ফিরে দেখা ২০২১
বুয়েট: এক ছাত্রকে হত্যায় ২০ ছাত্রের মৃত্যুদণ্ড
স্নাতকে ভর্তিচ্ছুদের বেশিরভাগেরই স্বপ্ন থাকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ার। উচ্চ মাধ্যমিকে সেরা ফল অর্জনকারী শিক্ষার্থীর একার স্বপ্ন নয় এটি। এই স্বপ্ন তার পরিবার-পরিজনেরও। এমন স্বপ্ন দেখা মেধাবীদের অতিনগণ্য সংখ্যকই কেবল স্বপ্নের সীমা ছুঁয়ে বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পান।
দেশেসেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্রের যখন অপমৃত্যু হয়, তখন সেই ঘটনায় শোক প্রকাশের ভাষাও হারিয়ে ফেলে পরিবার-পরিজন। আর সেই ছাত্রকে হত্যার দায়ে যখন দেশের শীর্ষ বিদ্যাপিঠের আরও ২০ শিক্ষার্থী মৃত্যদণ্ডে দণ্ডিত হয় এবং পাঁচজনের হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, তখন পুরো শোকাহত হয় শুধু পরিবার নয়, গোটা সমাজ তথা রাষ্ট্র।
তা ছাড়া দেশসেরা এমন সিকিশতক মেধাবীর সামনে যদি সোনালী স্বপ্নের বদলে অপেক্ষা করে ফাঁসির দড়ি বা যাবজ্জীবন কারাবাস, আর তার জন্য যদি দায়ী হয় দেশের রাজনৈতিক নিষ্ঠুর ব্যবস্থা, তখন স্বপ্নভঙ্গের ঝুঁকিতে পড়ে পুরো জাতি।
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় তেমন অভিজ্ঞতারই মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে পুরো দেশ। এ মামলার রায়ে
২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
গত ৮ ডিসেম্বর এ মামলায় অভিযুক্ত ২৫ আসামির সবাইকে দোষী সাব্যস্ত করে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের
বিচারক আবু জাফর কামরুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করেন। আসামিদের সবাই বুয়েটের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের কর্মী। তাদের মধ্যে ২২ জনের উপস্থিতিতে আদালত এই রায় ঘোষণা করে; বাকি তিনজন মামলার শুরু থেকেই পলাতক।
আবরারের বাবা, এ মামলার বাদি বরকত উল্লাহ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এই রায়ে তিনি সন্তুষ্ট। এখন দ্রুত এই রায় কার্যকর হবে, এটাই তার প্রত্যাশা। আর আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট না। আমরা উচ্চ আদালতে যাব। মাস্টারমাইন্ড ও বড় ভাইদের নাম জাজমেন্টে আসা উচিত ছিল।
প্রসঙ্গত বুয়েটের শেরে বাংলা হলের আবাসিক ছাত্র আবরারকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে ছাত্রলীগের এক
নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে বুয়েট। পরে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ হয় ছাত্র রাজনীতি।
রায়ে আদালত বলেছে, 'আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে একে অপরের সহায়তায় শিবির সন্দেহে আবরার ফাহাদ রাব্বির
বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে তাকে হত্যা করেছে… যা বাংলাদেশের
সকল মানুষকে ব্যথিত করেছে। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর কখনও না হয়, তা রোধকল্পে এ ট্রাইবুনালে সকল আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হলো।'
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর সন্ধ্যার পর আবরারকে ওই হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েক ঘণ্টা ধরে
নির্যাতনের পর দোতলা ও নিচতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গায় তাকে অচেতন অবস্থায় ফেলে যায় কয়েকজন ছাত্রলীগকর্মী। ভোরে চিকিৎসক এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আবরার ফেইসবুকে তার শেষ পোস্টে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের করা কয়েকটি চুক্তির সমালোচনা করেছিলেন। বুয়েট ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই যে ফেইসবুকে মন্তব্যের সূত্র ধরে ‘শিবির সন্দেহে’ আবরারকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা সংগঠনটির তদন্তে ওঠে এলে ১২ জনকে বহিষ্কার করা হয়।
গতবছর ১৩ নভেম্বর তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে হত্যার ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে তৈরি করা একটি ভিডিও সাংবাদিকদের দেখানো হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।
আবরারকে কেবল শিবির সন্দেহে ডেকে নেওয়া হয়েছিল, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ ছিল- সেই প্রশ্ন সেদিন
পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে করেছিলেন একজন সাংবাদিক। উত্তরে অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন,
‘শিবির হিসেবে সন্দেহের’ বিষয়টি ছিল আবরারের ওপর নির্যাতনের ‘একটি কারণ’। আসলে বুয়েট ছাত্রলীগের ওই
নেতা-কর্মীরা অন্যদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ‘উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অভ্যস্ত’ হয়ে গিয়েছিল। 'ছোটখাটে বিষয়ে কেউ একটু দ্বিমত পোষণ করলে, কিংবা কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বললে, কিংবা সালাম না দেওয়ার কারণেও এই র্যাগিংয়ের নামে, মানে অন্যদের, নতুন যারা আসবে, তাদের আতঙ্কিত করে রাখার জন্যই তারা এই কাজগুলো করে অভ্যস্ত।'
এসব বিষয় হল বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেখার কথা। কিন্তু তদন্তে পুলিশ হল কর্তৃপক্ষের ‘এক ধরনের ব্যর্থতা’ দেখতে পেয়েছে বলে সেদিন জানান অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল। তিনি বলেন, 'যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা রাজনৈতিক পরিচয়কে শেল্টার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তারা অছাত্রসুলভ আচরণ করেছে।'
মনিরুল সেদিন বলেন, 'তদন্তে উঠে এসেছে, রাত ১০টার পরে আবরারকে নির্যাতন করা শুরু হয় এবং রাত ২টা ৫০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। এর আগে যদি তাকে হাসপাতালে নেওয়া হতো তাহলে হয়তো এমন পরিণতি হতো না।'
আবরার ফাহাদ নিহত হওয়ার পর আন্দোলনে নেমে ১০ দফা দাবি তোলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে
বুয়েট শিক্ষক সমিতি ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও সমর্থন প্রকাশ করেন। তাদের দাবির মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, আবরার হত্যার আসামিদের সাময়িক বহিষ্কার এবং হলগুলোতে নির্যাতন বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এমএ/টিটি/