ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩২
নেই দেশের নাগরিক
‘জেহাদের রক্ত কখনো বিফল হয় না। আল্লাহ ঠিকই চোখ তুলে তাকান। রহম করেন। তিনি যে রহমানের রাহিম। শরীরে রক্ত থাকলেই তো সে রক্ত আর ‘জেহাদের’ রক্ত হয় না? সে রক্তকে তলোয়ার বানাতে হয়। ন্যায়ের তলোয়ার। দুষ্টের দমনের তলোয়ার। আর সে তলোয়ার যখন মৃত্যুর দূত হয়ে বিধর্মীদের ওপর আছড়ে পড়ে, তখনই সে তলোয়ারের বীরত্ব। বিজয়গাঁথা।’
আতিফ নবীর গনগনে বারুদ-মনে বারুদের কাঠির ঠোকা দিল। ‘ভক’ করে জ্বলে উঠল নবী, ‘আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে কুরবানি দিতে আজ আমার এতটুকু কুন্ঠা নেই। কিন্তু, আমার মৃত্যু যেন অন্যের টাকা ইনকামের রাস্তা না হয়ে ওঠে। কেউ যেন আমার মৃত্যুকে তার ব্যবসার হাতিয়ার না করেন।’ একজন কাফেরকে শেষ করেছি। জানি না, ভেতরে আরও কত মীরজাফর ঘাপটি মেরে সলতে পাকাচ্ছেন! আল্লাহর কসম, জানতে পারলে, দেহে জান থাকা অবদি, তাদেরকে খতম করেই ছাড়ব।’
‘যাক, বালুখালি পৌঁছে ফোন করিস। ‘মাথার ফেজ টুপিটা খুলে পকেটে পুরতে পুরতে জিজ্ঞেস করল আতিফ।
‘সেটা যে সম্ভব নয়, তা তুই ভালো করেই জানিস। ‘অ্যাক্সান’এর গোপনীয়তার জন্যেই সেটা সম্ভব নয়। ফোনের ট্র্যাকেকে কোথায় আড়ি পেতে বসে থাকবে, তার তো কোনো ইয়াত্তা নেই। ওখানে তো পদে পদে বিপদ। মরণফাঁদ। ঠিক মতো কলকাঠি নাড়ারই সুযোগ পাওয়া যাবে না হয়ত।’ তাহলে, ‘মিশন’ কমপ্লিট করে ফোন করিস।’
‘যদি বেঁচে থাকি তবে।’
‘আল্লাহর দোহায়, এমন কথা বলিস ন্যা।’ ‘আমার বলা না বলাতে কী যায় আসে। যেটা ‘ঘটনা’ সেটা ‘ঘটনা’। বাস্তবকে তো আর অস্বীকার করতে পারব না? এসব কাজে মৃত্যু যে পানির মতো সহজ। সময় হলে যেমন বৃন্ত থেকে ফুল ঝরে পড়ে, ঠিক তেমনই মরণের সময় হলে, শরীর থেকে খসে পড়ে রুহু।’
‘তুই না বড্ড কঠিন হয়ে উঠছিস।’ ‘না হয়েই বা কী করব, এখন তো যত পাষান হতে পারব, ততই মঙ্গল। তুই কি আমাকে রক্ত-মাংসের মানুষ থেকে শুকনো বাঁশ বানিয়ে দিতে পারিস? কিম্বা পাথরের চাঁই?”
‘আমরা তো ধূপ? নিজে ছাই হয়ে অপরকে সুগন্ধ দিই।’
‘সে সুগন্ধ লোকে নিলেই তো? লোকের যদি গোবর শুঁকা অভ্যাস থাকে, তাহলে তাকে তুই ধূপ কেন, গোলাপের গন্ধ দিলেও বলবে, গোবরের গন্ধই ভালো। সমাজে আজ এই গোবর শোঁকা লোকের সংখ্যাই বেশি। সুতরাং ধূপ হয়ে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে কী লাভ। বরং বারুদ হওয়া অনেক ভালো। লোকে গন্ধও খাবে আবার ঠাপও খাবে। আর আমরা নিজে আগুনের মতো জ্বলতে পারব। ‘কথাটা বলতে বলতে দেওয়াল ঘড়িটার দিকে দৃষ্টি ফেলল নবী। বলল, “সময় হয়ে এল রে। গাড়ি চলে আসবে। রেডি হয়ে নিই।’ বলেই পাশের ঘরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই, কোন দিক দিয়ে যাবি, আতিফ?’
‘লেডা হয়ে যাব। তাহলে নয়াপাড়া কাছে হবে।’
‘ওই লোকটাকে কি আর ফোনে পাওয়া গেছে?’
