ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৫
স্নানের শব্দ
অঞ্জনার বিউটি পার্লারে চার পাঁচ ঘণ্টা ধরে স্পা, অয়েল ম্যাসেজ, হেয়ার কেয়ার, পেডিকিউর, ম্যানিকিউর করিয়ে একদম ফ্রেশ ঝরঝরে প্রশান্তির একটা অনুভতি হলো শবনমের। মাঝে মাঝে পার্লারে এসে কাজ কর্ম ভুলে নিজেকে ছেড়ে দেওয়ার এই অভ্যাসটা রপ্ত করিয়েছিল রওশন আপা। শবনমের চাকরি জীবনের প্রথম দিককার সিনিয়র সহকর্মী। দেখতে যেমন সুন্দরি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন তেমনি মেধাবি, সবসময় আপাদমস্তক পরিপাটি ফিটফাট, সতেজ, সজীব একজন মানুষ।
শবনমকে বলতেন, ‘শেনো, নিজের যত্ন, নিজের আরামের ব্যবস্থা নিজেই করবা। নয়তো কাজ করার যে শক্তি উদ্যম সবই ফুরিয়ে যাবে। নিজে ভালো না থাকলে অন্যদের ভালো করবা কীভাবে? দুর্বল হলে কেউ কিন্তু তোমাকে দাম দিবে না।’
সেই রওশন আপা মারা গেলেন স্তন ক্যান্সারে ভুগে। অপারেশন, রেডিয়েশন, কেমো কিছুই তাকে বাঁচাতে পারল না। আপা অবশ্য খুব সাহসের সঙ্গে মৃত্যুটা মোকাবিলা করেছিলেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃদু গলায় স্পষ্ট বলেছিলেন,
‘দেখো যা অনিবার্য, তা নিয়ে কান্নাকাটির কি আছে? দুদিন আগে বা পরে মরতে তো হতোই! না হয় আমি একটু আগের স্টেশনেই নেমে গেলাম!’
রওশন আপা বেঁচে থাকলে, কর্মক্ষম থাকলে তিনি হয়ত কোম্পানির সিইও পদ পর্যন্ত পেতে পারতেন। কে জানে? শবনম-ই কি পারবে শেষ পর্যন্ত এই মইয়ের চূড়ায় উঠতে, এতো বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে ...!
শবনমের ভেতর থেকে কেউ যেন প্রশ্ন করে, চূড়ায় কি উঠতেই হবে? কীভাবে উঠবে? কি এমন হবে শীর্ষে উঠলে? না উঠলেই বা জীবনের কি এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে?
তার ভেতর থেকেই আবার উত্তর আসে, আমি না হলে অন্য কেউ ওই পদে যাবে, জায়গা তো খালি থাকবে না, তাহলে আমিই বা নই কেনো? যদি আমি যোগ্যতা সম্পন্ন হই, যদি আমার দক্ষতা থাকে, ভালো কাজের অভিজ্ঞতা থাকে, যদি গ্রহণযোগ্যতা থাকে, তবে ক্যারিয়ারের শিখরে কেনইবা উঠব না আমি? কেন পিছিয়ে থাকব? কেন গুটিয়ে রাখব নিজেকে? নিজের যোগ্যতা কেনো প্রমাণ করব না?
