ফিরে দেখা ২০২১
রোহিঙ্গা: ভাসানচরে স্থানান্তর ও মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড ছিল আলোচিত
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, ভাসানচরে জাতিসংঘের সম্পৃক্ত হওয়া এবং মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড ছিল বছর জুড়ে আলোচিত বিষয়। এসব ইস্যু নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বছর জুড়েই তৎপর থাকতে হয়েছে।
বর্তমানে মিয়ানমারের ১১ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছে। মিয়ানমার যাতে তাদের ফিরিয়ে নেয় সেজন্য বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
চলতি বছর ২৪ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। এটা যে বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়, বৈশ্বিক সমস্যা সেটা তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। এজন্য তিনি প্রত্যাবাসনে বিশ্বনেতাদের ভূমিকা রাখার আহবান জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বিভিন্ন সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কার্যকর ভূমিকার বদলে মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াচ্ছে। তিনিও বিশ্বনেতাদের এ ব্যপারে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহবান জানিয়েছেন।
তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চলতি বছর উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হলো সর্বসম্মতিক্রমে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা রেজ্যুলেশন গ্রহণ। রেজ্যুলেশনটি যৌথভাবে উত্থাপন করে ওআইসি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা বলেন, জাতিসংঘে এবারই প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হলো রোহিঙ্গা রেজুলেশন। এই ঘটনা রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতিরই প্রতিফলন।
ভাসানচরে জাতিসংঘের সম্পৃক্ত হওয়া
রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে সরকারের নির্মিত ভাসানচর প্রকল্পে জাতিসংঘের সম্পৃক্ত হওয়া ছিল ২০২১ সালের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। কিন্তু শুরু থেকেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক নানা সংস্থা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছিলো বাংলাদেশকে।
নানা ঘটনা পরিক্রমায় অবশেষে গত ১৮ অক্টোবর ভাসানচরের শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করতে সরকারের ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে জাতিসংঘ। সমঝোতা অনুযায়ী সেখানে মানবিক কার্যক্রমের সমন্বয় করবে জাতিসংঘ।
সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান বলেন, অনেক দিন দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও শেষ পর্যন্ত সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে জাতিসংঘ। এটি যেহেতু বড় বাজেটের ব্যাপার সেজন্য লোকাল এনজিওগুলোই চাইছিলো জাতিসংঘ সম্পৃক্ত হোক।
রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড
চলতি বছর ৩০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের উখিয়ায় লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর সারাবিশ্বে তোলপাড় শুরু হয়। স্থানীয় প্রশাসন তৎপর হয়ে সন্দেহভাজন হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে। এখন মামলটি বিচারাধীন।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর নিন্দা জানিয়ে এবং তার হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করে বিবৃতি দেয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে. ব্লিঙ্কেন ‘পূর্ণ ও স্বচ্ছ’ তদন্তের আহবান জানান। এছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোও বিবৃতি দিয়ে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানায় এবং বিচার দাবি করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য রাখার জন্য ২০১৯ সালে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন মুহিবুল্লাহ। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও হোয়াইট হাউজে সাক্ষাৎ করেছিলেন তিনি।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসার আট লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে মুহিবুল্লাহও বাংলাদেশে আসেন। আশ্রয় নেন কক্সবাজারের উখিয়া ক্যাম্পে। সেই সময় রোহিঙ্গাদের কোনো নেতা ছিল না। মুহিবুল্লাহ গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের ফুটবল মাঠে কয়েক লাখ রোহিঙ্গার গণহত্যাবিরোধী যে মহাসমাবেশ হয়েছিল, তা সংগঠিত করেছিলেন মুহিবুল্লাহ। তার ডাকেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেই বিশাল সমাবেশ।
গণহত্যাবিরোধী ওই সমাবেশ বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছিল। ওই সমাবেশের লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয় এবং তাদের মিয়ানমারে ফেরত যাবার ক্ষেত্রে শর্তগুলো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা।
মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর সংশ্লিষ্টদের ধারনা, রোহিঙ্গাদের নেতৃত্বশূন্য করতেই মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হতে পারে। এই হত্যাকাণ্ডে মিয়ানমারের হাত থাকতে পারে বলেও সন্দেহ করা হয়।
আরইউ/