ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৪
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
গরুর গাড়ির ওপর থেকে ভেসে আসে আসমানীর কান্না। গুনগুন শব্দ চারদিকে ছড়ায়। আকাশী ওর কপালে হাত রেখে বলে, থাম মা। এখন কাঁদিস না। তোর শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আমাদের আরও কত পথ হাঁটতে হবে কে জানে, ভারতের সীমান্তে গেলে আমাদের গরুর গাড়ি কি ঢুকতে দেবে?
–আমারও মনে হয় দেবে না। তুমি এখন শান্ত থাক মা। কান্নাকাটি করলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে সোনামণি।
–চাচী, আপনি আমাকে অনেক মায়া করেছেন। এই গাড়িতে চড়ে যেতে না পারলে আমার আব্বা-আম্মা আমাকে নিয়ে গাছতলায় বসে থাকত।
–থাক মা, এসব কথা। আমরা বেনাপোল সীমান্তের কাছে এসেছি। আমরা একবার এই পথে কলকাতা ঘুরতে গিয়েছিলাম। রাস্তাটা আমার চেনা। দুপাশের গাছগুলোর দিকে তাকালে মন ভরে যায়। তাকিয়ে দেখ কত বড় গাছ। মনে হয় একশ বছর বয়স হয়েছে এই গাছগুলোর। এই গাছের ছায়ায় আমাদের দিন ভালো কাটবে।
আসমানী গাড়ির উপর উঠে বসে। যশোর রোডের গাছের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে যায়। সন্তানের মৃত্যু গাছের ছায়ায় মায়া ছড়ায়। দুঃখ চেপে রেখে মনে জোর ফিরিয়ে আনে। নিজেকে বলে, বেঁচে থাকার কঠিন সময় এখন। এই সময়কে পার করতে হবে। হেরে গেলে চলবে না।
গাড়ি এসে থামে সীমান্তে। মারুফ এগিয়ে এসে শাশুড়িকে ধরে বলে, আমি আপনাকে নামাই আম্মা। আপনি আমার ঘাড়ে হাত রাখেন।
আকাশী ওকে ধরে গরুর গাড়ি থেকে নামে। মারুফ আবার সাফিয়াকে বলে, আপনি আমাকে ধরেন চাচী।
সাফিয়া নেমে বলে, আমরা দুজনে এবার আসমানীকে নামাই।
–আমরা দুজনে ওকে কোলে করে নামাব। তুমি যাও।
মারুফ সরে যায়। আকাশী আর সাফিয়া দুজনে ওকে কোলে নিয়ে নামায়। ওর ব্যবহৃত যেসব কাপড় লাগবে সেই পোটলাটা আকাশী নিজের কাছে রাখে। প্রয়োজনে সেগুলো দিয়ে ওর সেবা করতে হবে। মেয়েটাকে নিয়ে এতবড় একটা বিপদ হতে পারে এটা আকাশীর মাথায় ছিলনা। ওর কষ্টে নিজের বুক তোলপাড় করে। তারপরও দুজনে আসমানীকে নামিয়ে দাঁড় করায়। মেয়ের হাত ধরে পার হয় সীমান্ত। এর আগে মারুফের সঙ্গে সীমান্ত পার হয়ে বড় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে বাবুল, নজরুল আর আমিনা। তিনজন লাফালাফি করে বলে, কি সুন্দর, কি সুন্দর!
মারুফ ধমক দিয়ে বলে, এই থাম তোরা। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক।
তিনজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে যায়। বাবুল বলে, আমার খিদে পেয়েছে।
–আমারও খিদে পেয়েছে।
–আমরাও। আমিনা চেঁচিয়ে বলে, গরুর গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হয়েছে সেজন্য বেশি খিদে পেয়েছে।
–ওই যে সবাই আসছে। খাওয়ার ব্যবস্থা হবে।
রবিউল, মোবারক সবাইকে নিয়ে বর্ডার পার হয়। ছেলেমেয়েরা ছুটে আসে, মাগো খিদে পেয়েছে। মাগো ভাত দাও।
আকাশী বলে, আমার হাঁড়িতে ভাত আছে। সবাইকে ভাত দেব।
মারুফ বলে, বাবা-চাচা এই রাস্তার নাম যশোর রোড। এই রাস্তা অনেকদিন ধরে যশোর রোড নামে পরিচিত।
–কিন্তু আমরাতো এখন ভারতে ঢুকেছি?
