মহাসড়কে বেপরোয়া ডাকাত গ্যাং
ফাইল ফটো
সারাদেশের মহাসড়কে ডাকাতি বেড়ে গেছে বলে মনে করছেন গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য বলছে, দেশের মহাসড়কগুলোতে অহরহ ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা এ সব তথ্য পেয়েছে বলে জানা গেছে।
মহাসড়কগুলোতে ডাকাত ও ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম দিন দিন বেড়েই চলেছে। বেশ কিছুদিন ধরে কোনো না কোনো মহাসড়কে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছেই। ডাকাত চক্রের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পণ্যবাহী গাড়ি থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী বাস, কার, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিকশার চালকরাও।
তবে শিল্পকারখানার পণ্যবাহী গাড়িসহ রাতে চলাচলকারী নাইটকোচ ও নতুন ব্রান্ডের গাড়িগুলোর প্রতি ডাকাতদের সবচেয়ে বেশি টার্গেট। বিভিন্ন এলাকায় কিছুদিন পর পরই হানা দিচ্ছে ডাকাতদল। যদিও পুলিশ বলছে, ডাকাতি রোধে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য এ সব ডাকাত চক্র আগ্নেয় ও ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিত্যনতুন কৌশলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ডাকাত আতঙ্কের কারণে খুবই জরুরি প্রয়োজন ছাড়া রাতে পরিবারসহ মহাসড়কে চলাচল একেবারে কমে গেছে। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এ সব তথ্য জানা যায়।
সূত্র জানায়, দিনের আলোয় কেউ ভ্যান চালক, কেউ ডাব বিক্রেতা, বাসের হেলপার কিংবা ড্রাইভার। রাত নামলেই পাল্টে যায় তাদের রূপ। পরিণত হয় দুর্ধর্ষ ডাকাতে। বাস ভাড়া নিয়ে ঘুরে ঘুরে যাত্রী তোলে। তারপর অস্ত্রের মুখে লুটে নেয় সর্বস্ব। সম্প্রতি ঢাকার সাভারের ব্যাংক টাউন এলাকা থেকে আর বি পরিবহনের একটি বাসে উঠেন মামুন। মুহূর্তেই তার চোখ বেঁধে ফেলেন দুর্বৃত্তরা। টের পান যাত্রী বেশে বাসের সবাই মূলত ডাকাত। পরবর্তীতে মামুনের কাছ থেকে সবকিছুই ছিনিয়ে নিয়ে নিরিবিলি স্থানে ডাকাতরা তাকে নামিয়ে দেন। ডাকাতির ঘটনায় পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বেশ কিছুদিন কোনো না কোনো মহাসড়কে প্রতিদিনই ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আশঙ্কাজনকহারে দিনে এবং রাতে ডাকাত ও ছিনতাইকারীর উৎপাত বেড়েছে। কখনো গাড়িতে যাত্রীবেশে কখনো বা প্রাইভেটকার ও মারুতি মাইক্রোবাসে সংঘবদ্ধ চক্রের কবলে পড়ে অনেকেই সর্বশান্ত হচ্ছে। গত কয়েকদিনে এমন বেশ কিছু অভিযোগ শোনা গেলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা অভিযোগ বা মামলা করেনি। তাতে করে দিন দিন মহাসড়কে ছিনতাই ডাকাতিসহ অনাকাঙ্খিত ঘটনা বেড়েই চলেছে।
গত শুক্রবার (১৩ মে) রাত ২টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ভবেরচর এলাকায় একদল ডাকাত মহাসড়কে গাছ ফেলে রেখে প্রাইভেটকারের গতিরোধ করে অস্ত্রের মুখে যাত্রীদের জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নেয়। এই সময় ডাকাতের অস্ত্রের আঘাাতে এনামুল (৪০) নামের এক যাত্রী মারাত্মক আহত হন।
সাব্বির হোসেন নামের এক যাত্রী বলেন, ঢাকা থেকে লক্ষীপুর ফিরছিলাম। পথের মধ্যে মহাসড়কে গাছ ফেলে রেখে আমার প্রাইভেটকার গতিরোধ করে। পরে ডাকাতরা আমরা সর্বস্ত্র লুটে নিয়ে যায়।
