত্রা টেলিভিশনের চেয়ারপারসন হেলেনা নিজেকে আইপি টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি হিসেবেও পরিচয় দিতেন। তিনি আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক উপকমিটিতে সদস্য পদে ছিলেন। এছাড়া কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগেরও উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন তিনি।
হেলেনা জাহাঙ্গীর সিস্টার হেলেন নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি জয়যাত্রা টিভি খুলে সেই গণমাধ্যমের নামে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডও ব্যবহার করতেন। তার সেই অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড নিয়েও অনেক আলোচনা হয়। নিজেরে টিভিতে নিজেই গান গাইতেন আবার প্রবাসীদের নিয়ে নানা ইস্যুতে লাইভ অনুষ্ঠানও করতেন। এভাবে একের পর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দিয়ে আলোচনায় ছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর।
সব হারালেন মেয়র জাহাঙ্গীর
২০২১ সালে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত চরিত্রের নাম জাহাঙ্গীর আলম। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র এই জনপ্রতিনিধি যিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে মেয়র পদ হারিয়েছেন। বছরের শেষ প্রান্তে এসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়া জাহাঙ্গীর অনেক চেষ্টা করে, কান্নাকাটি করেও নিজের পদ রক্ষা করতে পারেননি। গত ২৫ নভেম্বর তাকে মেয়র পদ থেকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
২০১৮ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে নির্বাচন করেন। সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রার্থীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে উঠেন জাহাঙ্গীর আলম। গত সেপ্টেম্বর মাসে মেয়র জাহাঙ্গীরের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। যেখানে তিনি কারো সঙ্গে কথোপকথনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদকে নিয়ে কটু মন্তব্য করেন।
অডিও ফাঁসের পর গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে দলীয় শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগ তুলেন। তার বিরুদ্ধে গাজীপুরে বিক্ষোভ মিছিল হয়। এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠান জাহাঙ্গীরকে। গত ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বৈঠকে জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়। তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়।
দল ও পরিবারকে বিব্রত করেন আলোচনায় মির্জা কাদের
সত্যবচন নিয়ে আলোচনায় আসেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। একের পর এক আওয়ামী লীগের নেতাদের সমালোচনা করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এর ছোট ভাই মির্জা কাদের। তার আলোচনায় বাদ যাননি নিজের ভাই-ভাবী। বিভিন্ন সময় ভাবীকে উদ্দেশ্য করে কুটক্তিমূলক কথাও বলেছেন মির্জা কাদের।
মির্জা কাদের আলোচনায় আসে মূলত ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরভবন চত্বরে পৌর নির্বাচনে নিজের ইশতেহার ঘোষণার সময় হঠাৎ বিস্ম্ফোরক বক্তব্য দেন তিনি। সেই আলোচনায় তিনি বলেন, 'সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নোয়াখালীর এমপিরা পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না'।
কখনো ভাই, কখনো ভাবী, আবার কখনও দলের কেন্দ্রীয় নেতাকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন মির্জা কাদের। বিদায়ী ২০২১ সালের ১৬ জুলাই বসুরহাট পৌরসভা ভবনের সামনে দরিদ্রদের মধ্যে শাড়ি ও লুঙ্গি বিতরণকালে এক বৃদ্ধ লোককে ঘুষি মেরে ফের আলোচনায় আসেন আবদুল কাদের মির্জা।
তার এই আলোচনায় আবারও গরম হতে থাকে রাজনীতির মাঠ। এভাবে একের পর এক বিস্ফোরক মন্তব্য করে নিজ দল ও পরিবারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছেন আবদুল কাদের মির্জা। পরে পরিবার থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে পড়েন তিনি।
শতবছরের পুরোনো আইনে কারাবন্দী সাংবাদিক
বিদায়ী ২০২১ সালব্যাপী সাংবাদিক নির্যাতন বা সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেয়ার নানা ঘটনা ঘটেছে। এসব বাধার বেশিরভাগই হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে। আর শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা তো আছেই। তবে সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে যে মামলায়, সেটি হয়েছে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে।
