ফিরে দেখা ২০২১
মেগা প্রকল্পের মধ্যে এগিয়ে আছে পদ্মা সেতু
কোভিডের দ্বিতীয় বছরে এসেও আশার কথা হলো–মেগা প্রকল্পগুলোর কয়েকটার কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি হচ্ছে পদ্মা সেতুতে। তার পরই রয়েছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজও এগিয়েছে আশানুরূপ। একইভাবে মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজও এগিয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এর বিপরীতে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ প্রত্যাশা অনুযায়ী এগোয়নি।
মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে কর্ণফুলী টানেলের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চট্টগ্রামের হাটহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল প্রকল্পের কাজ চলছে বেশ দ্রুতগতিতে।
অন্যদিকে, রাজধানীর কাউলা থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে যে এলিভেটেড বা উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, তার গতি খুব ধীর। নানান কারণে বারবার কাজ বিলম্বিত হওয়ায় এই প্রকল্পে অগ্রগতি আশানুরূপ হচ্ছে না।
দেশের অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে মোটা দাগে এগুলো হচ্ছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প।
২০২১ সালে এই প্রকল্পগুলোর কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে–সবচেয়ে এগিয়ে আছে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প। ২০২২ সালের জুন মাসে সরকার পদ্মা সেতু খুলে দিতে চায় যানবাহন চলাচলের জন্য সে লক্ষ্যে মূল সেতুর কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। ইতিমধ্যে সেতুর উপরের সড়ক কার্পেটিংয়ের কাজ চলছে।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (৩০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হচ্ছে ৮৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর নদী শাসনের কাজ হয়েছে ৮৭ শতাংশ। কোভিডের কারণে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ চলে ধারাবাহিকভাবে। যার ফলে সেতুর কাজে দ্রুত অগ্রগতি হয়।
তবে বিপরীত চিত্র হচ্ছে পদ্মা সেতুর রেল লাইন প্রকল্পে। এই প্রকল্পের কাজ নানান কারণে ধীরগতিতে চলায় আগামী বছরের জুনে সড়ক-সেতু খেুলে দেওয়া গেলেও রেলের অংশ খুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মূল সেতুর রেল লাইনের অংশের কাজ শুরু হতে হতে আরও অন্তত ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে।
মূল সেতুর সকল কাজ শেষ হওয়ার পর সেতু কর্তৃপক্ষ রেলের কাজ করার জন্য সেতুটি বুঝিয়ে দেবেন রেল কর্তৃপক্ষকে। এর আগপর্যন্ত সেতুতে রেললাইনের কাজ বন্ধ থকবে।
তবে রেল মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার পোস্তগোলা থেকে মাওয়া পর্যন্ত অংশে রেললাইন নির্মাণের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে এই অংশ চালু করা সম্ভব। সম্প্রতি মাওয়া সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবনিমিয়কালে এমনটাই জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নুরল ইসলাম সুজন।
পদ্মা সেতুর পর কাজের অগ্রগতির দিক দিয়ে এগিয়ে আছে মেট্রোরেল লাইন-৬ এর কাজ। এই প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময় হচ্ছে ২০২৪ সালের জুন। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কাজের ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের নভেম্বর মাসে দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মেট্রোরেল লাইন-৬ এর কাজের সার্বিক অগ্রগতি হচ্ছে ৭২ দশমিক ৯৯ শতাংশ। আর উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হচ্ছে ৮৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অপরদিকে, আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হচ্ছে ৭১ দশমিক ৮২ শতাংশ।
মেট্রোরেল সূত্র জানায়, করোনাকালীন সময়ে প্রথম বছরে প্রকল্পের কাজ চালিয়ে নিতে বেশ কঠিন অবস্থার মুখোমুখি পড়তে হয়েছিল। তবে ২০২১ সালে এসে এই প্রকল্পের কাজের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। মহামারির কথা মাথায় রেখে সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে বিদায়ী বছরে দিনে-রাতে বিরামহীন কাজ চলছে মেট্রোরেল লাইন-৬। যার ফলে অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখ করার মতো।
