যা বললেন সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হৃদয় মন্ডল, ঝুমন, রসরাজ দাসরা
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় মন্ডল বলেছেন, ‘আমাদেরকে এই পৃথিবীতে একটু শান্তিতে বসবাস করতে হলে প্রথমত দরকার হয় অসম্প্রদায়িক ও মানবিক গুণাবলীর অধিকারী হওয়া। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মতামতকে সন্মান দেখানো। গোটা বিশ্বেই আজ এমন একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যা কিনা মানব সভ্যতার জন্য হুমকি স্বরূপ। এই সকল অপতৎপরতা থেকে সমাজ ও সমাজের মানুষকে রক্ষা করতে সমাজের সুশীল মানুষগুলোকে সঙ্গে নিয়ে সরকারকে কঠোরভাবে অতি দ্রুত মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।’
শুক্রবার (৬ মে) নির্মূল কমিটি আয়োজিত ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৌলবাদীদের সাম্প্রদায়িক জিহাদ প্রতিরোধ’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এ ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়।
উল্লেখ্য, নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ৯৩তম জন্মবার্ষিকী ছিল গত ৩ মে ঈদুল ফিতরের দিন।
ওই ওয়েবিনারে অংশ নিয়ে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার সুনামগঞ্জের ঝুমন দাস বলেন, ‘আপনারা জানেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মৌলবাদীদের উগ্র থাবায় আমি পড়েছিলাম। মামুনুল হকের সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের গঠনমূলক সমালোচনা করে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম ফেসবুকে। এর পরের ঘটনা আপনাদের সবারই জানা আছে। সাত মাস জেল খেটে জামিনে বের হয়েছি আমি। মামলা চালাতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাকে। সুনামগঞ্জ থেকে মামলা এখন সিলেট ট্রাইব্যুনালে, এখন আবার মামলা চলে যাচ্ছে ঢাকায়। আমি আশা করছি, স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র আমাকে এই মামলা থেকে অবিলম্বে রেহাই দেবে। আমাকে নিশ্চিত নিরাপত্তা দেবে এই রাষ্ট্র।’
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রসরাজ দাস বলেন, ‘ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা ফেসবুক আইডি থেকে পবিত্র ‘কাবাঘর’ অবমাননার অভিযোগে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২ মাস ১৬ দিন জেল খেটে কারাগার থেকে বের হয়ে আসি। আমি ৫ বছর ধরে প্রতি মাসে আদালতে হাজিরা দিতে দিতে খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। প্রতি মাসে গ্রাম থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে গিয়ে হাজিরা দিতে যে টাকা খরচ হয় তা বহন করার অবস্থা আমার নেই। আমি রাষ্ট্রের কাছে এই মামলা থেকে বেকসুর খালাস চাই। এই মামলা থেকে রেহাই পেতে চাই।’
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের আরেক শিকার কুমিল্লার অনীক ভৌমিক বলেন, ‘বাংলাদেশ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ১৯৭১ সালের এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল দেশ স্বাধীনের জন্য, কিন্তু আমার জীবনের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে ২০২০ সালের ১ নভেম্বর। সেই দিনটা এখনও আমার মনে পড়ে। ফেসবুকে নির্দোষ একটা লাইক দেওয়ায় কারণে আমার জীবনে অন্ধকার নেমে আসে।’
বাংলাদেশ কৃষক লীগের সিলেট জেলার প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার রাকেশ রায় বলেন, ‘কথিত ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় এক বছর জেল খাটতে হয়েছে আমাকে। ৫ বছর ধরে চলা এই মামলা চালাতে গিয়ে রীতিমতো নিঃস্ব হয়ে পড়েছি।’
সরকারের কাছে আমার দাবি, ‘সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির করা মিথ্যা মামলাগুলো তুলে নিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জয়দেব চন্দ্র শীল বলেন, ‘২০১৭ সালের ১৭ মে মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ভয়ঙ্কর নির্যাতন করে। আমাকে দিয়ে জোর করে ধর্ম অবমাননার কথা বলিয়ে থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ১৮ মে সেই সময়টাতে থানাতেও আমাকে নির্যাতন করা হয়। পরদিন আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে প্রেরণ করা হলেও নির্যাতন থেকে রেহাই পাইনি। নির্মূল কমিটিকে ধন্যবাদ, তাদের সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার বিষয় থেকে রক্ষা পেয়েছি। তবে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আমি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সরকারের কাছে আমার দাবি, আমি আমার মামলা প্রত্যাহার চাই।’
ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘তিনি যে পথ দেখিয়ে গেছেন সেই পথে আমরা চলছি। স্বাধীনতাবিরোধী মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে তাঁর কর্মজীবন আমাদের কাছে পাথেয়।’
তিনি বলেন, মৌলবাদী সন্ত্রাস নির্মূলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা অগ্রণী। আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে তার মাধ্যমে মৌলবাদী সন্ত্রাস নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এ বিষয়ে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে পারি।
মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘ভিকটিমদের কাছ থেকে সরাসরি হয়রানির চিত্র জানতে পেরে এই আয়োজনের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এসব মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক ঘটনা হুমকি স্বরূপ। বাংলাদেশ বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যেভাবে শেকড় গেঁড়েছে বাংলাদেশে তা উপড়ে ফেলা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে যে স্বাধীনতাবিরোধীদের মৌলবাদী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার ভিকটিমদের তাদের মামলার বিবরণ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য নির্মূল কমিটির প্রতি আহ্বান জানান মন্ত্রী।
নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সভাপতিত্বে এই ওয়েবিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফা জব্বার। সেমিনারে ধারণাপত্র পাঠ করেন নির্মূল কমিটির বহুভাষিক সাময়িকী ’জাগরণ’-এর যুগ্ম সম্পাদক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লেখক মারুফ রসুল।
ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে ছিলেন নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ফোরাম ফর হিউম্যানিটি তুরস্ক সাধারণ সম্পাদক লেখক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা শাকিল রেজা ইফতি, সর্ব ইউরোপীয় নির্মূল কমিটির সভাপতি সমাজকর্মী তরুণ কান্তি চৌধুরী, সুইডেনে অবস্থানকারী নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ও জাগরণ-এর যুগ্ম সম্পাদক লেখক সাংবাদিক সাব্বির খান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট লেখক সুইজারল্যান্ডপ্রবাসী অমি রহমান পিয়াল, ‘জাগরণ’-এর হিন্দি বিভাগের সম্পাদক ভারতের সমাজকর্মী তাপস দাস, সাম্প্রদায়িক ভারত থেকে অনলাইন একটিভিস্ট আইনজীবী সালমান আখতার, নির্মূল কমিটি আইটি সেল সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর তন্ময়, ব্লগার এন্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক-এর সভাপতি ড. কানিজ আকলিমা সুলতানা, কলামিস্ট ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সমাজকর্মী লীনা পারভীন, নির্মূল কমিটির আইন সহায়ক কমিটির সদস্য এডভোকেট নাসির মিঞা, নির্মূল কমিটি কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি সাংবাদিক দিলিপ মজুমদার, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার মুন্সিগঞ্জের শিক্ষক হৃদয় মন্ডল, সুনামগঞ্জের ঝুমন দাস, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রসরাজ দাস, কুমিল্লার অনীক ভৌমিক, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্র জয়দেব চন্দ্র শীল বাংলাদেশ কৃষক লীগ সিলেট জেলার প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার সমাজকর্মী রাকেশ রায় ও নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক সমাজকর্মী কাজী মুকুল।
ওয়েবিনারে প্রারম্ভিক বক্তব্যে নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবদেন করে বলেন, ‘তিন দশকেরও অধিককাল পূর্বে আমরা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলাম তার দুটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং স্বাধীনতাবিরোধী গণহত্যাকারীদের ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ কল্যাণ রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তোলা।
আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য আংশিকভাবে সফল হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনও অগ্রগতি হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বিভিন্ন মাধ্যমে ইসলামের দোহাই দিয়ে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মত এবং ভিন্ন জীবনধারার অনুসারী নাগরিকদের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অমুসলিম ও মুক্তচিন্তকদের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংবিধান এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার প্রতি তারা ক্রমাগত বিষোদগার করছে। ইসলাম অবমাননার অপবাদ দিয়ে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে’ তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে এবং তাদের ঘরবাড়ি, পাড়া মহল্লা, গ্রামে হামলা হচ্ছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও মুক্তচিন্তার অনুসারীরা বার বার মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সামাজিকভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। বিনা অপরাধে মাসের পর মাস কারা নির্যাতন ভোগ করছেন বিভিন্নভাবে, বিড়ম্ভিত হচ্ছেন এবং তাদের জীবন-জীবিকা বিপর্যস্ত হচ্ছে।’
নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ বলেন, ‘সাইবার ক্ষেত্র জিহাদ আকৃষ্ট করার নতুন একটি প্লাটফর্ম। জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সাইবার কাউন্টার জিহাদ কেমন করে করতে হবে তার একটি রূপরেখা আমাদের তৈরি করতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমাদের সামনে এগোতে হবে। জঙ্গি গোষ্ঠীরা অনলাইনে একের পর এক জিহাদের মোটিভেশন দিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে প্রতিহত করতে হলে সরকার এবং আমাদের মধ্যে একটি সমন্বয় থাকা দরকার আর সেই সমন্বয়ের মাধ্যমে আমরা তাদেরকে প্রতিহত করতে পারব বলে বিশ্বাস করি।’
এনএইচবি/এসআইএইচ