ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৬
স্নানের শব্দ
সকালে গাড়ি থেকে নেমে লিফটের সামনে আসার আগেই মাঝবয়সী সিকিউরিটি গার্ড তার হাত কপালে ঠেকিয়ে লম্বা সালাম ঠুকে দেয়। জুনিয়ররা সমীহ করে সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়, লিফটে ওঠার জন্য পথ ছেড়ে দেয়। মাথা উঁচু করে, শিরদাড়া সোজা রেখে দৃঢ় পায়ে নিজের অফিস কক্ষে ঢুকতে ঢুকতে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে এসব কিছুর জন্য কৃতজ্ঞতা জানায় শবনম। রাজবাড়ি শহরের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা সাধারণ মেয়ে থেকে বর্তমানে যে অবস্থানে সে উঠে এসেছে এটা সত্যি মাঝে মাঝে নিজের কাছেও অবিশ্বাস্য মনে হয়। ছোটবেলায় তার খেলার সাথীরা বেশিরভাই বিয়ে শাদি করে ইতোমধ্যে নানী দাদী হয়ে বসে আছে। দুয়েক জন বড়জোর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক বা কলেজের অধ্যাপিকা হয়েছে। সেই তুলনায় তার সাফল্য তো আকাশ ছোঁয়া।
বান্ধবীদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে একটু কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়, ‘দোস্ত তোমার সাফল্যের ম্যাজিক কী?’
শবনম হাসে, আসলে সে জানে, সফল হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট মন্ত্র নেই। পরিশ্রম, একাগ্রতা, দক্ষতা, যোগ্যতা তো লাগেই পাশাপাশি খানিকটা কৌশলী বা বুদ্ধিমতিও হতে হয় বৈকি। লাক ফেভার করার কথাও অনেকে বলেন। হ্যাঁ, ভাগ্যকে হয়তো একেবারে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আবার সবই যে শুধুই ভাগ্যের জোরে হয়েছে-সেটাও বলতে চায় না শবনম।
কয়েকদিন আগে একটা অনুষ্ঠানে শবনমের আগের অফিসের এক পুরনো সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ভদ্রমহিলা কিছুদিন আগে চাকরি ছেড়েছেন। খুব দুঃখ করে ঠোট উল্টে তিনি বলেছিলেন, ‘জানো, আজকাল কিছু মেয়ে এসেছে, অবশ্য আজকালই বা বলি কেন, সবসময়ই এরা ছিল। রুমানা কবিরের কথা মনে আছে না তোমার? যারা নিজেদের রূপ যৌবনকে পুঁজি করে উপরে উঠার ধান্দা করে, উঠেও যায়, ধপ করে গিয়ে বসের কোলে বসে পড়ে। বসের সঙ্গে ইনিয়ে বিনিয়ে সম্পর্ক পাতায়, বিদেশ ট্যুরে যায়, উপরে উঠবার জন্য হেন কাজ নাই যা তারা করতে পারে না। ফলে আমরা যারা এসব করি না, তারা পিছিয়ে পড়ি, কিংবা বসরা ভাবে সব নারীরাই বুঝি একই রকম।’
রুমানা কবিরের কথা মনে আছে শবনমের। খুবই উচ্চভিলাষী ক্যারিয়ারিস্ট একটা মেয়ে ছিল সে, চটপটে, হাসিখুশি, সুন্দরী। তবে কাজের চাইতে পুরুষদের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়াতেই তার ছিল প্রবল আনন্দ, যখন যে পুরুষ কলিগের সঙ্গে কথা বলতো, বিশেষ করে উচ্চপদস্থদের সঙ্গে, তখন এমন ভাব দেখাতো যেন নির্ঘাত তার প্রেমে পড়ে গেছে। চোখে মুখে শরিরী ভাষায় এক আকুল ব্যাকুল প্রেমিকারূপ ফুটিয়ে তুলে দিব্যি নিজের স্বার্থ হাসিল করতে পারদর্শী ছিল রুমানা।
‘আমার কী দোষ বল। একটু হাসি ঠাট্টা করলেই যদি পুরুষ মানুষ প্রেম ভেবে নেয়, কলস উপুড় করে সব ঢেলে দিতে চায়, তো আমি কী করব? আমি করি ফ্রেন্ডলি আচরণ, তারা ধরে নেয় প্রেমলি আচরণ! হি হি হি!
