বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী আজ
ধ্বংসস্তুপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
দীর্ঘ পরাধীনতা আর শোষণের কুহেলী ভেদ করে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় একটি জাতি। নয় মাসের জঠর-যন্ত্রণা শেষে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় একটি নতুন স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। অবসান ঘটে আধিপত্যবাদী বিদেশি শাসন-শোষণ, বঞ্চনা আর নির্যাতনের কালো অধ্যায়ের। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক নদী রক্তের বিনিময়ে আসা বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী আজ।
বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে দেশ স্বাধীনতা দিবস ছাড়াও বিজয় দিবস আলাদা করে উদযাপন করে। এই উদযাপন পেছনে রয়েছে দীর্ঘ আত্মত্যাগের গল্প। যে আত্মত্যাগের গল্পে নায়ক হয়ে রয়েছেন বিপুল সংখ্যক বিপ্লবী আর স্বাধীনতা সংগ্রামী। তিতুমীর-বাঘা যতীন-সূর্যসেন থেকে শুরু করে রফিক-জব্বার, আসাদ-মতিউর, মাওলানা ভাসানী-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।
হাজার বছরের স্বতন্ত্র জাতিসত্ত্বার অধিকারী বাঙালী জাতি কখনো স্বাধীন ছিল না। স্বশাসিত হওয়ার সুযোগ খুব একটা পায়নি এ জাতি। এখানে বর্গি এসে হানা দিয়েছে বারবার। কখনো এসেছে মুঘল, কখনো ব্রিটিশ, সর্বশেষ পাকিস্তান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রাম, নেতৃত্ব-নির্দেশে এক সাগার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। যে স্বাধীনতার ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, নয় মাসের গল্প লাখো স্বজন হারানোর শোকবহ-বিহ্বলতার গল্প, হাজার হাজার নারীর সভ্রম হারানোর গল্প, কিছু বাঙালি নামধারী রাজকার-আলবদর-আলশামসের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। একই সঙ্গে এই গল্প একটি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অজুত বাঙালির জনযুদ্ধের গল্প, বীরত্বে জেগে ওঠার গল্প।
৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই সবুজ-শ্যামল দেশে ৫০ বছর আগে আজকের এই দিনে উদয় হয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সূর্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কুয়াশায় জড়ানো হালকা শীতের বিকেলে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দাম্ভিক পাকিস্তানী সেনারা যে অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে বাঙালীর বুকে, হাতের সেই অস্ত্র পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অধিনায়কদের সামনে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এ দিন মুক্তিবাহিনী ও ভারতী সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে গঠিত যৌথবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের জন্য বেঁধে দেয়া সময় সকাল সাড়ে নয়টা থেকে আরও ছয় ঘণ্টা বাড়ানো হয়। যৌথ বাহিনীর সব প্রস্তাব মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছানো হয় জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের কর্মকর্তা জন আর কেলির মাধ্যমে জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে। ভারতে তখন সকাল নয়টা ২০ মিনিট। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে খবরটি পৌছায় আনুমানিক সকাল ১০টায়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ টেলিফোনে বার্তাটি গ্রহণ করে উর্ধস্বাসে বলে উঠলেন, ‘সবাইকে জানিয়ে দাও, আজ আমরা স্বাধীন। বিকেল চারটায় আত্মসমর্পণ।’
সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। এর আগেই মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়ে কাদের সিদ্দিকীর কাদেরিয়া বাহিনী। পৌষের এক পড়ন্ত বিকেলে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রস্তুত হলো ঐতিহাসিক এক বিজয়ের মুহূর্তের জন্য। ঠিক যেখান থেকে জাতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের সাতই মার্চ বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।
বিকেল চারটায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী ও ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জয়েন্ট কমান্ডিং ইন চীফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এগিয়ে গেলেন ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। জেনারেল অরোরা বসলেন টেবিলের ডান দিকের চেয়ারে। বাম পাশে বসলেন জেনারেল নিয়াজী। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে উপস্থিত রয়েছেন মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান সেনপতি গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার। জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পণের জন্য তৈরি করা দলিল স্বাক্ষর করার জন্য এগিয়ে দেন নিয়াজীর দিকে। তখন বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। জেনারেল নিয়াজী অবনত মস্তকে দলিলে স্বাক্ষর করলেন। রীতি অনুসারে নিজের অস্ত্র কম্পিত হাতে তুলে দিলেন বিজয়ী কমান্ডারের হাতে। সার্বভৌম জাতি স্বাধীনতা অর্জন করে। বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় লাল সবুজের পতাকা। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের নতুন মানচিত্র। নতুন জাতির পিতা তখনো পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। বাঙালির বিজয় পূর্ণতা পায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশ ফিরে আসার মাধ্যমে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও দেশটিকে দাবিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র থেকে যায়নি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রমে যখন দিনাতিপাত করছিলেন জাতির জনক, আঘাত আসে তাঁর উপর। স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। কারাগারে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় চার নেতাকে। স্বাধীন দেশে আবার ফিরে আসে সামরিক শাসন। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী ধর্মন্ধ রাজনৈতিক দলগুলো দেশে আবার রাজনীতি করার সুযোগ পায়। থেকে যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বাঙালি আঘাত খেয়েছে বার বার, কিন্তু কখনও আহত পাখির মতো আর্তনাদ করে থেমে যায়নি, ভেঙ্গে পড়েনি ব্যর্থতার ক্রন্দনে। রুখে দাঁড়িয়েছে গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে। গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে দেশ ফিরেছে গণতান্ত্রিক ধারায়।
সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ। জাতির জনকে কন্যা বিরামহীন পরিশ্রম করছেন দেশকে এগিয়ে নেওয়া। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ‘উদীয়মান সূর্য’ হিসেবে আভির্ভূত হয়েছে। স্বাধীনতার পর ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা পাওয়া দেশটি এখন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। জাতীয় বাজেটের আগে এখন আর অর্থমন্ত্রীকে আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংকের কাছে ধর্ণা দিতে হয় না। স্বনির্ভর জাতি হিসেবে দাঁড়ানের চেষ্টায় রয়েছে। নিজস্ব বাজেটে পদ্মা সেতুর মতো সেতু করার সক্ষমতা অর্জন করেছে। দেশটিকে সাম্প্রদায়িক জঙ্গি রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করার দেশীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রের চরিত্র হিসেবে সাম্য, মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারের যে কথা বলা হয়েছে তা থেকে অনেক দূর রয়েছে দেশ। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দিনদিন বেড়েই চলেছে।
উৎসব আনন্দে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসব উদযাপন করছে বাংলাদেশ। যে উৎসব শুরু হয়েছে গত ২৬ মার্চ থেকে। একই সঙ্গে উদ্যাপন করছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। তবে বৈশ্বিক মহামারি কভিড-১৯ এর কারণে উৎসব উদযাপন করছে সীমিত পরিসরে। বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয়ভাবে ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর দুই দিনের উৎসব আয়োজন করা হয়েছে।
জাতি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবেন মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো লাখো শহীদদের, সম্মুখ সমরে আত্মবিসর্জন দেওয়া মৃত্যুঞ্জয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের। স্মরণ করবে স্বাধীনতার স্বপ্নে একটি জাতিকে অগ্নিস্ফূলিঙ্গে জাগিয়ে তোলা মহান নেতা, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করবে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে নেতৃত্ব দেওয়া প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদসহ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভা ও প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানীকে।
আজ ঢাকায় প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে জাতীয় বিজয় দিবসের সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন। এরপর শ্রদ্ধা জানানো হবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে। শ্রদ্ধা জানানো হবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে। বিএনপি শ্রদ্ধা জানাবে দলের প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানের সমাধিতে। সারা দেশের স্মৃতিসৌধ ও বধ্যভূমিগুলো ভরে উঠবে স্বাধীনতাপ্রিয় বাঙালির শ্রদ্ধার অর্ঘ্য। আজ সরকারী ছুটির দিন। সকল সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারী ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায়। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।