‘নাহ! অনেকবার ট্রাই করে পাইনি। বলছে, স্যুইচঅফ।’
‘তাহলে, মোবাইলে চার্জ নেই হয়ত। বন্ধ হয়ে গেছে।’
‘আমারও তাই মনে হচ্ছে।’
‘লোকটাকে কন্ট্যাক করা গেলে, তোর অনেক সুবিধা হত। অন্তত
“লোকেশান’টা তো ঠিক জানা যেত। এখন তো তোকে ওখানে গিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতে হবে! আজ তো আবার আবহাওয়ার খবরও খারাপ। ঝড় হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ‘আশ্বিনের ঝড়’ আবার সমুদ্রের ঝুঁটি টেনে তোলে। রাগে ফোঁস ফোঁস করে ওঠে সমুদ্র।”
‘হ্যাঁ, সে খবর রেডিওতে গত রাতে তো শুনলাম। কিন্তু কিছুই তো করার নেই। ঝড়ের ভ্রূকুটি অবজ্ঞা করেই যেতে হবে। ‘প্রকৃতির ঝড়’ আর ‘মৃত্যুর ঝড়’ যতই দোস্তি পাতাক, বেটাকে বাপের কাছে যেতেই হবে। এর কোন মার নেই।’
‘একেই বলে রক্তের টান। তুই এতদিন জেহাদের তালিম নিয়েও এ টান ছাড়তে পারলি না! মানুষ সত্যিই এ টান ছিন্ন করতে পারে না। লতায় না হোক পাতায়, পাতায় না হোক লতায় যুক্ত থাকবেই। এ বন্ধন যে স্বয়ং আল্লাহ বেঁধে দেন। এ খন্ডাবে কে? না জেহাদ না কুরবানি? এ তো আর লোমের সঙ্গে লোমের সম্পর্ক নয়? এ যে নাড়ির সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক। রক্তের কোলাকোলি।“ কন্ঠ কেঁপে ওঠে নবীর। একটু তাড়া দেখিয়ে বলে, “এক পারা কোরান পড়ে নিই। এক্ষণি গাড়ি চলে আসবে।“ উপরের তাক থেকে একটা কাঠের তক্তার ওপরে রাখা কোরানশরীফটা পেড়ে পুব দিকের এই ঘরে একটা খেজুরপাটির ওপরে হাঁটু মুড়ে বসল নবী। পুরো তাকটা বইয়ে গিজগিজ করছে। হাদিস-কোরান আর জেহাদি বইয়ে তিনটে তাকই ঠাসা। নবীর বই পড়ার অভ্যাস চিরদিনই। ছোট থেকেই বই পেলে সে চিবিয়ে খেত। জ্ঞ্যান আহরণের নেশা তার প্রবল। রেহেলে কোরানশরীফটা রেখে, সুর করে কোরান তেলাওয়াত করতে লাগল সে। পাশের দড়ির খাটিয়াটাই পা ঝুলিয়ে বসে শুনতে লাগল আতিফ। সে জানে, কোরান তেলাওয়াত শুনলেও ঢের নেকি। নবীর কন্ঠটা ঘুঘু পাখির মতো মিঠে সুরের।
কিন্তু আজ কেঁদে কেঁদে গলাটা ভেঙে যাওয়াই, ঢেঁকি কুটার মতো বাজছে। দরদি সুর এমন করে উথলে উঠছে, হৃদয়ে কষ্টের কাঁটা খচ খচ করে বিঁধছে। নবী যেন আরবি ভাষায় কাঁদছে। শুকনো ঘা’এর চামড়া যেমন পড়পড় করে উঠে যায়, মনের যন্ত্রণাটাও যেন গলার স্বরথলিতে এসে পড়পড় করে ছিড়ে যাচ্ছে। খাটে পা ঝুলিয়ে কান খাড়া করে নবীর কোরান তেলাওয়াত শুনতে শুনতে আতিফের মাথায় ভিড় করে ‘বদরের যুদ্ধ’, ‘উঁহুদের যুদ্ধ’ আর ‘খন্দকের যুদ্ধ’এর কথা। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করতে স্বয়ং নবী রসুল হযরত মহম্মদকেও যুদ্ধ করতে বাধ্য হতে হয়েছিল! সুতরাং যুদ্ধ পৃথিবীতে আজ নতুন কিছু নয়। হিংসাও এই দুনিয়ার নতুন ফসল নয়। ‘অন্যায়কে’ প্রতিহত করতে, বিধর্মীকে খুন করতে, ‘আল্লাহর দ্বীন’ প্রতিষ্ঠা করতে, মাঝে মধ্যে যুদ্ধ করতেই হয়। ‘অসত্যের’ বিরুদ্ধে ‘সত্যের’ অস্ত্র তুলে নিতেই হয়। গোটা ঘর জুড়ে কোরান তেলাওয়াতের মিঠে সুর আর আতিফের মাথায় তিড়বিড় করা মরু যুদ্ধে আরবীয় উটের খুড়ের আওয়াজ ফুঁড়ে কানে ভেসে এল দরজায় ঠোকা মারার খটখট শব্দ। নবী কোরান তেলাওয়াত থামিয়ে, কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “মনে হয় গাড়ি চলে এসেছে!” খাট ছেড়ে তড়াক করে উঠে পড়ল আতিফ। “তুই যে এখনও রেডি হোসনি!” নবী বলল, “তুই ড্রাইভারকে একটু অপেক্ষা করতে বল, আমি ফট করে রেডি হয়ে নিচ্ছি।’
“আচ্ছা।“ বলে গডগড করে দরজার দিকে পা বাড়াল আতিফ। নবী কোরানশরীফ’টাকে বার কয়েক চুমু দিয়ে গুটিয়ে, রেহেলটাকে ভাঁজ করে, ওপরের তাকে রেহেলটার ওপরে কোরানশরীফ’টাকে যত্ন করে রেখে দিল। ‘কচ’ করে দরজা খুলল আতিফ। চৌকাঠ দিয়ে ঘরে সাধাল সদ্য ফোটা হলুদ সকাল। “আসমানের মতিগতি ভালো ঠেকছে না! মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে।“ ঘাড় কাত করে চুলের হিপ্পি পেছনের ঘাড়ে ঠেকিয়ে চোখ আকাশের দিকে তুলে বলল মতি। “আশ্বিনের ঝড়! এ ফাঁড়া মনে হয় আর কাটবে না!” চোখ ঘোলা ডিমের মতো পাকিয়ে উঠল নুহুর। মতি অন্ধকারে কিছু একটা হাতড়াতে হাতড়াতে ঢুঁড় সাপের মতো ফুঁসে উঠল, “পাটের দড়িটা কোথায় রেখেছিস?”
