নির্দয় করোনাকালে হারিয়ে গেছেন যারা
স্বজন হারানোর বেদনা ছিল বছরজুড়ে। এটি অস্বাভাবিক নয়। এক সময় মানুষের জীবনাবসান ঘটে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই। কিন্তু নির্দয় মহামারির কারণে যেন মৃত্যুমিছিল শুরু হয়ে গিয়েছিল। একের পর এক জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হারানোর খবরে হাহাকার ছিল বছরজুড়ে।
প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। আবার অনেকের মৃত্যু হয়েছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে। করোনা আক্রান্ত হয়ে মুক্ত হওয়ার পরও কোভিড-১৯ এর অভিঘাতেও প্রাণ হারিয়েছেন কেউ কেউ।
সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, অভিনয়, রাজনীতি, সামাজিক আন্দোলনের অনেক কীর্তিমান চিরতরে হারিয়ে গেছেন করোনাকালে ।
সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়ে কর্মযজ্ঞের আলো ছড়িয়েছেন নানা ক্ষেত্রে, কোনো না কোনোভাবে নিজের পদচিহ্ন রেখে যেতে পেরেছেন-এমন অনেক মহিরূহসহ গুণী ব্যক্তিত্ব হারিয়ে গেছেন করোনাকালে। যাদের অভাব অনেক দিন পর্যন্ত অনুভূত হবে।
এ লেখায় তাদের একবার স্মরণ করা:
রাজনীতিবিদ
এইচ টি ইমাম: স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা। কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। ৮২ বছর বয়সে ৪ মার্চ প্রাণ হারান।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ : সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ও কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন। ৮০ বছর বয়সে ১৬ মার্চ মারা যান।
জিয়াউদ্দীন আহমেদ বাবলু : জাতীয় পার্টির দুই মেয়াদের মহাসচিব, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য। করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি ২ অক্টোবর মারা যান।
জয়নাল হাজারী : ফেনীর বহুল আলোচিত-সমালোচিত রাজনীতিবিদ, তিনবারের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
আব্দুল মতিন খসরু : সাবেক আইনমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি। ১৪ এপ্রিল মারা যান।
জুনায়েদ বাবুনগরী : হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক আমীর, দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব ও শায়খুল হাদিস। ১৯ আগস্ট মারা গেছেন।
এ ছাড়া, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের (মার্কসবাদী) সাধারণ সম্পাদক মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশের সভাপতি সাবেক সাংসদ মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, ঢাকা-১৪ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আসলামুল হক, সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী এ বছর প্রাণ হারিয়েছেন।
গুণীজন
মুশতারী শফী: স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক। শহিদজায়া, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের নেতা। তিনি কিডনি ও রক্তে সংক্রমণসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। ৮৪ বছর বয়সে ২০ ডিসেম্বর মারা যান।
ড. রফিকুল ইসলাম: জাতীয় অধ্যাপক, ভাষা সংগ্রামী, নজরুল গবেষক, বাংলা একাডেমির সভাপতি। ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন। ৮৭ বছর বয়সে ৩০ নভেম্বর মারা যান।
শামসুজ্জামান খান: খ্যাতিমান ফোকলোর গবেষক। বাংলা একাডেমির সভাপতি। বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও জাতীয় জাদুঘরের প্রাক্তন মহাপরিচালক। একুশে পদকে ভূষিত। করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৪ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: জনপ্রিয় কলামিস্ট, লেখক ও গবেষক। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৪০টিরও বেশি। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। ২৩ ফেব্রুয়ারি মারা যান।