–ভারতের অংশের নামও যশোর রোড। সামনে তাকিয়ে দেখেন কত শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছে। আমরা নিশ্চয় একটা ক্যাম্প পাব। চলেন এগোই।
–গরুর গাড়ি চলে গেছে। দেখ কত লোক হেঁটে হেঁটে আসছে।
–বাব্বা দেখে মনে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ আসছে। এত মানুষকে কোথায় জায়গা দেয়া হবে।
–ইন্দিরা গান্ধী বুঝবেন কি করতে হবে। চল আমরা আগাই। একটা জায়গা খুঁজে নেই। নইলে আবার ফিরে যেতে হবে কিনা কে জানে?
–না, বাবা এভাবে ভাববেন না। আমরা যখন ঢুকেছি আমাদেরকে টিকে থাকতে হবে। বুকের ভেতর কষ্ট একটাই যে ছেলেটা মরে গেল।
দুহাতে চোখ মোছে মারুফ। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে আসমানী। কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই। ও এখন দরকার ছাড়া একদম কথা বলেনা।
সবাই এগিয়ে গিয়ে একটি বড় গাছের ছায়ায় বসে। শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য যারা আশেপাশে ছিল তারা এগিয়ে আসে। নির্মল বলে, এই গাছের নিচে আপনাদের দুটো তাঁবু করে দিচ্ছি।
–আমরা কি কিছু ভাত পাব?
–পাবেন। ডাল-ভাত-আলু ভর্তা এনে দিচ্ছি। এখানে এর বেশিকিছু খাওয়া হবে না।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আামদের বেঁচে থাকাটাই দরকার।
–আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে মালামাল আসে। আমাদের সব সীমান্তে শরণার্থী ভরে গেছে।
–কি করব? পাক সেনারা গুলি ছাড়া আর কিছু বোঝে না। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ছাড়া ওদের আর আনন্দ নেই। ওরা মানুষ চেনেনা। চেনে শুধু নিজেদের ছবি।
নির্মল সঙ্গে সঙ্গে বলে, আচ্ছা, ঠিক আছে চলুন। আপনাদের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
–আমরা দুটো পরিবার একসঙ্গে এসেছি।
–ঠিক আছে, দুটো ক্যাম্প বানিয়ে দেব।
ওরা তিনজন সামনে হেঁটে যায়। বাকিরা সবাই পেছনে হাঁটে। ওরা সামনে গিয়ে এক জায়গায় থামলে ছেলেমেয়েরা ভাত খাবার জন্য কাঁদতে শুরু করে।
আকাশী বলে, এই তোরা গাছের নিচে বস। আমি তোদের ভাত খাওয়াব। পোটলায় বেঁধে আনা ভাতের হাঁড়ি বের করে ছেলেমেয়েদেরকে থালা দিয়ে বলে, সবাই হাত ধুয়ে নে। আমি ভাত-তরকারি দিচ্ছি।
তারপর আসমানীর দিকে তাকিয়ে বলে, মাগো তুই খেতে আয়। তোর খাওয়া দরকার।
–হ্যাঁ, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে মা।
–আয় বস।
–বসতে কষ্ট হয়। মনে হয় শুয়ে থাকি।
–আমাদেরকে তাঁবু দিলে তোকে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দেব। ভাত খেয়ে নে।
আসমানী ঘাসের ওপর বসে এদিক-ওদিকে মোড়ামুড়ি করে। একসময় ভাতের থালা টেনে নেয়।
একটুপরে নির্মল আর যাদব এসে বলে আপনাদের জন্য একটা তাবু ঠিক করেছি। কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মারুফ বলে, আমি যাব আপনাদের সঙ্গে। বাবা ও চাচাকে নিয়ে যাব।
–হ্যাঁ, আসুন।
একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রবিউল ও মোবারককে নিয়ে মারুফ তাঁবুর কাছে যায়। একই ধরণের তাঁবুর পরিসর। কাছাকাছি করার কোনো সুযোগ নেই।
–বাবা, চাচা আপনারা এখানে থাকেন। আমি সবাইকে নিয়ে আসছি।
যাদব বলে, আপনাদেরকে শরণার্থী কার্ড দেয়া হবে। কাল সকালে নিয়ে আসব আমরা। এখন যাই।
–আচ্ছা বাবারা যাও। কাল দেখা হবে। তোমাদেরকে আশীর্বাদ করি।
নির্মল, যাদব, অসীম হাসতে হাসতে চলে যায়। ছোটদের খাওয়া হলে অবশিষ্ট ভাত সবাই একমুঠো করে খেয়ে ফেলে। তারপর জড়ো হয়ে যে যার তাঁবুর নিচে শুয়ে পড়ে। বেঁচে থাকার স্বস্তিতে আপ্লুত হয় সবাই। শুনতে পায় হেঁটে যাওয়া শরণার্থীর পায়ের শব্দ।
(চলবে)
এসএ/