কিন্তু ব্যাপারটা কি এতই সোজা? গাছের ফলের মতো টুপ করে তোমার সামনে এসে পড়বে পদোন্নতি? বহুকালের ট্যাবু ভেঙে একজন নারীকে কি এত সহজে ওরকম উচ্চ পদে বসতে দেবে ওরা? তা নয় বলেই তো দুর্ভাগ্যজনক হলেও মনিরুজ্জামানদের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, ওরা কতটা সুচারুভাবে, কতটা দক্ষতার সঙ্গে প্রমাণসহ ওসমান গণির দুর্নীতির তথ্যটা উপযুক্ত জায়গায় অর্থাৎ ঊর্ধ্বতনদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থাপন করতে পারে! এটার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। আচ্ছা, আজকে কি ওরা বোর্ড মেম্বারদের কারো সঙ্গে দেখা করতে পেরেছে? শবনম ইচ্ছে করলে ফোন করে জেনে নিতে পারে, কিন্তু করল না।
পার্লার থেকে বেরুতে বেরুতে প্রায় সন্ধ্যা হলো। আকাশে বেলা শেষের রুগ্ন আলো। রাস্তার পার ঘেষে গাছ নেই, পাখি নেই, শুধু বিষণ্ন বাস, রিকশা, প্রাইভেটকার, ফুটপাথে ক্লান্ত অবসন্ন মানুষ। যেন ধোয়া ঠেলে, হর্ণ টিপে, মলিন বাতি জ্বালিয়ে কোনো অনিশ্চিত অন্ধকারের দিকে ছুটে যাচ্ছে তারা। একটু খিদে খিদে লাগছিল শবনমের। এরকম সন্ধ্যাগুলোতে নাস্তা হিসেবে পেঁয়াজ, কাচা মরিচ, সর্ষের তেল আর মচমচে চানাচুর মিশিয়ে মুড়ি মাখা হতো ওদের মফস্বলের বাসায়। কি অপূর্ব স্বাদ আর গন্ধ ছিল সেই মুড়ি মাখার! আহা, বড় হতে হতে শৈশবের সেইসব স্বাদ গন্ধ কোন অজানায় হারিয়ে যায়, আর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যায় না!
শবনম ভাবল, এই সন্ধ্যা নামা ব্যস্ত শহরে নিজেকে একটা ট্রিট দিলে কেমন হয়? ধানমন্ডির এদিকটায় অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট পাশাপাশি। দুই পা সামনে এগিয়ে ‘সিক্রেট আই’ নামের একটা রেস্টুরেন্টের কুয়াশাচ্ছন্ন কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল শবনম। লাউড স্পিকারে ড্রাম গিটারের চড়া বাদ্যসহযোগে ইংরেজি গান বাজছে, হাল্কা আলোয় অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা নিচু টেবিল ঘিরে বসে উচ্চস্বরে উদ্দাম আড্ডা দিচ্ছে। এই পরিবেশে তার বয়সী একজন একলা নারী হয়ত খানিকটা বেমানানই। একটু ইতস্তত করে বেরিয়ে আসবে কিনা একবার ভাবল শবনম। নীল ইউনিফর্ম পরা একটা কমবয়সী সুদর্শন ছেলে তাকে উদ্ধার করতে হাসি মুখে এগিয়ে এল তখন, কোণার দিকের একটা চেয়ার টেনে শবনমকে বসার ব্যবস্থা করে দিল সে। মেন্যু দেখে একটা চিকেন স্যান্ডউইচের সঙ্গে ল্যাটে কফি অর্ডার করল শবনম।
নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বসলো স্থির হয়ে। কেউ তাকাচ্ছে না তার দিকে, সবাই আপনাতে বিভোর, নিজেদের হৈ হল্লা আর কোলাহল ঘিরে নিজেরাই মগ্ন। ফলে এই মধ্যবয়সিনী নারী যে বেখাপ্পা আসবাবের মতো সমাবেশের কোণায় একাকী ঘাপটি মেরে বসে আছে তা নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা দেখা গেল না।
ফলে চারপাশের হৈচৈ উপেক্ষা করে আবার নিজের চিন্তায় ডুব দিল শবনম। মানুষের কত চাহিদা, তাই না? ভাবলো সে, এক জীবনে কত কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। প্রেম, বিয়ে, সন্তান, চাকরি, বাড়ি, গাড়ি। দৌড় আর দৌড়। এই জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কত কত মাইলফলক পেরিয়ে এসে কত কত সফলতার ফিতা ছুঁয়ে এখন আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার হাতছানি। পর্বতের রৌদ্র আলোকিত সোনালী চড়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তা স্পর্শ করতে হলে হাঁটতে হবে আরও অনেকদূর। থামা যাবে না।
