প্রবন্ধ
দেশের উন্নয়ন ও নিরন্ন মানুষের ক্রন্দন
পত্রিকার পাতায় একটি খবর দেখে বিস্মিত হলাম । আলবদর কম্যান্ডার রজব আলী ধরা পড়েছে। আট বছর তিনি ঢাকায় আত্মগোপন করে ছিলেন। আমি আরও জেনে অবাক হয়েছি যে, নিয়মিত পাকিস্তান যাওয়া আসা করত। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে রজব আলী কিভাবে পাকিস্তান যাওয়া আসা করত? বিমানবন্দরে কর্তৃপক্ষের আনুগত্য নিয়ে আমি প্রশ্ন করছি।
আমিতো চেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ঈদ করতে। কিন্তু এখনতো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নেই। রজব আলীর ঘটনা বলে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে বাংলাদেশ অনেকটা দূরে। ঈদ মানেতো খুশি। আমরা খুশি হতে চাই। আনন্দ করতে চাই। কিন্তু যদি দেশ পড়ে থাকে সেই পুরানো আমলে, অন্ধকার গহ্বরে। তাহলে আমি এই দেশে ঈদ কি করে করতে পারবো, সেটি আমার জানা নেই।
এর অবশ্য কারণ আছে। বাংলাদেশের বয়স ৫১বছর পেরিয়ে গেছে। তার মধ্যে সিংহভাগ সময় গেছে অবৈধ সামরিক স্বৈরাচারের আমলে। রাজনৈতিক সরকারের মধ্যে ১৯৯০এর পরে, যে সরকার আসছিল, তারা সম্পুর্ণভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিপন্থী। ২০০৮ এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত লাগাতার যে সরকার আছে, ঘোষণা অনুযায়ী তারা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে, কর্ম অনুযায়ী তারা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করছে। সর্ব সাম্প্রতিক উদাহরণটি হলো রজব আলী। আট বছর মানে তের বছর ক্ষমতায়। এই সরকারের আমলেই রজব আলী আত্মগোপনে ছিল। পুলিশ কি করে? আমরা যেমন জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় আমাদের সাফল্য ধরে রাখার চেস্টা করছি, র্যাব করছে, পুলিশ করছে, সেই সময়ে র্যাবের একজন কর্মকর্তার হিসাব তলব করেছে দুদক। এই সবকিছু মিলিয়ে আমি মনে করি, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে অনেকে বিচ্যুত। এই দেশে ঈদের আনন্দ আমার কাছে অর্থহীন।
ছোটবেলায় যে আনন্দ আমরা করেছি, সেটি নিষ্কলুষ আনন্দ ছিল। এখন আমি আনন্দ পাই না। কারণ ৬০/৭০ভাগ বৈষম্যের এই দেশে, আমি আর আনন্দ পাইনা। মানুষকে নাকি আনন্দিত হতে হয়, যখন তার দরিদ্র ভূমির নিরন্ন মানুষেরা আনন্দিত হয়। গতকাল একটি দেয়ালের লিখন পড়লাম, উন্নয়নের তলায় চাপা পড়েছে নিরন্ন মানুষের ক্রন্দন। দেশে উন্নয়ন হয়েছে, এটি আমি বিশ্বাস করি না। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। কারণ প্রবৃদ্ধি যখন সমতা ভিত্তিক হয়, তখন তাকে উন্নয়ন বলা যায়। পশ্চিম দুনিয়ায় মাথা পিছু আয়, অথবা যাদের গড় আয় এইসব পুঁজিবাদী হিসাব আমি গ্রহণ করি না। আমি চাই সারাদেশের মানুষের স্বস্তি এবং সারা দেশের মানুষের নিরাপত্তা। তাহলেই কেবল ঈদ সফল হবে বলে আমি মনে করি। আমরা সারা দেশে ৩৬৫ দিন ঈদ করতে পারি। শুধু একদিন নয়। মনে রাখতে হবে, বংগবন্ধুর দেওয়া সংবিধানের ৭/৮ ধারা অনুযায়ী জনগণই হচ্ছে এই রাষ্ট্রের মালিক। কোন সরকার নয়, কোন দল নয়, কোন গোষ্ঠী নয়। সরকারকে সেইভাবে কাজ করতে হবে। তবেই ঈদ অর্থবহ হয়ে উঠবে।
এখনতো ঈদুল আজহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদ। বাংলাদেশের সমাজে যারা কালো টাকার মালিক, প্রশ্নবিদ্ধ পথে অর্থ উপার্জন করেন, তারাই কিন্তু কোরবানিতে বেশি সক্রিয় হোন। আমি নিজে হজ করেছি। হজের সময় যা প্রত্যক্ষ্ করেছি, সেই অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি, বাংলাদেশে কোন কোরবানি হয় না। কারণ আমি হজ করতে গিয়ে দেখেছি, আমি টাকা দিলাম, কিন্তু আমার নামে কোন রশিদ পেলাম না। তার মানে আমাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো, কোরবানি আল্লাহ নামে। মানুষের নামে নয়। মানুষের নামে কোরবানি আল্লাহ কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। বাংলাদেশে ছাগল হলো এক নাম। গরু হলো সাত নাম। হাদিসে কোরআনে কোথাও নাই। আমি হজ করতে গিয়ে দেখেছি, তারাই শুধু কোরবানি দেন যারা হজব্রত পালন করেন। আরবের সাধারণ মানুষ কোন কোরবানি দেয় না। ঈদুল আজহা থেকে আমাদের মানবিক শিক্ষা নিতে হবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