আয়েশা খানম: নারী নেত্রী, মহিলা পরিষদের সভানেত্রী। ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৪ বছর বয়সে ২ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আবদুল মতীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এমিরেটাস অধ্যাপক। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১৬ জুলাই মারা যান।
সাহিত্য অঙ্গন
হাসান আজিজুল হক: দর্শনের অধ্যাপক, বাংলা ছোটগল্পের বরপুত্র, প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে ৮২ বছর বয়সে মারা যান।
রাবেয়া খাতুন: চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি একুশে পদক বিজয়ী বাংলাদেশি লেখিকা রাবেয়া খাতুন মারা যান। বেশ কিছুদিন বাধ্যর্কজনিত রোগে ভুগে বনানীতে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
হাবীবুল্লাহ সিরাজী: বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক। সাহিত্যে অবদানের জন্য একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত। ক্যান্সার আক্রান্ত ছিলেন। ৭৩ বছর বয়সে ২৫ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বুলবুল চৌধুরী: একুশে পদকে ভূষিত শক্তিমান এ কথাসাহিত্যিক ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে ২৮ আগস্ট মারা যান।
শেখ আবদুল হাকিম: জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক। ‘মাসুদ রানা’সহ বহু জনপ্রিয় গোয়েন্দা কাহিনির লেখক। ৭৪ বছর বয়সে ২৮ অগাস্ট মারা যান।
এছাড়া গবেষক ও কথাসাহিত্যিক বশীর আল-হেলাল, গোয়েন্দাকাহিনি লেখক আবদুল হাকিম, প্রত্নতাত্ত্বিক লেখক খন্দকার মাহমুদুল হাসান, লেখক ভূঁইয়া ইকবাল এ বছর প্রাণ হারান।
সাংবাদিক
রিয়াজউদ্দিন আহমেদ: নন্দিত সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের চারবারের সভাপতি, অবিভক্ত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি, ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ এবং ‘দ্য নিউজ টুডে’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। একুশে পদকে ভূষিত। করোনা আক্রান্ত হয়ে ২৫ ডিসেম্বর মারা যান।
হাসান শাহরিয়ার: জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি, দৈনিক ইত্তেফাকে নির্বাহী সম্পাদক। ক্যান্সার আক্রান্ত ছিলেন। নিউজউইক, আরব নিউজ, ডেকান হেরাল্ড পত্রিকার বাংলাদেশ সংবাদদাতা ছিলেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে ১০ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মিজানুর রহমান খান: তিন দশক ধরে সাংবাদিকতার মাধ্যমে সংবিধান ও আইন নিয়ে লেখালেখি করে নিজেকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে ৫৩ বছর বয়সে তার অকাল প্রয়াণ ঘটে।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদ: জনকণ্ঠ সম্পাদক ও বীর মুক্তিযোদ্ধ। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। ২২ মার্চ তিনি আকস্মিকভাবে মারা যান।
রফিকুল হক: ‘দাদু ভাই’ হিসেবে পরিচিত শিশু সাহিত্যিক, ছড়াকার, শিশু সংগঠক, নাট্যকার ও সাংবাদিক। মারা যান ১০ অক্টোবর।
শাহীন রেজা নূর: শহিদ বুদ্ধিজীবী সিরাজুউদ্দীন হোসেনের ছেলে, ইত্তেফাকের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ছিলেন। ক্যান্সারের সঙ্গে লড়ে ১৩ এপ্রিল মারা যান।
চলচ্চিত্র জগত
চিত্রনায়িকা কবরী: বাংলা চলচ্চিত্রের ‘মিষ্টি মেয়ে’ খ্যাত অভিনেত্রী। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি। করোনা আক্রান্ত হয়ে ৭০ বছর বয়সে ১৬ এপ্রিল মারা যান।
চিত্রনায়ক ওয়াসিম: ফোক ফ্যান্টাসি আর অ্যাকশন ছবির অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা। ১৯৭৩ থেকে ’৯০ পর্যন্ত ঢাকাই চলচ্চিত্রের শীর্ষ নায়কদের একজন। ১৫২টির মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন। ব্রেন, নার্ভ ও হার্টের সমস্যায় ভুগছিলেন।