সেই রুমানা এখন এসব কিছু বাদ দিয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকে আমেরিকা। সন্তান লালন পালন আর সংসার যাপন করেই দিন কাটে তার।
শবনমের চরিত্রের মধ্যে কেন যেন কখনোই এমন ছলাকলা দেখানো ফ্রেন্ডলি ভাব আসে না। বরং সে একটু বেশি মাত্রায় গোছানো, স্থির এবং গম্ভীর। ফলে অফিসের কেউ কেউ তাকে রাগী বা অহংকারী ও ভাবতে পছন্দ করে। প্রাক্তন সহকর্মীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে শবনম বলেছিল, ‘দেখেন যারা এমন করে তারা আবার হঠাৎ করে প্রফেশন থেকে হারিয়েও যায়, শেষ পর্যন্ত কাজের লোকরাই টিকে থাকে।’
‘নারে ভাই, আমি কি টিকতে পারলাম? বাধ্য হলাম চাকরি ছাড়তে, অপমান, অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর কত সহ্য করা যায়? সবাই তেল পছন্দ করে। তোষামুদি না করলে কোনো উন্নতি হয় না। আর নারী হলে তো কথাই নেই, তাকে হেসে কথা বলতে হবে, দুয়েকবার ওড়নার ঝাপটা দিতে হবে, নইলে ইচ্ছা করে বুক থেকে শাড়ির আঁচল ফেলে দিতে হবে। ’
ভদ্রমহিলা কিছুতেই তার নেতিবাচক চিন্তার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে রাজি হন না বরং কে কী অপকর্ম করে পদ-পদবি বাগিয়ে নিচ্ছে সেই লিস্ট আরও লম্বা করতে থাকেন। ফলে তার সঙ্গে আর বৃথা তর্কে জড়াতে চায়নি শবনম। থাক বাবা যে যার বিশ্বাস নিয়ে যেভাবে ইচ্ছা সুখে বা অসুখে থাকুক।
শবনম নিজের ঘরে বসে চুপচাপ কফির কাপে চুমুক দেয়। আগামী সপ্তাহে বোর্ড অফ ডিরেক্টরসের মিটিংয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। তার মানে যা করার তা এই সপ্তাহের মধ্যেই করতে হবে। মনিরুজ্জামানরা কতখানি কী করতে পেরেছে কে জানে? নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ওসমান গণির দুর্নীতির প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্যভাবে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। এদিকে মিটিংএর তারিখ ঘোষণার পর থেকে ওসমান গণির ভাবসাব চালচলন প্রায় সবই বদলে গেছে। যেন সে কোম্পানীর অঘোষিত সিইও হয়েই গেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। অফিসে গুঞ্জন আছে ওসমান গণি বোর্ড মেম্বারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তোয়াজ তোষামোদী করে পদোন্নতির প্রতিশ্রুতি আদায় করে ফেলেছে। ফলে তার চলা ফেরায়, আচার ব্যবহারে স্পষ্টতই কাউকে তোয়াক্কা না করার একটা দুর্বিনীত উদ্ধত ভঙ্গি ফুটে উঠেছে। আমিই প্রধান, আমাকে সবাই মান্যিগণ্যি করে চলো- এমন একটা হাব ভাব ধরে যেন মাটির চার আঙ্গুল উপরে চলা ফেরা করছে ওসমান গণি।
‘তোমরা কী করতেছো মনিরুজ্জামান? হাতে তো বেশি সময় নেই। যা শুরু করেছে, ওসমান গনিকে আর তো সহ্য করা যাচ্ছে না।
শবনম নিজের রাগ, ক্ষোভ আর কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে শেষ পর্যন্ত নিজেই মনিরুজ্জামানকে ফোন করে।
‘চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। জায়গা মতো উড়ো চিঠি চলে গেছে।’
‘ওহ উড়ো চিঠি? আর কিছু পারলে না? এগুলির কোনো দাম আছে? কেউ পাত্তা দেয়? নাহ কিচ্ছু হবে না, তোমাদের দিয়ে!’ শবনমের কণ্ঠে রাগ আর হতাশা।
‘না, ম্যাডাম, কাজ হবে। আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধুকেও তথ্যগুলো দিয়েছি। ও একটা রিপোর্ট করবে। আর বোর্ড মেম্বারদের কাছেও সব চিঠি পৌঁছে গেছে।’
‘শোনো, এভাবে না। হাতে হাতে কাগজগুলো দিতে হবে, বুঝলা! আমাদের সবচে প্রভাবশালী বোর্ড মেম্বার ওই যে বয়স্ক ভদ্রলোক ফাইজুল ইসলাম চৌধুরী সাহেব আছেন না, উনি প্রতি সন্ধ্যায় ঢাকা ক্লাবে যান। কাউকে ওইখানে পাঠাও। যাতে উনার নাম করে ডকুমেন্টসসহ খামটা রিসিপশানে রেখে আসে। বুদ্ধি খাটাও, মনিরুজ্জামান, যাতে একশন হয়।’
‘জি ম্যাডাম। ’
‘এসব ডকুমেন্টসের কপি যেন চেয়ারম্যান সাহেবের বাসাতেও যায়। আর শোনো, বোর্ড মিটিং শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার রুমে একদম আসবা না। তোমাদের সঙ্গে আমার কোনো যোগসাজশ নেই, বুঝতে পেরেছ?’
