মালদ্বীপে ভিসা বন্ধ, প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে অভিবাসীরা
দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে বসরবাসকারী বাংলাদেশিরা ভালো নেই। বিশেষ করে কাজ বা ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া যারা বিভিন্ন সময়ে দালাল ও প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে মালদ্বীপ গেছেন, তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। কাজ নেই। বেকার দিনযাপন করছেন।
অন্যদিকে, গত প্রায় তিন বছর ধরে বাংলাদেশিদের জন্য মালদ্বীপের শ্রমবাজার বন্ধ থাকায় নতুন করে বাংলাদেশি শ্রমিকরা মালদ্বীপে যেতে পারছেন না। এ ব্যাপারে মালদ্বীপ প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরের দিকে তাকিয়ে আছেন। আগামী ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরের কথা রয়েছে।
শুধু ভিসা বন্ধ নয়, মালদ্বীপে বাংলাদেশি শ্রমিকরা যে বেতন পান, তা কাজের তুলনায় অনেক কম। একই কাজ করে বা শ্রম দিয়ে বাংলাদেশিদের তুলনায় অন্য দেশের শ্রমিকরা দুই তিন গুণ বেশি বেতন পাচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে মালদ্বীপে বসবাসকারী বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে যখন শ্রমিকরা মালদ্বীপে আসেন, তখন ভালোভাবে দর কষাকষি করে আসতে না পারায় বেতন কম পায়।
অপরদিকে, শ্রীলঙ্কান, নেপালি বা ভারতীয় নাগরিক মালদ্বীপে গেলে আগেই বেতনের বিষয়ে দর কষাকষি করে নেন। অথবা যে দালালের মাধ্যমে মালদ্বীপে যান, সেই দালাল ব্যক্তিগত স্বার্থে শ্রমিকদের শ্রমমূল্য নিয়ে দর কষাকষি করে না।
মালদ্বীপে বসবাসকারি বাংলাদেশিরা বলছেন, চলতি মাসের ২২ ও ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরের কথা রয়েছে। ওই সময় তিনি যদি মালদ্বীপ সরকারের সঙ্গে একটা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে মালদ্বীপে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার অবাধ করতে পারেন, তাহলে মালদ্বীপে বসবাসকারী ও যারা নতুন করে কর্মসংস্থানের জন্য দেশটিতে যাবেন তারা উপকৃত হবেন। এখন মালদ্বীপে বসবাসকারী বাংলাদেশি কমিউনিটির সবাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মালদ্বীপ সফরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপের জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে পাঁচ লাখ। এর বাইরে বিদেশিদের বসবাস মালদ্বীপজুড়ে। বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বসবাস বাংলাদেশিদের। বিশ্বজুড়ে দেখা দেওয়া অতিমারি কোভিড-১৯-এর আগে মালদ্বীপে বাংলাদেশিদের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। তবে কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো মালদ্বীপেও মানুষ চাকরি হারাতে থাকে। বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে অনেকেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে দেশের পথে পা বাড়ান। করোনাকালে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ হাজার বাংলাদেশি দেশে ফেরত আসেন। তাদের বেশিরভাগই এখন পর্যন্ত দেশেই অবস্থান করছেন।
মালদ্বীপের রাজধানী মালে শহরে প্রায় ২৩ বছর ধরে বসবাস করছেন বাংলাদেশি সজীব হোসেন। তিনি একটি সরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ঢাকাপ্রকাশকে তিনি বলেন, ‘অন্য দেশের তুলনায় মালদ্বীপে বাংলাদেশির সংখ্যা বেশি। কিন্তু তারা ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কান নাগরিকদের তুলনায় বেতন কম পাচ্ছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই কোম্পানিতে একই কাজ করে একজন বাংলাদেশি বেতন পান স্থানীয় মুদ্রায় দুই হাজার রুপাইয়া। সেখানে একজন ভারতীয় বা শ্রীলঙ্কান নাগরিক একই কাজ করে বেতন পাচ্ছেন তিন থেকে চার হাজার রুপাইয়া।’ মালদ্বীপের মুদ্রার নাম রুপাইয়া।
এই বৈষম্যের কারণ সম্পর্কে সজীব হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশি শ্রমিকরা যখন মালদ্বীপে আসেন, তখন তারা বেতন-ভাতা নিয়ে কোনোরকম দেন-দরবার করে না। দালাল যা বলে, তারা তা-ই মেনে নেয়।’
বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা বর্ণনা করে মালে শহরে বসবাসকারী রাকিবুল ইসলাম রকি বলেন, ‘বাংলাদেশি শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে দালালের মাধ্যমে মালদ্বীপ আসেন। দালাল কোনোভাবে তাকে মালদ্বীপ পৌঁছে দিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করে। এর পরপরই দুর্ভোগ শুরু হয় নতুন আসা বাংলাদেশি শ্রমিকের। সে কাজ পায় না। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
মালেতে ১৩ বছর ধরে বসবাস করেন বাংলাদেশি এ আর নাসির। তিনি বলেন, ‘আগের মালদ্বীপ আর বর্তমান মালদ্বীপের মধ্যে অনেক তফাৎ। করোনা পরিস্থিতির পর এখন মালদ্বীপে শ্রমিকের চাহিদা অনেক বেশি। কাজের তুলনায় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এই সময়ে আমাদের দেশের শ্রমিকরা মালদ্বীপে আসতে পারছে না। কারণ আমাদের দেশের শ্রমিকদের জন্য মালদ্বীপের ভিসা বন্ধ রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘নেপালি, শ্রীলংকান ও ভারতীয় শ্রমিকরা খুবই অল্প টাকায় মালদ্বীপে আসতে পারছে। অথচ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভিসা প্রদান বন্ধ থাকায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা আসতে পারছে না।
নাসির ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘আমরা জেনেছি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালদ্বীপ আসছেন। আমরা আশা করি, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশি শ্রমিকদের মালদ্বীপে প্রবেশেধিকার নিশ্চিত করতে মালদ্বীপ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে ভিসা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখানে কাজের অনেক সুযোগ আছে। যদি আমরা সুযোগটা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে বাংলাদেশিরা অনেক কাজ করার সুযোগ পাবে। এখন তো এখানে ভারতীয়, নেপালি ও শ্রীলঙ্কানরা সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশিরা সেই সুযোগ পাচ্ছে না; বরং বাংলাদেশিরা এখানে খুবই অবহেলিত।’
আরেক বাংলাদেশি আল আমিন হোসেন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, ‘দালালদের মাধ্যমে এসে বাংলাদেশিরা প্রতারণার শিকার হন। তারা বিভিন্ন কোম্পানির নামে লোকজনকে নিয়ে আসে। তবে মালদ্বীপে পৌঁছার পর তাদের ছেড়ে দেয়। তখনই সংকটে পড়েন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। আর দালালের মাধ্যম ছাড়া কেউ আসতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যেন মালদ্বীপে আসা বাংলাদেশিরা এ রকম সংকট ও ভোগান্তিতে না পড়ে, সে জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের মালদ্বীপ পাঠানোর উদ্যোগ নিলে ভালো হয়। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেন উদ্যোগ নেন, এমটাই আশা করছি আমরা।’
এনএইচবি/এসএ/