এটিএম শামসুজ্জামান: শক্তিমান অভিনেতা, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও কাহিনিকার। কৌতুক অভিনেতা হিসেবে দর্শক হৃদয় জয় করা কিংবদন্তী অভিনেতা। আজীবন সম্মাননাসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ছয়বার। ৭৯ বছর বয়সে ২০ ফেব্রুয়ারি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
শিল্প-সংস্কৃতি
ড. ইনামুল হক: এ দেশের নবনাট্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। খ্যাতিমান অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক ও অধ্যাপক। ৭৮ বছর বয়সে ১১ অক্টোবর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
মাহমুদ সাজ্জাদ: মঞ্চ ও টেলিভিশনের অভিনেতা। করোনা-পরবর্তী জটিলতা ২৪ অক্টোবর মারা যান।
ফকির আলমগীর: এ দেশের পপ সঙ্গীতে ও গণসঙ্গীত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা শিল্পী। ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। একুশে পদকে ভূষিত। করোনা আক্রান্ত হয়ে ৭১ বছর বয়সে ২৩ জুলাই মারা যান।
ফজল এ খোদা: প্রখ্যাত গীতিকবি। কালজয়ী গান ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এর গীতিকার। মৃত্যু হয় ৪ জুলাই।
মিতা হক: রবীন্দ্রসংগীতের গুণীশিল্পী, ছায়ানটের শিক্ষক ও রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। মাত্র ৫৮ বছর বয়সে ১১ এপ্রিল অকাল প্রয়াণ ঘটে।
ইন্দ্রমোহন রাজবংশী: লোকসংগীতের জনপ্রিয় শিল্পী ও গবেষক। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী। বাংলাদেশ লোকসঙ্গীত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা। ৭৫ বছর বয়সে করোনা আক্রান্ত ৭ এপ্রিল মারা যান।
এসএম মহসিন: মঞ্চ ও টেলিভিশনের নিবেদিতপ্রাণ অভিনেতা। একুশে পদকপ্রাপ্ত। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১৮ এপ্রিল সকালে।
ফরিদ আহমেদ: জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সুরশ্রষ্টা ও সঙ্গীত পরিচালক। সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হয়ে ফরিদ আহমেদ মারা যান ১৩ এপ্রিল সকালে।
জানে আলম: এ দেশের পপসংগীতের অন্যতম শিল্পী, ‘একটি গন্ধমের লাগিয়া’ গানের এ শিল্পী ২ মার্চ মারা গেছেন।
মুজিবুর রহমান দিলু: মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকের অভিনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। করোনা আক্রান্ত হয়ে ৬৯ বছর বয়সে ১৯ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এ ছাড়া খ্যাতিমান প্রকাশক ইউপিএলের প্রতিষ্ঠাতা মহিউদ্দিন আহমেদ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও সুরকার অনুপ ভট্টাচার্য, শিল্পী নমিতা ঘোষ, লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ খান, চিত্রশিল্পী সৈয়দ লুত্ফুল হক, নাট্যগবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আফসার আহমদ, আলোকচিত্র শিল্পী গোলাম মুস্তাফা, নির্মাতা-অভিনেতা ও নাট্যকার কায়েস চৌধুরী, নজরুল সঙ্গীতশিল্পী জোসেফ কমল রড্রিক্স ও সঙ্গীতশিল্পী সুব্রত বড়ুয়া এ বছর মারা গেছেন।
ব্যবসায়ী
ব্যবসায়ীদের মধ্যে সিটি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শিল্পপতি দ্বীন মোহাম্মদ, শিল্পগোষ্ঠী আনোয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ার হোসেন, সিকদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান জয়নুল হক সিকদার মারা গেছেন এ বছর।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গুণী ব্যক্তিত্ব প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত কথাশিল্পী বুদ্ধদেব গুহ, বাচিক শিল্পী গৌরী ঘোষ, কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, নাট্যব্যক্তিত্ব স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, কবি শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ।
এপি/এএন/এএস