‘জি¦ ম্যাডাম। আপনাকে ভালবাসি। মন থেকে চাই আপনিই সিইও হোন।’
‘আচ্ছা, দেখা যাক ! যেমন বলছি তেমন করো আগে।’
ফোন রেখে একটু স্থির হয়ে বসে শবনম। তার মাথায় মেঘের মতো অনেক রকম ভাবনা এসে ভিড় করে।
চাকরি জীবনের শুরু থেকেই জেনে এসেছে, সিইও, কোম্পানির সবচে দৃশ্যমান শক্তিশালী আর আকর্ষণীয় পদ। প্রতিষ্ঠানের প্রায় সবারই ক্যারিয়ার গোল থাকে ওই পদটি অর্জন করার। আবার সিইও পদটি সবচে হট সিটও বটে। কারণ, বেশির ভাগ অফিসেই দেখা গেছে সিইওরা ব্যর্থ হয়ে বিদায় নেন, আর ফিরতে পারেন না। ছিটকে পড়েন শূন্যতায়। এটি একটি নিঃসঙ্গ দুর্বহ পথ যাত্রা। এখানে কেউ আপনার বন্ধু নয় কিন্তু বন্ধুর মুখোশধারী। এখানে একটু এদিক সেদিক হলেই আপনার ভুলগুলি দেখা হবে আতশ কাঁচের নিচে ফেলে, অনেক বড় করে। পরতে হবে স্টেকহোল্ডার আর সুবিধাবাদীদের টানা পোড়নের মধ্যে। অথচ এই ক্যারিসমেটিক, কমান্ডিং পদটি দখল করতে কত যুদ্ধ, কত আকাঙ্ক্ষা, কত তৎপরতা।
নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতার উপর আস্থা আছে শবনমের। কাজ তুলে আনা, প্ল্যানিং করা, সেটাকে বাস্তবায়িত করার দক্ষতাও আছে তার। বোর্ড অফ ডিরেক্টরদের সঙ্গেও সাধারণভাবে তার সম্পর্ক খারাপ নয়। সহজ, সুন্দর, আন্তরিক। কিন্তু দুইজন বোর্ড মেম্বার আছেন, যারা প্রচন্ড নারীবিদ্বেষী। তারা ভাবতেই পারেন না, যে নারীকে কোনো কোম্পানির দায়িত্ব দেওয়া যায় কিংবা নারীর মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ রয়েছে। তবে আশার কথা বোর্ডে তারা মাইনর পজিশনে আছেন, যদিও তারাই আবার সব মিটিং এ মেজর ধরনের লাফালাফি করতে থাকেন। এখন বোর্ডেও হেভিওয়েটদের বিচার বুদ্ধির উপরই ভরসা রাখতে হচ্ছে শবনমকে। কিন্তু সমাজটাই যেখানে পুরুষতান্ত্রিক সেখানে তাদের কাছে খুব বেশি কিছু আশা করাও তো দুরাশা।
এই যে এখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে অধস্তনদের সঙ্গে মিলে শবনমকে ফন্দি আঁটতে হচ্ছে, সত্যি বলতে কী সেটা তার এতদিনের চর্চা, অভ্যাস, স্বভাব ও রুচির সঙ্গে মেলে না। এসব অপ্রিয় কূটকৌশলে জড়াবার ইচ্ছাও তার কোনোদিন ছিল না। কিন্তু আবার বিনা প্রশ্নে, বিনা চ্যালেঞ্জে প্রাপ্য পদ ছেড়ে দেয়াটাও মানতে পারছে না সে। শবনম অভিজ্ঞ, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ বলেও সুনাম আছে তার। সে পরিশ্রমী, কর্মীদের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভাল। তারপরও যদি চোখের সামনে দুর্নীতিপরায়ণ, অসৎ, তেলবাজ একটা লোক শুধু ‘পুরুষ’ হওয়ার কারণে কোম্পানির সিইও হয়ে তার উপরে মাতব্বরি ফলায় তাহলে সেটা মেনে নেওয়া কঠিন বৈকি।
‘অতএব তুমি যা করছ তা ঠিকই আছে। যুধিষ্ঠিরের মতো নিখাদ সত্যবাদীও যুদ্ধে জেতার জন্য কপটতার আশ্রয় নিয়েছিল। তুমি কোন ছাড়? তুমি ভালো মানুষ, ঠিক আছে, কিন্তু ভালো হতে হতে ভালো থাকার নেশায় পড়লে চলবে না। এখানে যা করছো তা হচ্ছে কায়দা করে সত্যটা প্রকাশ করা। হ্যাঁ, এর সঙ্গে প্রাপ্তি যোগ আছে, কিন্তু তুমি সিইও হলে প্রতিষ্ঠানকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারবে সেই আত্মবিশ্বাস তো তোমার আছে।’ শবনম নিজেকে প্রবোধ দেয়। ভাবে পরিস্থিতিই তাকে বাধ্য করেছে এই পথ অবলম্বন করতে। সুতরাং আত্মগ্লানিতে ভোগার কিছু নেই। নিজেকে প্রমাণ করার যে সুযোগ সামনে হাতছানি দিচ্ছে, কোনোভাবেই সেই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>