নিষেধাজ্ঞার পরও বিদেশ গেলেন যারা
অর্থনৈতিক সংকট ও ডলারের ওপর চাপ কমাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরও কেউ কেউ বিদেশ সফরে গিয়েছেন। আবার কেউ কেউ আদেশের মধ্যেই সুযোগ খুঁজছেন।
গত ১২ মে অর্থ মন্ত্রণালয় ওই আদেশ জারির পর ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানসহ ওয়াসার ১১ জন কর্মকর্তা বিদেশে গেছেন। তাকসিম এ খান স্পেনের মাদ্রিদে ‘দ্য গ্লোবাল ওয়াটার সামিট' সহ দু'টি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেখানে গিয়েছেন। তিনি সেখান থেকে আবার নেদারল্যান্ডস-এ যাবেন আরেকটি সেমিনারে যোগ দিতে।
আর ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে তুরস্ক গেছেন ঢাকা ওয়াসার ছয় কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে আছেন প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এস এম মোস্তফা কামাল মজুমদার, আইন কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান, আশরাফুল হাসিব চৌধুরী ও সহকারী প্রকৌশলী সারসিজ আলম ও উপ-সহাকরী প্রকৌশলী হাসান। জানা গেছে এই ছয় কর্মকর্তা ঠিকাদারদের অর্থে সেখানে গেছেন।
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ, সিষ্টেম ম্যানেজার মো.রফিকুল হক, সিনিয়র সিষ্টেম এনালিস্ট মো.ইকবাল জাভিদ ও সহকারী প্রোগ্রামার আল নাহিয়ান তথ্য প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ নিতে পাঁচ দিনের সফরে মালয়েশিয়ায় গেছেন বুধবার সন্ধ্যায়।
শ্রম সচিব এহছানে এলাহী এবং কলকারখানা ও প্রতিষষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক নাসির উদ্দিন আহমেদ শিক্ষাসফরে ছয় দিনের জন্য ডেনমার্ক গেছেন। ১৫ মে থেকে ২১ জুন তারা সেখান থাকবেন। সেখান থেকে যাবেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যাওয়ার কথা।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ১২ কর্মকর্তার এক্সপোজার ট্যুরে স্পেন ও মরক্কো যাওয়ার কথা আগামী জুন মাসে। তাদের জিও এখনো বাতিলের খবর পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে অংশ নিতে ৪৩ জন প্রতিনিধির একটি বহর ১৬ দিনের সফরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় যাওয়ার কথা রয়েছে। সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। সফরে তার মেয়ে, জামাতা ও চাচাতো ভাই সঙ্গী হচ্ছেন। প্রতিমন্ত্রীর পাশাপাশি সরকারের তিনজন কর্মকর্তা তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সুইজারল্যান্ড যাবেন। এই জিও এখনো বাতিল হয়নি।
বিদেশ সফর বন্ধের পরিপত্র জারির পরও বেবিচকের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান স্ত্রীকে নিয়ে সিঙ্গাপুর সফরে গেছেন। সিঙ্গাপুরের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে তার ১৭ মে যাওয়ার কথা থাকলে তিনি দুই দিন আগে ১৫ মে গেছেন।
সরকারি আদেশে জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপারে কিছু বলা নেই। এই সুযোগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম নিউইউর্কে গেছেন মেয়রস মাইগ্রেশন কাউন্সিলসহ আন্তর্জাতিক দু'টি সংস্থার কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকা ছেড়েছেন ১৬ মে। তার সঙ্গে আরো গেছেন তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুজাহিদুল ইসলাম এবং প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী ফরহাদ হোসেন।
গত ১২ মে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক পরিপত্রে বলা হয়, ‘‘কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সকল প্রকার এক্সপোজার ভিজিট,স্টাডি ট্যুর, এপিএ ও ইনোভেশনের আওতাভুক্ত ভ্রমণ এবং ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণসহ সকল প্রকার বৈদেশিক ভ্রমণ বন্ধ থাকবে।’’ এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যয় ব্যবস্থাপনা শাখার আরেক পরিপত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করার কথা বলা হয়।
দুইটি পরিপত্রে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সীমিত শব্দটিও ব্যবহার করা হয়েছে। ব্যখ্যা দেয়া হচ্ছে যে বিদেশ ভ্রমণে রাজস্ব খাত থেকে অর্থ না গেলে সমস্যা নেই৷ কেউ দাবি করছেন পরিপত্র জারির আগে যেসব জিও হয়েছে তাতে বিদেশ সফরে কোনো বাধা থাকার কথা নয়৷ আর যেহেতু সীমিত তাই প্রয়োজনীয়তা থাকলে যেতে পারবেন।
নির্বাচন কমিশনের যুগ্মসচিব মো. আসাদুজ্জামান দাবি করেন, ‘‘আমাদের যে কর্মকর্তারা বিদেশ গেছেন তারা প্রকল্পের টাকায় গেছেন। এখানে সরকারের কোনো অর্থায়ন নাই৷ আর এটা একটা জরুরি প্রশিক্ষণ।”
ওয়াসার তথ্য কর্মকর্তা তারেক মোস্তফা বলেন, ‘‘এমডি সাহেবের বিদেশ যাওয়ার প্রক্রিয়া আগেই করা হয়। আর তার খরচ বহন করছে নেদারল্যন্ডস সরকার।”
কর্মকর্তাদের বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘তারাও এমডি সাহেবের সঙ্গেই গিয়েছেন৷ তাদের খরচও সরকার দিচ্ছে না।”
এদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তথ্য কর্মকর্তা মকবুল হোসাইনও একই কথা বলেন। তিনি জানান, ‘‘মেয়র সাহেব সরকারি খরচে যাননি। আমন্ত্রণকারীরাই তার খরচ বহন করছেন। বিশ্বব্যাংক তার খরচ দিচ্ছে। কর্মকর্তারাও তুরস্ক গেছেন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার এক কাজে। সেখানেও সরকারের অর্থ খরচ হয়নি।’’
জানা গেছে, জুনের মধ্যে বিদেশ সফরে যাওয়ার জন্য কমপক্ষে ৩৫০ জন কর্মকর্তার সরকারি আদেশ (জিও) জারি হয়ে আছে। তবে এরইমধ্যে জিও বাতিলও শুরু হয়েছে। বিশ্ববদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ১২ জন কর্মকর্তার বিদেশ সফর বাতিল করা হয়েছে ১৬ মে এক আদেশে। ওই কর্মকর্তাদের অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিলো।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সাবেক কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘‘সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের একটা মহোৎসব পড়ে গিয়েছিলো।সরকার যে আদেশ জারি করেছে এটা ভালো উদ্যোগ। তবে এটা কঠোরভাবে কার্যকর করা দরকার।’’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থে বিদেশ গেলে সেটা অনৈতিক। যদি সরকারে টাকায় না গিয়ে বাইরের কোনো দেশ বা সংস্থার টাকায় গিয়ে থাকেন তা যেতে পারেন। তবে তা ভালো করে যাচাই করা দরকার।’’
সূত্র: ডয়চে ভেলে