ফজলে হাসান আবেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ
ছবি : সংগৃহীত
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ সোমবার (২০ ডিসেম্বর)। ২০১৯ সালের এই দিনে রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ফজলে হাসান আবেদ ৩৬ বছর বয়সে, ১৯৭২ সালে সিলেট জেলায় একটি ক্ষুদ্র ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন; যেটি পরে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে যায়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, বিশেষ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া বিপুল সংখ্যক মানুষকে স্বাবলম্বী করার প্রয়াসে ১৯৭২ সালে তার হাত ধরে বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিসটেন্স কমিটি (ব্র্যাক) নামে ব্র্যাকের কাজ শুরু হয়।
গত ৪৯ বছরে ক্ষুদ্রঋণ, সামাজিক ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে নানা ধরনের বিনিয়োগ সমন্বয়ে ব্র্যাক এখন বিশ্বের বুকে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান বলে দাবি করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটি এশিয়া ও আফ্রিকার ১২টি দেশের ১০ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে ফজলে হাসান আবেদ ১৯৮০ সালে ম্যাগসেসে পুরস্কার, বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার, স্পেনিশ অর্ডার অব সিভিল মেরিট, অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব অরেঞ্জ-নাসাউ, লিও টলস্টয় ইন্টারন্যাশনাল গোল্ড মেডেল ইত্যাদি পুরস্কার পেয়েছেন।
দারিদ্র্য বিমোচনে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের নাইট উপাধিতে ভূষিত হন ফজলে হাসান আবেদ। এ ছাড়া ওই বছর নেদারল্যান্ডসের নাইটহুড ‘অফিসার ইন দ্য অর্ডার অব অরেঞ্জ-নাসাউ’ খেতাবে ভূষিত হন তিনি।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মরহুম সিদ্দিক হাসান এবং মায়ের নাম মরহুমা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। সিদ্দিক হাসান ছিলেন হবিগঞ্জের সাবরেজিস্ট্রার। ফজলে হাসান আবেদের বাবা ও চাচারা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল ও কলেজে লেখাপড়া করেছেন।
তার দাদার নাম খানবাহাদুর মরহুম রফিকুল ইসলাম। তার নানা খানবাহাদুর সৈয়দ মোয়াজ্জেম উদ্দীন হোসেন ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তিনি মন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত কৃষিমন্ত্রী এবং পরে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ফজলে হাসান আবেদের নানাবাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে।
ফজলে হাসান আবেদের বাবা সিদ্দিক হাসানের মামার নাম নওয়াব জাস্টিস স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা। তিনি কলকাতার প্রথিতযশা উকিল ছিলেন। পরে তিনি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নরের নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। তারা এখনকার মন্ত্রিসভার মতো বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সরকার চালাতেন। সৈয়দ শামসুল হুদা ছিলেন এই কমিটির প্রথম ভারতীয় সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা।
শিক্ষা
ফজলে হাসান আবেদ তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর কুমিল্লা জেলা স্কুলে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৫২ সালে পাবনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। পাস করার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পড়ার জন্য ভর্তি হন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া বাদ দিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। তখন ফজলে হাসান আবেদের ছোট চাচা সায়ীদুল হাসান ছিলেন লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাণিজ্য সচিব। ১৯৫৪ সালে স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। দুই বছর লেখাপড়া করার পরে নেভাল আর্কিটেকচার পড়া বাদ দিয়ে অ্যাকাউন্টিংয়ে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৫৬ সালে ফিরে আসেন ইংল্যান্ডে এবং ভর্তি হন অ্যাকাউন্টিংয়ে। ১৯৬২ সালে ‘কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং’-এর ওপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স সম্পন্ন করেন ।
