শব্দ দূষণ ও যানজট থেকে নগরবাসীর মুক্তি কবে?
শব্দ দূষণ আর যানজটে অতিষ্ঠ নগরজীবন। রাস্তায় বের হলেই এই দুই যন্ত্রণার সঙ্গে লড়াই করতে হয় রাজধানীবাসীকে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত রাজধানীর প্রতিটি সড়ক, অলিগলি সর্বত্র গাড়ির হর্ণের বিকট শব্দে কান ঝালাপালা হয় মানুষের। তার সঙ্গে যানজট সেই ভোগান্তি আর যন্ত্রণাকে কয়েক ধাপ বাড়িয়ে তুলে।
কিন্তু নগরীর এই দুই যন্ত্রণা রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। বছর তিনেক আগে সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয় শব্দ দূষণের এসব রোধে একটি কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল। সচিবালয়ের চারপাশের সড়কে বিশেষ করে আব্দুল গণি সড়ক ও সচিবালয় লিংক রোডে শব্দ দূষণ রোধে বেশ কড়াকড়ি আরোপও করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি আর বেশি দূর আগায়নি। বলতে গেলে শব্দ দূষণ রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগই নেই নগরী জুড়ে।
অন্যদিকে যানজটের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। নগরীর যানজট রোধে একেক সময় একেক উদ্যোগ নেওয়া হয়। কখনো ইউটার্ন কখনো বা বাঁশ থেরাপি দিয়ে যানজট রোধ করার চেষ্টা করা হয়।
ফলে শব্দ দূষণ আর যানজট থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না রাজধানী ঢাকাতে বসবাসকারি দুই কোটির অধিক মানুষ।
সাধারণ মানুষের অভিযোগ, দিন যত যাচ্ছে, রাজধানীতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শব্দ দূষণ ও যানজট। প্রয়োজনীয় কাজে রাস্তায় বের হলেই যানজটের কবলে পড়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার সঙ্গে তো শব্দ দূষণ হচ্ছে বোনাস!
খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বাড়ছে যানজট
রাজধানীতে এমনিতেই পিক আওয়ারে অর্থাৎ সকালে অফিস ও স্কুল শুরুর সময়ে এবং বিকালে অফিস ও স্কুল ছুটির পর প্রায় সব সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। সেই ভোগান্তিতে যুক্ত হয়েছে নগর জুড়ে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিদিনই নগরীর কোনো না কোনো সড়ক খোঁড়া হচ্ছে। ওয়াসা, বিদ্যুৎ বিভাগ, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বছর জুড়েই নানান উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়ায় ব্যস্ত। যার ফলে নগরীতে যেমন যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি বাতাসে ধূলাবালি উড়ে নগরীর পরিবেশকে ভারী করে তুলে।
সম্প্রতি রাজধানীর, কারওয়ান বাজার, আজিমপুর, গুলিস্তান, মগবাজার, হাতিরপুল, তেজগাঁও, মহাখালী, আগারগাঁও, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, প্রধান সড়ক থেকে অলিগলিতে সড়ক কাটা। এসব সড়কের কোনো কোনো সড়ক ১০ থেকে ১৫দিন বা তারও বেশি বন্ধ রয়েছে। যার কারণে তীব্র যানজটে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় বাবা হুজুরের গলিতে কথা হয় আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার এলাকার রাস্তায় সেই ঈদের আগে থেকে কাজ চলছে। যা এখনও শেষ হয়নি। রাস্তায় কাজ করার কারণে আমাদের চলাফেরার কষ্ট হচ্ছে।
মিরপুর ১১ নম্বর এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল রাজু বলেন, রাস্তায় বের হলে শব্দদূষণ আর যানজটের শিকার হতে হয়। সময় মতো অফিস যাওয়া যায় না। তা ছাড়া মিরপুরের প্রায় সব রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করে কাজ করা হচ্ছে। সময় মতো এসব কাজ শেষ না হওয়ায় আমাদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী পলাশ আহমেদ বলেন, রাস্তায় এত যানজট ঠেলে এসে ক্লাস করা মোটেও ভালো লাগে না। শব্দদূষণ আর যানজটে অতিষ্ঠ আমরা। এসব দেখার যেন কেউ নেই।
শাহাবাগ মোড়ে ডিউটিরত ট্রফিক পুলিশের সার্জেন্ট আহমেদ রাজু বলেন, আমরা তো সব সময় যানজট নিয়ন্ত্রণে রাখতে কাজ করি। রাস্তার কাজ হলে যানজট বেশি থাকে। যার কারণে চলাচলরত মানুষকে দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। তা ছাড়া যানজেটের থেকে রাজধানীতে শব্দদূষণ এখন বেশি হচ্ছে। শব্দদূষণের কারণে আমাদের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
গুলশানে ডিউটিরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মোহাম্মাদ সাদ্দাম বলেন, যানজট আর শব্দ দূষণ নিরসনে প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোও আমরা নিতে পারিনি। ভিআইপিরা যে বিশেষ ধরনের হর্ন ব্যবহার করেন, সেটাই বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, এসব লোকদের ধরলে বিশেষ বিশেষ মানুষ ফোন করেন, অবশেষে তাদের ছেড়ে দিতে হয়। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে, অন্যথায় এসব বন্ধ হবে না।
এদিকে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকা থেকে ভবিষ্যতে বের হয়ে আসার কোনো সম্ভবনা দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যানজট, পরিবেশ ও শব্দদূষণ এই তিন সূচকে সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেনি দেশের রাজধানী। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নামবিও’র তালিকায় যানজটে ২০১৯ সালে এক নম্বরে থাকলেও করোনাকালে রাজধানীতে যানবাহন তুলনামূলক কম চলায় ২০২১ সালে তার কিছুটা উন্নতি হয়। তবে ২০২২ সালে যানজট, পরিবেশ ও শব্দদূষণের শীর্ষে রয়েছে ঢাকা।
আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’র প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেস্ক বলছে, ২০২১ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ যানজটের শহরগুলোর তালিকায় ২৫০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯ম । তাদের গবেষণার ট্রাফিক ইনডেস্কে সর্বোচ্চ পয়েন্ট ধরা হয় ৩০০। এর মধ্যে বাংলাদেশের পয়েন্ট ২৭৪.৮৭। এই তালিকায় ৩৪২ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস। অন্যদিকে সবচেয়ে কম ৬৯.৪০ পয়েন্ট নিয়ে ২৫০ নম্বরে অর্থাৎ সবচেয়ে কম যানজটের শহর সুইজারল্যান্ডের বাসেল সিটি। এর আগে ২০২০ সালে ২৬০ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকার অবস্থান ছিল ১০। করোনার আগে ২০১৯ সালে ২৯৭ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকা ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ যানজটের শহর। ২০১৭ সালে ৩১৭ পয়েন্ট নিয়ে ঢাকা ছিল দ্বিতীয়।
শব্দ দূষণের বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মো. মোরতুজা আরেফিন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের শহরে যানজট আর শব্দ দূষণ হচ্ছে বড় সমস্যা। যানজটের থেকে শব্দ দূষণ হলো আরও মারাত্মক। শব্দ দূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। এর জন্য অনেকের হার্টের সমস্যা হতে পারে।
এই চিকিৎসক বলেন, শব্দ দূষণের কারণে হৃদরোগ, হৃৎপিণ্ড ও রক্তবাহক মস্তিষ্কসহ নানান ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে। তা ছাড়া রাজধানীতে শব্দ দূষণের কারণে অনেক মানুষ কানে কম শুনতে পায়। বর্তমান এসব রোগীর সংখ্যা বেশি হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী শরীফ জামিল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, শব্দ দূষণ বন্ধ করতে আমাদের তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা এটি বন্ধ করতে পারিনি। আমরা অতিরিক্ত হর্ন দেওয়ার জন্য কোনো ধরনের শাস্তি বা বিধিবিধান করতে পারিনি। স্কুল কিংবা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এমনকি সচিবালয়েও হর্ন বন্ধে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। যার কারণে দিন দিন এসব শব্দ দূষণ বেড়েই চলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এ শহরে এক ঘণ্টার পথ চলতে সময় লাগবে ৫ ঘণ্টা। দিন দিন রাস্তায় এর সময় বাড়ছে। এর কারণ হলো মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি বেড়েছে দিগুন। শব্দ দূষণ প্রতিরোধে সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে তাহলেই পরিবেশ ফিরে আসবে।
তিনি বলেন, তা ছাড়া রাজধানীতে যানজট নিরসনে আমাদের নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বর্তমান ঢাকার রাস্তায় বের হলে মানুষকে বিভিন্ন ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মানুষের এসব ভোগান্তি কমানো জন্য নতুন নতুন পদক্ষেপ দরকার।
তৌহিদুল হক বলেন, দেখা গেছে সড়কেও বিভিন্নি নৈরাজ্য চলে এসব বন্ধ করতে হবে। তা ছাড়া রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি থেকে শুরু করে অনেক ভোগান্তি রয়েছে। এসব সংকট সমাধান না হলে রাজধানীতে যানজট ও শব্দ দূষণ আরও জনদুর্ভোগে পরিণত হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (মিডিয়া) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হাফিজ আল আসাদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজধানীতে শব্দ দূষণ আর যানজট কমানো সম্ভব নয়। নতুন কিছু দরকার। তা ছাড়া রাস্তার কিছু কাজ হচ্ছে এসব ঠিক হলে হয়তো কিছুটা যানজট কমে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (সিনিয়র সরকারি সচিব) কাজী তামজীদ আহমেদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, শব্দ দূষণ আসলেই একেবারে ঢাকা থেকে যাবে না। তার কারণ হলো আমরা এসব দমনের জন্য বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি, এতে তেমন কোনো লাভ হয়নি। মানুষ যদি সচেতন না হয় তাহলে কোনোভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে থেকে এসব বিষয়ে তেমন কোনো সমাধান হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এডিশনাল পুলিশ কমিশনার ট্রাফিক প্রধান মো. মনিবুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রাজধানী ঢাকা একেবারে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে অনেক সংস্থা জানিয়েছেন। নতুন পরিকল্পনা করে ঢাকা থেকে যানজট আর শব্দ দূষণ নিরাসন করা হয়তো কিছুটা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, ঢাকার অধিকাংশ লেন হলো অপরিকল্পিত যা ঠিক করা আমাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব না। নতুন করে পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার আশপাশ বাড়ানো প্রয়োজনন এবং রাস্তায় চলাচলের মানসম্মত পরিবহন বৃদ্ধি করতে হবে। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত গাড়ি কমানো পরিকল্পনার বিষয়টি মাথায় নিয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে। তাহলেই এসব থেকে অনেকটা রেহায় পাওয়া যাবে।
এনএইচবি/টিটি