আইনের মারপ্যাচে খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা
২০২০ সালের ২৫ মার্চ মানবিক আবেদন বিবেচনায় এনে দুটি শর্তে কারাগার থেকে মুক্তি পান বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। শর্ত দুটি ছিল, সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত থাকবে এবং এ সময় নিজ বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। অন্যটি হলো দেশের যেকোনো হাসপাতালেও তিনি চিকিৎসা নিতে পারবেন। কিন্তু দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মানবিক কারণে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন।
এরপর গতবছর সেপ্টেম্বরে এবং চলতি বছরের মার্চে আরও দুই দফায় ছয় মাস করে বাড়ানো হয় সাজা স্থগিতের মেয়াদ। এ নিয়ে মোট তিন দফায় ১৮ মাস সেই মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
কারাগার থেকে মুক্তির পর খালেদা জিয়া গুলশানের বাসা ফিরোজায় উঠেন। এরপর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে চলতি বছরের মাঝামাঝি তিনি প্রায় দুই মাস হাসাপাতালে থাকেন। এরপর আরও দুই দফা তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। ৭৬ বছর বয়সী এই সাবেক প্রধানমন্ত্রী আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, ফুসফুস, চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। সর্বশেষ গত ১৩ নভেম্বর ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তার ‘পরিপাকতন্ত্রে’ রক্তক্ষরণ এবং লিভার সিরোসিসের কথা জানান চিকিৎসকরা।
ইতোমধ্যে ‘সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নেই’ দাবি করে তাকে বিদেশে পাঠানোর জন্য কয়েক দফা আবেদন করা হয়েছে তার পরিবারের পক্ষ থেকে। কিন্তু সাময়িক মুক্তির শর্তের বিষয়টি উল্লেখ করে প্রতিবারই তা নাকচ করা হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর আবারও আবেদন করা হয়। লিভার সিরোসিস ধরা পড়ায় খালেদাকে বিদেশে নেওয়ার অনুমতি চেয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে আবারও সরকারের কাছে আবেদন করা হয়। কিন্তু সেখানে আগের মতই বলা হয়েছে, খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়ার ‘আইনি সুযোগ নেই’। বর্তমানে তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
যে ধারায় বাধা খালেদা জিয়া
সিআরপিসির ৪০১(১) ধারায় বলা আছে, যখন কোনো ব্যক্তিকে অপরাধের জন্য শাস্তি দেওয়া হয়, তখন সরকার যে কোনো সময় শর্ত ছাড়াই অথবা শর্তসাপেক্ষে শাস্তি স্থগিত করতে পারে অথবা তাকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তার পুরো বা যে কোনো অংশ স্থগিত করতে পারে।
বুধবার আইরমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, নিষ্পত্তিকৃত কোনো দরখাস্ত আবার পুনর্বিবেচনার কোনো সুযোগ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় নেই। খালেদা জিয়াকে যে শর্তে মুক্তি দেয়া হয়েছে, তিনি এটা মানেন না বলে আবার জেলে গিয়ে পুনরায় দরখাস্ত করতে পারেন।
যদিও একদিন আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, আইন মন্ত্রণালয়ে করা আবেদনটি ২৭ ডিসেম্বর আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এদিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, আইন মন্ত্রণালয়ের মন্তব্যসহ আবেদনটি তিনি পেয়েছেন, এখন পর্যালোচনা করে দেখছেন। তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে বিষয়টি আইনগতভাবে দেখার সুযোগ নেই।
তবে বিএনপির আইনজীবীদের মতে, খালেদা জিয়া তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। মানবিক বিবেচনায় তাকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ সরকার চাইলেই দিতে পারে। অন্য আইনজীবীদের ভাষ্য মতে, খালেদা জিয়া যে শর্তে মুক্তি পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল ৬ মাসের জন্য সাজা স্থগিত থাকবে। সরকার ইতোমধ্যে এ শর্তটি সংশোধণ করে তার মুক্তির মেয়াদ দুই দফা বাড়িয়েছেন। সুতরাং সরকার চাইলে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যেতে পারবেন না বলে মুক্তির শর্তটিও পরিবর্তন করতে পারবে।
তবে আইনমন্ত্রীর যুক্তি হলো, যেহেতু তিনি শর্ত সাপেক্ষে মুক্তিতে আছেন তার আবেদনে সাড়া দিতে হলে খালেদা জিয়াকে আবার কারাগারে গিয়ে আবেদন করতে পারবেন। তখন সরকার চাইলে বিবেচনা করে দেখতে পারে।
জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ফজলুর রহমান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দিতে আইনি কোন বাধা নেই। এ ব্যাপারে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব হিসেব আইনমন্ত্রীকে ওপেন চ্যালেঞ্জ করছি, আমি এই বিষয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে জনসম্মুখে আইনি বিতর্ক করতে চাই। বিতর্কে আমি ফোরামকে সঙ্গে নিয়ে আইন দেখিয়ে দেবো যে, সর্বশেষ যে আবেদন করা হয়েছে, এই আবেদনের ভিত্তিতেই আইনিভবে বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য সরকার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
আইনের ধারায় কি বলা আছে:
ধারাঃ ৪০১। (১) কোন ব্যক্তি কোন অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে সরকার যে কোন সময় বিনা শর্তে বা দণ্ডিত ব্যক্তি যা মেনে নেয় সেই শর্তে তার দণ্ড কার্যকরীকরণ স্থগিত রাখতে বা সম্পূর্ণ দণ্ড বা দণ্ডের অংশ বিশেষ মওকুফ করতে পারবেন।
(২) যখন কোন দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করার জন্য সরকারের নিকট আবেদন করা হয় তখন যে আদালত উক্ত দণ্ড দিয়াছিলেন বা অনুমোদন করেছিলেন সেই আদালতের প্রিজাইডিং জজকে সরকার উক্ত আবেদন মঞ্জুর করা উচিত কিংবা মঞ্জুর করতে অস্বীকার করা উচিত, সে সম্পর্কে তার মতামত ও মতামতের কারণ বিবৃত করতে এবং এই বিবৃতির সাথে বিচারের নথির নকল অথবা যে নথি বর্তমানে আছে সেই নথির নকল প্রেরণ করার নির্দেশ দিবেন।
(৩) যে সকল শর্তে কোন দণ্ড স্থগিত রাখা বা মওকুফ করা হয়েছে তার কোনটি পালন করা হয়নি বলে মনে করলে সরকার স্থগিত বা মওকুফের আদেশ বাতিল করবেন এবং অতঃপর যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত রাখা মওকুফ করা হয়েছিল সে মুক্ত থাকলে যেকোন পুলিশ অফিসার তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করতে পারবেন এবং তার দণ্ডের অনতিবাহিত অংশ ভোগ করার জন্য তাকে জেলে প্রেরণ করা যাবে।
(৪) সেই শর্তে এই ধারার অধীন দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয় যা, যে ব্যক্তির দণ্ড স্থগিত বা মওকুফ করা হয় সেই ব্যক্তি পূরণ করবে অথবা শর্ত এমন হবে যা পূরণে সে স্বাধীন থাকবে ।
(৪ক) এই বিধি বা অন্য কোন আইনের কোন ধারা অনুসারে কোন ফৌজদারী আদালত কোন আদেশ দান করলে তা যদি কোন ব্যক্তির স্বাধীনতা খর্ব করে অথবা তার বা তার সম্পত্তির উপর দায় আরোপ করে তাহলে উপযুক্ত উপধারাসমূহের বিধান এই আদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
(৫) প্রেসিডেন্টের অনুকম্পা প্রদর্শন, দণ্ড স্থগিত রাখা বা কার্যকরীকরণের বিলম্ব ঘটানো বা মওকুফ করার অধিকারে এই ধারার কোন কিছু হস্তক্ষেপ করবে বলে মনে করা যাবে না।
(৫ক) প্রেসিডেন্ট কোন শর্ত সাপেক্ষ ক্ষমা মঞ্জুর করলে উক্ত শর্ত যে প্রকৃতিরই হোক না কেন উহা এই আইন অনুসারে কোন উপযুক্ত আদালতের দণ্ড দ্বারা আরোপিত শর্ত বলে গণ্য হবে এবং তদানুসারে বলবৎ যোগ্য হবে।
(৬) সরকার সাধারণ বিধিমালা বা বিশেষ আদেশ দ্বারা দণ্ড স্থগিত রাখা এবং দরখাস্ত দাখিল ও বিবেচনার শর্তাবলী সম্পর্কে নির্দেশ দিতে পারবেন।
খালেদার স্বাস্থ্যগত অবস্থা:
খালেদা জিয়ার পরিবার সূত্রে জানাগেছে, খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিসে ভুগছেন। তার আর্থরাইটিস, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি এবং ফুসফুসের সমস্যাসহ নানা জটিলতা রয়েছে। এখন উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে না থাকায় এবং জ্বরের কারণে তাকে হাসপাতালে সিসিইিউতে রাখা হয়েছে।
এদিকে খালেদা জিয়াকে দেখতে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে এসেছেন তার প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান। বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার কাছে যান।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাগারে যান খালেদা জিয়া। এর পর অসুস্থ হলে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এর প্রিজন সেলে স্থানান্তর করা হয়। স্বাস্থ্যগত অবস্থার অবনতির কথা উল্লেখ করে তার পরিবারের পক্ষ থেকে দুবার জামিনের আবেদন করা হয়। পরে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মানবিক দিক বিবেচনা করে সাজা স্থগিত করে দুটি শর্তে তাকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয় সরকার।
জেডএকে/