শত বছরের পুরোনো এই আইনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়ের করা ওই মামলায় সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম প্রায় এক সপ্তাহ ধরে কারাগারে আটক ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সচিবালয় থেকে সরকারি 'নথি চুরির' অভিযোগ আনা হয়।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ও তার মুক্তির দাবিকে কেন্দ্র করে তখন সাংবাদিক সমাজের মধ্যে থাকা রাজনৈতিক দেয়াল ওই এক সপ্তাহের জন্যে হলেও অদৃশ্য হয়েছিল। শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশেই সাংবাদিকরা আন্দোলন করছিলেন তখন সাংবাদিক রোজিনার মুক্তির দাবিতে। শুধু সাংবাদিক মহল নয়, তাকে সচিবালয়ে কয়েক ঘণ্টা আটক করে রাখা ও পরে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে মামলা ঠুকে জেলে পাঠানোর ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
গত ২৩ মে কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। এর আগে ১৯ মে ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লা পাঁচ হাজার টাকা মুচলেকা ও পাসপোর্ট জমা দেওয়ার শর্তে রোজিনা ইসলামের জামিন মঞ্জুর করেন।
মাঠ ও মাঠের বাইরে সাকিব
২২ গজে সাকিব যেমন নৈপুণ্যের দ্যুতিতে নিজেকে আলোকিত করে রাখেন, তেমনি মাঠের বাইরেও! তবে মাঠের বাইরে থাকেন বিতর্কিত হিসেবেই। মাঠে ও মাঠের বাইরে ২০২১ সালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
২০২১ সালের শুরু ছিরো সাকিবের ফিরে আসা। ২০১৯ সালে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন রাখার জন্য আইসিসি তাকে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করেছিল দুই বছরের জন্য। তবে তা ছিল শর্ত সাপেক্ষে। সাজাকালীন আইসিসির দেয়া শর্তগুলো পূরণ করলে তার সাজা এক বছর কমে আসবে। সাকিব শর্ত মানেন, তার নিষেধাজ্ঞা এক বছরে কমে আসে। সেই হিসেবে ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর তার নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু করোনার কারণে কোনো খেলা না থাকাতে সে বছর তিনি আর মাঠে নামতে পারেননি। এ বছরের শুরুতেই ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ দিয়ে তিনি আবার মাঠে ফেরেন। ফিরেই সিরিজ সেরা হন ব্যাটে-বলের দ্যুতিতে।
মাঠে সাকিব দ্যুতিময়, তবে মাঠের বাইরে বিতর্ক থেকে যেন তিনি নিজেকে দূরে রাখতেই পারেন না। তাইতো দেখা যায় প্রিমিয়ার বিভাগ ক্রিকেট লিগে, মোহামেডানের হয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর বিপক্ষে ম্যাচে, আম্পায়ারের একটি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে, তিনি স্ট্যাম্প লাথি মেরে ফেলে দেন। আম্পায়ারের সাথে তর্কেও লিপ্ত হন। ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারদের পক্ষপাতিত্বমূলক আম্পায়ারিংয়র প্রতিবাদে সাকিবকে অনেকেই সমর্থন করলেও ক্রিকেটীয় আইনে ছিল অগ্রহণযোগ্য। যে কারণে লিগে তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। নিষেধাজ্ঞা শেষে তিনি আবার লিগে মোহামেডানের হয়ে অংশ নিয়েছিলেন। তবে সুপারলিগ না খেলেই চলে গিয়েছিলেন আমেরিকাতে।
বিতর্ক এখানেই শেষ নয়। টেস্ট ক্রিকেটে সাকিবের অনীহা নতুন কিছু নয়! নানা কারণে তিনি টেস্ট ক্রিকেট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। তারপরও তাকে দলে পাওয়া বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি।
ক্রিকেটের পাশাপাশি সাকিব নিজেকে অনেক আগে থেকেই ব্যবসায় জড়িত হয়েছেন। বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তার আছে। এবার সেখনে নতুন করে যোগ হয়েছে ব্যাংকের মালিকানা। পিপলস ব্যাংকের পরিচালক হয়েছেন তিনি। তার সাথে তার মায়ের নামেও একটি পরিচালক পদ আছে। এভাবেই গোটা বছর জুড়ে সাকিব মাঠে ও মাঠের বাইরে নিজেকে আলোচনায় রেখেছিলেন।
পরীমনির নানা কাণ্ড
মিডিয়াপাড়ায় চলতি বছরের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র চিত্রনায়িকা পরীমনি। বোট ক্লাব কাণ্ড, বাসায় র্যাবের অভিযান, মামলা, রিমান্ড, গ্রেপ্তার, জামিন, মুক্তি। এমন সব ঘটনার সঙ্গে জুন থেকে ডিসেম্বর বারবার উচ্চারণ হয়েছে পরীমনির নাম। শুরুটা হয়েছিল ৮ জুন রাতে। সেদিন রাতে পারিবারিক বন্ধু নিয়ে যান আশুলিয়ার একটি ক্লাবে পরীমনি। সেখানে জোর করে তার মুখে পানীয়র গ্লাস চেপে ধরে এবং শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে বলে জানান তিনি। এর পর ৪ আগস্ট পরীমনির রাজধানীর বনানীর বাসায় অভিযান চালিয়ে পরীমনিকে আটক করেছে র্যাব। অভিযান চালানোর সময় ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে ফেসবুকে লাইভে এসে পরীমনি থানাপুলিশ ও ডিবির কর্মকর্তা এবং তার পরিচিতজনদের কাছে ফোন করে তাকে বাঁচানোর আহ্বান জানান।
