বাংলাদেশের বন্ধুত্বকে ভারত সবসময় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে: রামনাথ
বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বকে ভারত সবসময় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন সফররত ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।
বৃহস্পতবিার (১৬ ডিসেম্বর) রাতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ এ কথা বলেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশে তিনদিনের সফরে রয়েছেন। আগামীকাল শুক্রবার (১৭ ডিসেম্বর) নয়াদিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন তিনি।
বন্ধুত্বের পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়ন করতে সহায়তা করার জন্য যথাসাধ্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ উল্লেখ করে রামনাথ কোবিন্দ বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা ধারাবাহিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, ছাত্র বিনিময় এবং সহযোগিতার একাধিক ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মকাণ্ড দেখেছি। এগুলো সবই আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সার্বভৌম, সমতা এবং আমাদের নিজ নিজ দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের উপর ভিত্তি করে একটি টেকসই, গভীর বন্ধুত্বের নিশ্চয়তা। আমি আনন্দিত যে, আমাদের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাগুলি এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমার মনে আছে যে, একজন যুবক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নৈতিক সাহসে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। অন্য লাখো মানুষের মতো আমিও তার বজ্রকণ্ঠে এবং সেই সময়ে বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের আকাঙ্খা বহনকারী উপলব্ধিতে বিদ্যুতায়িত হয়েছিলাম। আমার প্রজন্মের লাখো ভারতীয়র মতো, আমরা একটি অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ে উল্লসিত হয়েছিলাম এবং বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাস ও সাহসে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।’
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে রামনাথ কোবিন্দ বলেন, ‘যদি আমাদের অংশীদারিত্বের প্রথম ৫০ বছর অসাধারণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শুরু হয়, যা আমাদের জনগণের মধ্যে একটি গভীর বন্ধুত্ব তৈরি করে, তাহলে সম্ভবত এই সীমাকে আরও বৃদ্ধি করার সময় এসেছে। এটি অর্জনের জন্য আমাদের ব্যবসায়ী, শিক্ষাবিদ এবং বিশেষ করে আমাদের যুবকদের ধারণা, সৃজনশীলতা, বাণিজ্য এবং প্রযুক্তির জগতে যৌথভাবে বিশ্বব্যাপী অগ্রগামী উদ্যোগ তৈরিতে অনুপ্রাণিত করতে হবে।’
স্বাধীনতার এই ঐতিহাসিক ৫০তম বার্ষিকীতে, আমি আপনাদের ১৩০ কোটি ভারতীয় ভাই-বোনদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে রামনাথ কোবিন্দ বলেন, ‘আমরা আপনাদের সঙ্গে এই ঐতিহাসিক দিনটি উদযাপন করছি। পঞ্চাশ বছর আগে, দক্ষিণ এশিয়ার আদর্শিক মানচিত্র পরিবর্তিত হয়েছিল এবং গর্বিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। এই উপলক্ষে আমি বাংলাদেশের কোটি মানুষের, বিশেষ করে নির্যাতিতা মা-বোন-কন্যাদের অবর্ণনীয় দুঃসহ স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাদের আত্মত্যাগ এবং বাংলাদেশের যৌক্তিক দাবিই এই অঞ্চলকে বদলে দিয়েছে।’
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মতো এত মহাকাব্যিক ত্যাগের সাক্ষী মানব সভ্যতা খুব কমই হয়েছে মন্তব্য করে রামনাথ কোবিন্দ বলেন, ‘আপনাদের সংগ্রাম ভারতে যে মাত্রায় সহানুভূতি এবং তৃণমূল-স্তরের সমর্থন লাভ করেছে তার পরিমাণও ইতিহাসে বিরল। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলাদেশের জনগণকে সম্ভাব্য সকল সহায়তা প্রদানের জন্য তাদের হৃদয়-দ্বার উন্মুক্ত করেছে। আমাদের ভাই-বোনদের তাদের প্রয়োজনের সময়ে সাহায্য করা আমাদের জন্য সম্মানের এবং পবিত্র দায়িত্ব ছিল।’
ইতিহাস সর্বকালে আমাদের বন্ধুত্বের এই অনন্য ভিত্তির সাক্ষ্য দেবে মন্তব্য করে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘যে গণযুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। সেই যুদ্ধের কয়েকজন সাক্ষী (ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েরই) এখানে দর্শকদের মধ্যে রয়েছেন। যাদের মধ্যে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতিও রয়েছেন এবং তারা আমাদের বিশ্বাস এবং বন্ধুত্বের শক্তির জীবন্ত সাক্ষ্য, যা পাহাড়কেও টলাতে পারে।’
মুক্তিযুদ্ধের ৫০বছর পূর্তি উদযাপনে তার সফর ও অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশের আমন্ত্রণ একটি অনন্য সম্মান উল্লেখ করে রামনাথ কোবিন্দ বলেন, ‘এটি আমাদের বিশেষ বন্ধুত্বের একটি সত্যিকারের প্রতিফলনও বটে। আমি আনন্দিত যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মতোই, কোভিড মহামারী শুরু হওয়ার পর ভারতের বাইরে আমার প্রথম সফর বাংলাদেশে। মুজিববর্ষ উদযাপনে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমিও সম্মানিত।’
পঞ্চাশ বছর আগে, একটি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাংলাদেশের কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল মন্তব্য করে রামনাথ কোবিন্দ বলেন, ‘কিন্তু তখন সমালোচক, সন্দেহবাদী এবং নিন্দাকারীদের কাছে এটি একটি দূরবর্তী এবং অসম্ভব স্বপ্ন বলে মনে হয়েছিল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট এবং বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যেন মুক্তির সম্ভাবনাকে বাতিল বলে মনে হচ্ছিল। একটি নিষ্ঠুর, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সুসজ্জিত শত্রু, যারা কোনো কিছুতেই থামবে না, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বাংলাদেশের প্রতিকূলতা ছিল অনেক বেশি।’ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণামূলক নেতৃত্ব, সুস্পষ্ট নৈতিক দৃঢ় প্রত্যয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি ন্যায়বিচারের জন্য তার অদম্য দৃঢ়তা ছিল সত্যিকার অর্থে পট পরিবর্তনকারী মন্তব্য করে ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘ফলস্বরূপ, বিশ্ব একটি মূল্যবান শিক্ষা পেয়েছে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছাকে কোনো শক্তি দ্বারা দমন করা যায় না, তা যতই নৃশংস হোক না কেন।’
আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশের পরিশ্রমী ও উদ্যোগী জনগণ বঙ্গবন্ধুর আদর্শগুলো বাস্তবায়ন করছে উল্লেখ করে ভারতের রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমরা গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছি, যা বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বাস্তবায়নের সুযোগও তৈরি করেছে। ভৌগোলিক সুবিধা ও আপনাদের দেশের চমৎকার অর্থনৈতিক সাফল্য সমগ্র উপ-অঞ্চল এবং বিশ্বকে উপকৃত করতে পারে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে একটি ক্রমবর্ধমান ধারণা রয়েছে যে, ঘনিষ্ঠ উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং সংযোগ স্বল্পতম সময়ের মধ্যে সোনার বাংলা গঠনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ। এছাড়া শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন মুক্তযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা। অনুষ্ঠানের প্রতিপাদ্য ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতর্বার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সবশেষে সভাপতির বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
আরইউ/এএন