মনিরুজ্জামানরা নিজে থেকে, বলতে গেলে স্বপ্রণোদিত হয়ে ওসমান গণির কাজ কর্মের ফাঁক-ফোঁকর খুঁজে বের করে নিয়ে তার কাছে এসেছে। হ্যাঁ, সে ওদের সেই কাজ করতে বলেনি, কোনো রকম উসকানিও দেয়নি। আবার বাধাও দেয়নি (অবশ্য বাধা দেবারই বা কি আছে!) উৎসাহিতও করেনি। বরং এই সময়ে ভাগ্যক্রমে এটা তার জন্য যুদ্ধে জেতার একটা মোক্ষম সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। না চাইতেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটা অস্ত্র, একটা কৌশল হাতে পেয়ে গেছে সে। যুদ্ধক্ষেত্রে তো সবই বৈধ। অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার। নিয়ম মানলে যুদ্ধে জেতা যাবে না। তবে এটাও ঠিক যে প্রতিপক্ষ চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। বিনা যুদ্ধে অন্য পক্ষও কি ছাড়বে সূচগ্র্য মেদেনী? ওরাও তো প্রাণপণ চেষ্টা করবে শবনমের ত্রুটি খুঁজে বের করতে।
পেছনের দিকে তাকিয়ে নিজের ভুল-ত্রুটি খোঁজার চেষ্টা করে শবনম। নাহ অফিশিয়াল কাগজপত্রে সইসাবুদ করার ক্ষেত্রে সে বরাবরই খুব সাবধানি, ভাল করে না পড়ে, না দেখে কোথাও সই করে না সে।
ওয়েটার টেবিলে গরম কফি আর স্যন্ডউইচ দিয়ে গেছে। শবনম স্যান্ডউইচ শেষ করে ধীরে ধীরে কফির কাপে চুমুক দেয়। একটু দূরে আবছা আলো আঁধারে দুই বন্ধুর সাথে বসে থাকা সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়া কোঁকড়া চুলের মেয়েটাকে দেখে হঠাৎ করে নাফিসা তানজিনার কথা মনে পড়ে তার। চেহারায় বেশ মিল আছে দুজনের। কে জানে আত্মীয় কি না। আহা, অফিস প্লেসে যৌন হয়রাণির ভয়াবহ ক্ষত আর বেদনা বুকে নিয়ে কেমন আছে নাফিসা? সর্বসমক্ষে সত্যটা বলতে পেরে মনের মধ্যে চেপে রাখা যন্ত্রণার খানিকটা উপশম কি হয়েছে তার? কে জানে?
বিল মিটিয়ে উঠে দাঁড়াতেই শবনমের সামনে দিয়ে মাথা ভর্তি রঙীন চুল দুলিয়ে একটা মেয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যায়। ওকে দেখে শ্রাবণের কথা মনে পড়ে শবনমের। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাসায় ফিরেছে মেয়েটা। হয়ত তারেকও ফিরেছে। অভ্যাসবশত ওরা ভাবছে শবনম অফিসেই আছে, মিটিং সিটিং নিয়ে ব্যস্ত। তাই কেউ ফোন করেনি। একটা উবার ডেকে বাড়ির পথ ধরে শবনম। তার মনে হয়, আজকের দিনটা কাটলো একটা সুতা ছেঁড়া ঘুড়ির মতো। কিছুটা উদ্দেশ্যবিহীন। সকালের আকস্মিক বৃষ্টি, সিদ্ধান্ত নিয়ে অফিস কামাই করা, খালি বাসায় কয়েক ঘণ্টা একলা সময় পার করা তারপর সৌন্দর্য চর্চার উসিলায় প্রায় একটা বেলা খরচ করে ফেলা এবং এলোমেলো ভাবনায় উড়ে চলা। নট ব্যাড। নিত্য কর্মের স্বাভাবিক চাঞ্চল্য থেকে এই সাময়িক মুক্তি, এই অচঞ্চল ঝিম ধরা একটা দিন, নিজের সঙ্গে নিজেই সকাল সন্ধ্যা মগজের ভেতর উল্টা পাল্টা কথোপকথন করে কাটিয়ে দেওয়া।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
স্নানের শব্দ: পর্ব-১৪