এর আগের রাত গত বৃহস্পতিবার (১২ মে) রাত আড়াটায় কুমিল্লা উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারণ সম্পাদক লিটন সরকার ঢাকা থেকে কুমিল্লা ফেরার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতের কবলে পড়েন। লিটন সরকার বলেন, সাংগঠনিক কাজ শেষ করে কুমিল্লায় ফিরছিলাম। পথের মধ্যে কুমিল্লার দাউদকান্দি সেতুর পশ্চিম পাড় পাখির মোড় এলাকায় ডাকাতরা তার গাড়িটি মহাসড়কে একটি পিকআপভ্যান দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে গতিরোধ করে। তারপর ডাকাতরা পাথর নিক্ষেপ করে গাড়িটির সাইট গ্লাসগুলো ভেঙে আমার সঙ্গে থাকা স্যামসাং ব্রান্ডের দুটি মোবাইল ফোন যার মূল্য এক লাখ ৬১ হাজার টাকা, এ ছাড়াও নগদ দুই লাখ টাকা ডাকাতরা মুহূর্তের মধ্যেই ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এই সময় ডাকাতদের অস্ত্রের আঘাতে গাড়ির ড্রাইভার ইমাম আহমেদ (২৫), গাড়িতে থাকা আমার সহকর্মী মাসুম (২৭), শাখাওয়াত (৩০) মারাত্মক আহত হয়। পরে ঘটনার আধাঘণ্টা পর গজারিয়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও ততক্ষণে ডাকাতরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
গত ১৯ মার্চ কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাইজখার গ্রামের সৌদি প্রবাসী ফারুক হাওলাদার দীর্ঘ ১৩ বছর পর দেশে ফিরে আসেন। তিনি স্ত্রী, দুই সন্তানসহ প্রাইভেটকারে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাঁচপুর কিউট পল্লীর সামনে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গাড়ি থামান। হঠাৎ করে ৬-৭ জনের একটি ডাকাত দল এসে গাড়ির মধ্যে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার একটি স্যুটকেস, নগদ ১২ হাজার টাকা ও ১৪শ সৌদি রিয়াল নিয়ে যায়।
মেঘনা উপজেলার মানিকের চর গ্রামের কবির হামজা। আবুধাবি থেকে বাড়িতে ফেরেন ৯ জানুয়ারি রাতে। তার সঙ্গে ছিল বিদেশি পণ্য, মোবাইল সেট ও স্বর্ণালংকার। মহাসড়কের আষাঢ়িয়ারচর ব্রিজের সামনে তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের গতিরোধ করে মুখোশধারী ডাকাতদল সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়।
এই মহাসড়কে একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটার কারণে অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিটাগাংরোড-চান্দিনার অংশটি। যার ফলে এই মহাসড়ক দিয়ে চলাচল করা সাধারণ মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সন্ধ্যা হলেই এ সড়কে প্রকাশ্যে চলে চুরি-ছিনতাই। কিন্তু আগের তুলনায় এ মহাসড়কে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হলেও এখনো থেমে নেই ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা। হরহামেশাই এসব ঘটনার খবর মিলছে। ছিনতাইকারীরা এতটাই বেপরোয়া যে, তারা খুন করতেও দ্বিধা করছে না। ঘটনার শিকার হয়ে থানা-পুলিশেও জড়াতে চান না অনেক ভুক্তভোগী।
আমিরুল ইসলাম নামের এক বাসচালক জানান, রাতের বেলা এই মহাসড়ক দিয়ে বাস চালাতে ভয় করে। কারণ মাঝেমধ্যে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। গত ১৫ জানুয়ারি রাত সাড়ে তিনটায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাদানীনগর এলাকায় আল আমিন গার্মেন্টসের সামনে ডাকাতির কবলে পড়েন একজন বিদেশ ফেরত যাত্রী। এছাড়া গত ১৯ জানুয়ারি রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সানারপাড়ের পিডিকে পেট্রোল পাম্পের সামনে আবু সুফিয়ান (৩৫) নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় জড়িত থাকা তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানা পুলিশের সূত্রমতে, এ মহাসড়ক থেকে গত মাসে তারা এবং র্যাবের সদস্যরা প্রায় ২০ জন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, এ মহাসড়কে যারা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত আমরা সেসব ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করে মূলহোতাদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করছি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ডাকাতদের সঙ্গে মহাসড়কে চলাচলরত