“ওই তো, ওখানে, তোমার পেছনে যেখানে পানি ছ্যাকা টিনটা আছে, তার মধ্যে পুরা আছে।“ গলায় ঢোল পিটিয়ে বলল নুহু। তারপর ট্যারা চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, “যেখানে সেখানে খুঁজলেই হল? যেখানকার জিনিস সেখানে তো খুঁজতে হবে? তা না করে ফালতু ফালতু মাথা গরম করছে!”
“আরিফা, লম্পটা কি আরেকবার কোন কিছু করে জ্বালানো যাবে?” জিজ্ঞেস করল মতি। “দেখছি, জ্বলে কি না।” ঘোমটা টানল আরিফা। ঘোমটার আড়াল দিয়ে মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়ল চুলের মতো কালো অন্ধকার। সন্ধ্যা কেবলই পা ফেলছে। হাতের নাগালেই ছিল কুপিটা। কিছুক্ষণ আগেই একবার জ্বালিয়েছিল আরিফা। তেল নেই। তলানিতে যেটুকু আছে, তাতে আলো জ্বালিয়ে অন্ধকার খোঁজায় হবে। কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না। দিয়াশলাইয়ের কাঠিটা ঠুকে যেই সলতেটায় ঠেকিয়েছিল, অমনি ‘দপ’ করে জ্বলে ‘ফুস’ করে নিভে গেছিল শীখাটা। মুখে আলো ঝলসানোর বদলে সলতে পোড়া ঝাঁঝালো গন্ধের একটা কালো ধোঁয়া নাকে-চোখে লেগেছিল। আরিফা আঁচল চোখে-মুখে দিয়ে একবার জোরে ‘হাচ্চি’ করে উঠেছিল। স্বামীর কথায় সেই তেলহীন তলা পুড়ে খাক হওয়া কুপিটা আবারও জ্বালানোর চেষ্টা করল আরিফা। যেই ‘ঘ্যাঁচ’ করে দিয়াশলাইয়ের খোলে কাঠিটা ঠুকে ‘ছ্যাঁক’ করে জ্বলে ওঠা আগুনের শীখাটা কুপির পোড়া সলতেতে ঠেকালো, অমনি ন্যাকড়া দিয়ে বানানো সলতেটা মিহি করে জ্বলে উঠে ‘ফুস’ করে নিভে গেল। মুহূর্তের জ্বলে ওঠা ‘আলো’টাকে হাঙরের মতো হাঁ করে থাকা অন্ধকার যেন ‘গব’ করে গিলে খেয়ে নিল। আলো না হলেও, ক্ষণিকের জ্বলে ওঠা আলোতে টিনের মধ্যে রাখা পাটের দড়িটা আবছা করে দেখতে পেল মতি। একটিন অন্ধকারে হাত ঢুকিয়ে দড়িটা বের করল সে। গোল করে জড়িয়ে বাঁধা আছে। হাতের আন্দাজে দড়ির জুড়েল ছাড়াল সে। নুহুকে বলল, “দড়িটা ধর।“ বলেই দড়ির একমাথা ছইয়ের ওপর দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। মাথাটা ছইয়ের ওপারে নৌকোর খোলে ‘ছড়াক’ করে পড়ল।
“এ কী করছ!” তড়াক করে উঠল নুহু। “তোর তো কোন হুশ বুদ্ধি আছে, যে বুঝতে পারবি? ঝড় উঠবে, তাই টাপাটাকে পোক্ত করে নৌকোর সাথে বাঁধছি।“ “ও, আচ্ছা।“ মাথা নড়াল নুহু। বলল, “আকাশ যেভাবে হাঁড়ির কালির মতো কালো হয়ে উঠছে, তাতে ভয়ংকর ঝড় হবে বলে মনে হচ্ছে!”
চলবে...
চলবে...
আগের পর্ব পড়ুন