১৯৭০ সালের প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরলেন। তখন গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হচ্ছে। আন্দোলন একটু একটু করে দানা বাঁধছে। প্রতিদিনই মিছিল মিটিং চলছে। এক পর্যায়ে আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠল। শুরু হয়ে গেল ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন। ১৯৭০ সালে শেল অয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স হিসেবে চট্টগ্রামে যোগ দেন। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর উপকূলীয় অঞ্চলে হলো প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মনপুরা এই তিনটি দ্বীপের লাখ লাখ মানুষ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যুবরণ করেছিল। তিনি এবং তার বন্ধু ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, সহকর্মী কায়সার জামান, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আকবর কবীর এবং নটর ডেম কলেজের শিক্ষক ফাদার টিম মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন ত্রাণ বিতরণ করতে মনপুরাতে গেলেন। ‘হেলপ’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে তার মাধ্যমে ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়েছিলেন। সর্বস্ব এবং স্বজন হারানো মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী তুলে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি তারা তৈরি করে দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্যার ফজলে হাসান আবেদ শেল অয়েল কোম্পানির উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইসলামাবাদ ও কাবুল হয়ে লন্ডনে চলে যান। ১৯৭১ সালের মে মাসে লন্ডনে গিয়ে সমমনা বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সম্পৃক্ত হলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইয়ে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তুললেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’ নামে দুটো সংগঠন। অ্যাকশন বাংলাদেশ-এর কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমর্থন আদায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত তৈরি এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত কার্যকলাপ বন্ধের জন্য ইউরোপীয় দেশসমূহের সরকারকে সক্রিয় করে তোলা।
‘হেলপ বাংলাদেশ’-এর কাজ ছিল অর্থসংগ্রহ করে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করা। তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করা, প্রচারণাপত্র বিলি করা, টাইমস অব লন্ডনে লেখা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা, রেডিও ও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া, ইউরোপীয় দেশসমূহের পার্লামেন্ট সদস্যদের আলোচনার মাধ্যমে স্বদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিবিধ কর্মতৎপরতা পরিচালনা করা। এ ছাড়া পথনাটকাভিনয় থেকে শুরু করে তহবিল সংগ্রহসহ নানা ধরনের কাজে তিনিসহ তার বন্ধুরা যুক্ত সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছিলেন।
ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা এবং নেতৃত্বদান
১৯৭২ সালে ফজলে হাসান আবেদ লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এলেন। ফেরার সময় তার লন্ডনের ছোট ফ্ল্যাটটি ৬ হাজার ৮শ পাউন্ড দামে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালেই তিনি যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন অ্যাসিসটেন্স কমিটি সংক্ষেপে ‘ব্র্যাক’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে সুনামগঞ্জের শাল্লা ও দিরাই অঞ্চলে কাজ শুরু করেন। শুরুতে ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা দিয়ে কাজ শুরু করলেন।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১১টি দেশে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় তের কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নের স্পর্শ রেখে যাচ্ছে। ফজলে হাসান আবেদের সুযোগ্য নেতৃত্বই অজস্র প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্র্যাকের অনন্যসাধারণ এই অর্জনকে সম্ভব করে তুলেছে। বস্তুত প্রতিষ্ঠাতার স্বাপ্নিক দূরদৃষ্টি, অদম্য সাহস এবং গতিশীলতা ব্র্যাকের ক্রম অগ্রযাত্রা, নব নব নিরীক্ষা ও সম্প্রসারণের নিরন্তর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে করে গেছে।
ব্র্যাক টানা পঞ্চমবারের মতো বিশ্বসেরা শীর্ষ এনজিও হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এ এক বিশাল অর্জন। সুইজারল্যান্ডের জেনেভাভিত্তিক স্বাধীন গণমাধ্যম সংস্থা ‘এনজিও অ্যাডভাইজার’-এর পর্যালোচনায় এই স্বীকৃতি পেয়েছে ব্র্যাক। ২০১২ সাল থেকে ‘টপ ফাইভ হান্ড্রেড এনজিওস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে এই র্যাংকিং করে আসছে এনজিও অ্যাডভাইজার। র্যাংকিংয়ের বিবেচ্য বিষয় মূলত ৩টি ইনোভেশন, ইমপ্যাক্ট এবং সাসটেইনেবিলিটি। অর্থাৎ, যেসব সংগঠনের উদ্ভাবনী কর্মসূচি বা উদ্যোগ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে টেকসই এবং সুদূরপ্রাসারী প্রভাব রেখেছে, তাদেরই এই র্যাংকিং-এ বিবেচনা করা হয়। সেই বিবেচনায় এ বছরও শীর্ষস্থান অটুট রেখেছে ব্র্যাক।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে এবং ২০০১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন।
টিটি/