কতিপয় পণ্যবাহী গাড়িচালক ও সহকারীর যোগসাজশ রয়েছে। ওইসব পরিবহনকর্মী পণ্য নিয়ে রওনা দেওয়ার আগেই মোবাইল ফোনে ডাকাতদের তথ্য জানিয়ে দেয়। ডাকাত দলের সদস্যরা নিরাপদে অবস্থান নিয়ে মহাসড়কে ব্যারিকেড তৈরি করে ডাকাতি করে। ডাকাত দলে ১০ থেকে ১৫ জন অংশ নিয়ে ২-৩টি দলে বিভক্ত হয়ে মুখোশ পরে ডাকাতি করে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন ৩০-৩৫ হাজারেরও বেশি যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু ওই মহাসড়কে পুলিশের অপ্রতুল টহলের সুযোগ নিচ্ছে ডাকাতরা। বিশেষ করে ভবেরচর, গজারিয়া, কুমিল্লার চান্দিনা ও ফেনীর লালপুল থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের কুমিরা পর্যন্ত ১২টি পয়েন্টে বেশিরভাগ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ডাকাতরা মালামাল ভর্তি ট্রাক, কাভার্ডভ্যান চালকদের হাত-পা বেঁধে, কখনো হত্যা করে, আবার কখনো অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়। যদিও পুলিশ বলছে, ডাকাতি রোধে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ডাকাতচক্রগুলো আগ্নেয় ও ধারালো অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিত্যনতুন কৌশলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এখন ডাকাত-ছিনতাইকারীদের রাজত্ব। মহাসড়কটির আবদুল্লাহপুর-টঙ্গী থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এলাকায় ডাকাত ও ছিনতাকারীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যানজটে এ মহাসড়কে প্রায়ই ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে ডাকাত-ছিনতাকারীর দৌরাত্ম বাড়লেও মহাসড়কে দায়িত্বে থাকা পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। অথচ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজারো মানুষ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াত করছে। ওই পথে যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীদের বসে থাকতে হয়। আর ওই সুযোগে সাধারণ মানুষের ওপর সংঘবদ্ধ দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেও প্রায় সময় ডাকাতির ঘটনা ঘটে।একইভাবে ঢাকা-রাজশাহী, ঢাকা-সিলেটসহ অন্যান্য অঞ্চলের মহাসড়কগুলোতে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে চলছে।
গাজীপুর মহাসড়কে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, জনবহুল গাজীপুরে বিভিন্ন দূরপাল্লার গাড়ি এসে রাতে অবস্থান নেয়। ওসব দূরপাল্লার গাড়ির হেলপাররা সংঘবদ্ধ হয়ে ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
দেশের পূর্বাঞ্চল হাইওয়ে পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ জানান, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডাকাতিতে নতুন কয়েকটি চক্র সক্রিয়। চান্দিনা, ভবেরচর ও সোনারগাঁও ওই তিন এলাকায় ডাকাতি বেশি হচ্ছে। এ বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে। অপরিচিত প্রাইভেটকার বা গাড়িতে না ওঠাই উত্তম। মহাসড়কে দুর্ঘটনাসহ অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে বেশকিছু স্পটে দিনে রাতে হাইওয়ে পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিবি প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ডাকাতদলকে নিয়ন্ত্রণ আনতে আমরা সব সময় কাজ করছে। তারপরও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে সেগুলো পুলিশের পক্ষ থেকে জোরালো তদন্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে ওই তদন্ত একটি রিপোর্ট দেওয়া হয়নি।
ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে আমরা তৎপর রয়েছি বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
কেএম/আরএ/