৫ আগস্ট পরীমনির বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। সেদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে এই মামলায় তাকে আদালতে তোলা হয়। তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে আবেদন করে পুলিশ। এর মধ্যে ৭ আগস্ট এফডিসিতে সংবাদ সম্মেলন করে পরীমনির সদস্যপদ স্থগিতের কথা জানায় চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি। চার দিনের রিমান্ড শেষে ১০ আগস্ট আরও দুই দিনের জন্য রিমান্ডে নেওয়া হয় পরীমনিকে।
পরীমনির জামিন আবেদন নাকচ করে ১৩ আগস্ট তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। তাকে রাখা হয় গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে। ১৯ আগস্ট পরীমনিকে তৃতীয় দফায় ১ দিনের জন্য রিমান্ডে নেয় সিআইডি। ২২ আগস্ট পরীমনির পক্ষে তার আইনজীবীরা ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন। পরে ৩১ আগস্ট তার জামিন হয়। ১ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি ২৬ দিন বন্দি ছিলেন।
এ বছরে তার ‘স্ফুলিঙ্গ’ সিনেমা মুক্তি পেলেও সেটি দর্শক টানতে পারেনি। তবে ‘প্রীতিলতা’, ‘কাগজের বউ’ সিনেমাগুলোতে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি। মুক্তির মিছিলে আছে তার ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’, ‘মুখোশ’ সিনেমাগুলো।
মামুনুলের মানবিক বিয়ে
বিদায়ী বছরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন হেফাজতে ইসলামের বহিস্কৃত যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। সরকারের বিরুদ্ধে নানা কটুক্তিকর বক্তব্য দিয়ে বার বার আলোচনায় আসেন এই ধর্মীয় নেতা। ২০২০ সালের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আপত্তিকর কথা বলেন মামুনুল হক। তার বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও হেফাজতে ইসলাম মুখোমুখি অবস্থান নেয়।
ভাস্কর্য ইস্যু শেষ হতে না হতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধীতা করে বিক্ষোভ করে হেফাজতে ইসলাম। সেই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন মামুনুল হক। গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফর ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা। সেই বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয়। ওই সংঘাতে প্রাণ হারান অন্তত ১৮ জন।
মোদি ইস্যুতে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রয়্যাল রিসোর্টে নারীসহ জনতার হাতে ধরা পড়েন মামুনুল হক। শুরু হয় নতুন বিতর্ক।
মামুনুল হক এর মাঝখান দিয়া অন্য কিছু মনে কইরো না কথাটা পরে ভাইরাল হয়ে যায়। তার মানবিক বিয়ে এবং মাঝখান দিয়ে অন্য কিছু মনে কইরো না ব্যাপক আলোচিত ছিল। পরিস্থিতি যখন ঘোলাটে তখন নিজের ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুল হক বলেন, আমি তাকে (ঝর্না) বিয়ে করেছি। বিয়েটাকে মানবিক বিয়ে বলে দাবি করেন তিনি।
পরে তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা সোনারগাঁ থানা পুলিশ সূত্র জানায়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। সেই মামলায় ২০২১ সারের ১৮ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পরে ধর্ষণ মামলায় মামুনুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। গত ৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আনিসুর রহমান এ অভিযোগ গঠন করেন। এর মধ্য দিয়ে মামুনুল হকের বিচার শুরু হয়। এছাড়া মামুনুল হকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দুইটি মামলা করা হয়। গত ৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের কেন্দ্রীয় সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল ও বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠা ও নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুল মালেক বাদী হয়ে ঢাকার আদালতে মামলা করেন।
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে দল থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাভোগ করছেন।
জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী
আলোচনায় এসেছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ধান গবেষক ও জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। বছরে পাঁচবার ফলন দেবে এমন ধানের গাছ উদ্ভাবন করেছেন তিনি।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রাম। পেশাগত কারণে বিদেশে থাকলেও তার গ্রামে গড়ে তুলেছেন খামার। এই খামারেই দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে এমন ধান উদ্ভাবন করেছেন, যা একবার রোপণে এ ধানের গাছে বছরে পাঁচবার ফলন এসেছে।
বোরো হিসেবে লাগানো ধানের গাছে প্রথম ধান পেকেছে ১১০ দিন পর। ওই গাছেই পর্যায়ক্রমে ৪৫ দিন পরপর একবার বোরো, দু'বার আউশ এবং দু'বার আমন ধান পেকেছে। এক গাছে পাঁচ ফলনের ঘটনা বিরল। বছরের যে কোনো সময়ে এ ধান রোপণ করা যায়।
জানা গেছে, চারটি জাত একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দিচ্ছে। এই চারটি জাতের ওপর ১০ বছর ধরে চলছে গবেষণা।
কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের সন্তান আবেদ চৌধুরী কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। পড়াশুনা শেষে চাকরি নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ পর্যন্ত উদ্ভাবন করেছেন প্রায় ৩০০ রকমের নতুন ধান।
বছরজুড়ে আলোচনায় রাসেল
বছরছুড়ে আলোচনায় ছিলেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ রাসেলক। ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে ই-কমার্স উদ্যেক্তা হওয়া রাসেল গত বছরে (২০২০) একদফা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তলবের মুখে পড়েন।
কিভাবে ২০০ থেকে ৩০০ শতাংশ মূল্যছাড়ে পন্য সরবরাহ করছে ইভ্যালী, আর এতো মূল্যছাড়ের পর প্রতিষ্ঠানটি কোন কৌশলে লভ্যাংশ সংগ্রহ করছে- এমন সব প্রশ্নের মুখে পড়েন তিনি। তবে সে দফায় গানিতিক নানা হিসেব দেখিয়ে পার পেয়ে যান ইভ্যালির কর্ণধর। কিন্তু পরের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালিয়ে রাসেলকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
অনেক গ্রাহক সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়েদেন- রাসেলকে যদি গ্রেপ্তারই করা হবে, তাহলে প্রথম দফায় তলব করেই কেনো তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলো না। অবশ্যই এরপক্ষে গ্রাহকরা যুক্তি তুলে ধরেন, যেহেতু রাসেলকে সেই দফায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সেহেতু গ্রাহকরা ধরে নিয়েছেন ইভ্যালির সার্বিক কার্যক্রম সঠিক নীতি অনুসরণ করেই পরিচালিত হচ্ছে। এরপর গ্রাহকদের ইভ্যালির ওপর আস্থা আরো বেড়ে যায়। বেড়ে যায় বিনিয়োগও। তারপর যতদিনে রাসেলকে গ্রেপ্তার করা হয়, ততদিনে ইভ্যালিতে গ্রাহকদের বিনিয়োগ আরো বেড়ে যায়।
আলোচিত চরিত্র মুরাদ হাসান
বছর জুড়ে আলোচনায় ছিলেন সরকারের সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। এক নায়িকার সঙ্গে অশ্লীল কথা বলার ফোন আলাপ ফাঁস হয়ে যাওয়া এবং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনি জাইমা রহমান সম্পর্কে অশালীন ও বর্ণবাদী কথা বলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ৭ ডিসেম্বর প্রতিমন্ত্রীর পদ হারান ডা. মুরাদ হাসান।
শুধু মন্ত্রীত্বই নয়, আওয়ামী লীগের দলীয় পদও হারিয়েছেন। এখন তিনি কোথায় আছেন কীভাবে আছেন তা কেউ বলতে পারছে না।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মুরাদ হাসান। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে জামালপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হন। দায়িত্ব পান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে।
কিন্তু স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী থাকার সময়ে নানা বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে তারা দূরত্ব তৈরি হয়। ২০১৯ সালে একবার একটি বেসরকারি হাসপাতালে একজন রোগীকে দেখতে গিয়ে ওই হাসপাতালের নিরাপত্তকর্মীদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে যান তৎকালীন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান। এ ঘটনা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানানো হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হারান তিনি।
২০১৯ সালের ১৯ মে ডা. মুরাদ হাসানকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় প্রতিমন্ত্রী হিসেবে। প্রায় ১৭ মাস তিনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
অভিযোগ আছে, এ সময়ে মুরাদ হাসান ‘ধরা কে সরা জ্ঞান’ করেছেন। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। মন্ত্রণালয়ে তার দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেছেন। এমনকি নিজ দপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের নাজেহাল করেছেন, গায়ে হাত দিয়েছেন। তার খারাপ আচরণ ও দুর্ব্যবহারের কারণে অনেকেই তার দপ্তর ছেড়ে চলে গেছেন অন্য মন্ত্রণালয়ে।
গত ৬ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুরাদ হাসানের সঙ্গে চিত্র নায়ক মামনুন হাসান ইমন ও নায়িকা মাহিয়া মাহীর একটি ফোনালাপ ভাইরাল হয়। এ দুটি ঘটনা দেশজুড়ে সমালোচনার জন্ম দেয়। সরকার বিব্রত হয়। তীব্র সমালোচনার মুখে সরকারও মুরাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। ৬ ডিসেম্বর রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক বার্তায় জানান, মুরাদ হাসানকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের পর মুরাদ হাসান দেশ ছাড়তে চেষ্টা করেন। তিনি এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে তিনি কানাডায় প্রবেশ করতে পারেননি। ১২ ডিসেম্বর রাতে তিনি আবারও এমিরেটসেরই একটি ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরত আসেন।
এসএম/এমএ/এনএইচবি/এমপি/কেএফ/এসএন/এএস/জেডএকে