বিদায়ী বছরের মাঝামাঝি এসে গত ২৭ আগস্ট প্রথমবারের মতো মেট্রোরেল পরীক্ষামূলক চালু হয় দিয়াবাড়ি ডিপো থেকে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ হয়ে পল্লবী পর্যন্ত। এরপর গত ১২ ডিসেম্বর মেট্রোরেলের একটি ট্রেন পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মতো দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আসে।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আশা করছে, আগামী বছরের ডিসেম্বরে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত যাত্রীদের জন্য ট্রেন খুলে দেওয়া হবে। এই সময়ে মধ্যে এই অংশের অন্যান্য সব কাজও সম্পন্ন হবে বলে প্রত্যাশা প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ এন ছিদ্দিকের।
মেগা প্রকল্পের আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হচ্ছে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প। তিন দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের কর্ণফুলী টানেলের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে। সে লক্ষ্যে দ্রুতগতিতে কাজ এগিয়ে চলছে। ২০২০ সালের আগস্টে টানেলের একাংশের কাজ শতভাগ শেষ হয়। এরপর কোভিড-১৯ মহামারির এই সময়ে গত এক বছরে কাজ এগিয়ে গেছে ধারাবাহিকভাবে। ২০২১ সালের শেষে এসে প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হচ্ছে ৭৬ শতাংশ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে এবং যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়াল সড়ক। পিপিপি’র ভিত্তিতে নির্মাণাধীন এই প্রকল্পের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। তবে র্যাম্পসহ প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৪৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ। রাজধানীর বিমাবন্দর সংলগ্ন কাউনিয়া থেকে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী গিয়ে শেষ হবে।
২০১৭ সালের এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। কিন্তু তহবিল সংকটের কারণে প্রকল্পের কাজে ধীরগতি লক্ষ্য করা যায় শুরু থেকেই। তবে বিদায়ী বছরে এসে বেশ অগ্রগতি হয়েছে এই প্রকল্পের। ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজে সার্বিক অগ্রগতি হচ্ছে ৪০ শতাংশ। আর প্রথম ধাপে বিমানবন্দর সংলগ্ন কাউনিয়া থেকে বনানী পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হচ্ছে ৭৫ শতাংশ।
এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ হলে রাজধানীবাসী কিছুটা হলেও যানজটের কবল থেকে মুক্তি পেতে পারেন। তবে প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে এটা নিশ্চিত করে বলা বেশ কঠিন।
সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক মেগা প্রকল্পে গুরুত্ত্ব দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎখাতকেও। সে লক্ষ্যে নেওয়া বিদ্যুৎ খাতের তিন বড় প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প ও রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প।
এর মধ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজের সার্বিক অগ্রগতি হচ্ছে ৫০ শতাংশ। রূপপুরে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ভিভিআর-প্রযুক্তির রিয়্যাক্টরের দুটি ইউনিট তৈরি হবে। এরমধ্যে প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে অপারেশনে আসার কথা। আর দ্বিতীয়টি আসার কথা ২০২৪ সালে।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে। কিন্তু কাজের অগ্রগতি খুবই ধীর। ২০২১ সাল শেষে এই প্রকল্পের অগ্রগতি বলতে চ্যানেল ও পোর্টের কাজ চলছে। এখানে দুটি ইউনিট হবে। এরমধ্যে একটি ইউনিট ২০২৫ সালে ও অপরটি ২০২৬ সালে চালু হওয়ার কথা। কিন্তু কাজের যে গতি তাতে নির্ধারিত সময়ে চালু হওয়া নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
আরেক প্রকল্প রামপালেও বিদ্যুৎ এর দুটি ইউনিট হবে। এরমধ্যে একটি ইউনিট বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও সেটা আর হয়নি। এখন পত্যাশা করা হচ্ছে ২০২২ সালের মাঝামাঝি চালু হতে।
এনএইচবি/এসএ/