ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৮
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়েন হালিমা খাতুন। বড় বড় করে শ্বাস টানেন। বুকের ব্যথায় ককান। ওয়ার্ডের কর্মী অঞ্জনকে বলে, আপনি মেয়েটিকে নিয়ে সরে যান। আমি ডাক্তারকে খবর দিয়ে আসি। তিনি যেন এসে রোগী দেখেন। অঞ্জন কথা না বলে কুকড়ির হাত ধরে বেরিয়ে আসে। ওকে নিয়েই কলেজে গিয়ে ঢোকে। কমন রুমে ঢোকে। কুকড়িকে ওখানে রেখে পরের ক্লাসে যাবে। কমনরুমে গিয়ে দেখে অনেকে বসে আছে।
মিথিলা বলে, কিরে অঞ্জন এই বাচ্চা কোথায় পেলি তুই?
-রাস্তায় পেয়েছি। শহীদ মিনারের কাছে।
-ওকে এখানে এনেছিস কেন?
-ওকে এখানে বসিয়ে রেখে আমি ক্লাসে যাব। তোরা ওকে দেখেশুনে রাখবি। ও যেন বাইরে বেরিয়ে হারিয়ে না যায়।
মিথিলা ওকে কাছে ডাকে। জিজ্ঞেস করে, তোর নাম কী রে মেয়ে?
কুকড়ি চুপ করে থাকে। ওর কথা বলতে ভয় লাগে। এত বছর বয়স পর্যন্ত ও তো এমন ঘরে ঢোকেনি। এই নতুন পরিবেশ ওকে ভীত করে রেখেছে।
অঞ্জন ওর মাথা নাড়িয়ে বলে, কি রে তোর নাম বলছিস না কেন?
কথা বলে না কুকড়ি। মিথিলা ওর হাত ধরে টেনে এনে নিজের কাছে বসায়।
-তুই ক্লাসে চলে যা অঞ্জন। আমি ওকে দেখে রাখব। তুই ফিরে আসা পর্যন্ত আমি এখানে থাকব। তবে ওকে নিয়ে একটু ক্যান্টিনে যেতে পারি।
-খুব ভালো। ওকে কিছু খাওয়ারে মিথিলা। ও যদি খেতে না পারে তাহলে প্যাকেট করে ওর হাতে দিয়ে দিস। পরে খাবে।
-হ্যাঁ, ঠিক আছে। তুই বলেছিস ও রাস্তার মেয়ে। ওর অনেক কিছু দরকার রে।
-হ্যাঁ, আমি গেলাম। ক্লাস শুরু হওয়ার সময় হয়ে গেছে। ওর নাম কুকড়ি।
অঞ্জন চলে যায়।
কমনরুমে অন্য তিনজন ছেলেমেয়ে এসে মিথিলার কাছাকাছি বসে। কুকড়িকে দেখে।
-কি রে কুকড়ি তুই কেমন আছিস?
-আমি জানি না।
-জানিস না কেন? তোর ভালো লাগছে নাকি খারাপ লাগছে?
-এমন ঘর তো আমি কখনো দেখিনি। সেজন্য ভালো লাগছে। খুব সুন্দর ঘর।
-তোর বাবার নাম কী রে?
-আমি জানি না। আমার বাবাকে আমি দেখিনি।
-তোর বাবা কি মরে গেছে?
-না, বেঁচে আছে।
-কোথায় আছে?
-জানি না।
-তোকে দেখতে আসে না?
-না, আসে না।
মিথিলা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলে, হয়েছে থাক। ওকে আর প্রশ্ন করিস না। ও আমার কাছে বসে আছে থাকুক। অঞ্জন এসে ওকে নিয়ে যাবে। ওর মা হাসপাতালে।
মনসুর বলে, চল আমরা ক্যান্টিনে যাই। চা খেয়ে আসি।
সবাই উঠে দাঁড়ায়। একসঙ্গে বেরিয়ে আসে। ক্যান্টিনে ঢুকলে কুকড়ি চেঁচিয়ে বলে, আল্লাহ এটা কেমন ঘর?
সবাই হাসে। হাসতে হাসতে মিথিলা বলে, এটা খাবার ঘর।
-খাবার ঘরে পিঁড়া কই?
-এখানে পিঁড়া থাকে না। এখানে সব চেয়ার।
-আয় তোকে চেয়ারে বসিয়ে দেই।
রূপা ওকে উঁচুতে তুলে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। কুকড়ি বলে, আমি এখানে বসে খেতে পারব না।
-পারবি। বসে থাক।
ওরা চারজন এক টেবিলে বসে।
বেয়ারা এসে দাঁড়ালে ওকে শিঙাড়া, কেক, আর চা আনতে বলে। খাবারের অর্ডার দিয়ে মিথিলা সবার দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ ঠিক আছে। এর বেশি কিছু এখন আর খাওয়া যাবে না।
কুকড়ি জিজ্ঞেস করে, কেক কী?
-নিয়ে আসুক, তখন দেখবি কেক কী?
-আমি কেক দেখিনি।
-ঠিক আছে, আজকে দেখবি।
ও মাথা নাড়ায়। টেবিলে টুকটুক করে শব্দ করে। রফিক জিজ্ঞেস করে, কিরে এমন করে শব্দ করছিস কেন?
-আমার অনেক খুশি লাগছে। আমার মা এখানে থাকলে আমি আরও খুশি হতাম।
-তুই তোর মাকে খুব ভালোবাসিস না রে কুকড়ি?
-মা ছাড়া তো আমার কেউ নাই।
-খালা, মামা নাই?
-না, বলার সঙ্গে সঙ্গে ও কাঁদতে শুরু করে।
রূপা ওর মাথায় হাত রেখে বলে, চুপ কর সোনা। কাঁদিস না।
বেয়ারা খাবার নিয়ে আসে। মিথিলা বলে, এই যে দেখ এটা কেক। খেয়ে দেখ এটা খুব ভালো লাগবে।
-আমি খাব না।
-কেন রে?
-আমি মাকে কখনো খেতে দেখিনি।
-তুই এটা খা। আমরা তোর মায়ের জন্য আর একটা দেব। তুই নিয়ে মাকে খাওয়াবি।
ও খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে বলে, আচ্ছা। খাই। মুখে পুরে খুশিতে উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠে। মুখ থেকে হাসি ফুরোয় না। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ ফেরাতে পারে না ওকে দেখে। একটি শিশুর মায়াবী চেহারা ওদেরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সবার মাথায় ওর বড় হওয়ার ভাবনা জেগে থাকে। মিথিলা সবার দিকে তাকিয়ে বলে, অঞ্জনকে বলতে হবে ও যেন আর পথের মেয়ে না হয়।
-ঠিক বলেছিস। আমরা সবাই মিলে ওর দেখাশোনা করব।
কুকড়ি মনের আনন্দে কেক খেয়ে শিঙাড়ায় কামড় বসায়। ওদের কথা ও ঠিকমতো শোনে না এবং বুঝতেও পারে না।
ওর শিঙাড়া খাওয়া শেষ হলে মিথিলা বলে, চা খাবি রে?
-হ্যাঁ, ও জোরে জোরে মাথা নাড়ায়। আমি এক দিন-দুই দিন চা খেয়েছি। এখন খাব।
চা শেষ করে সবাই কমনরুমে ফিরে আসে। কুকড়ির হাতে দেওয়া হয়েছে কাগজে মুড়িয়ে ওর মায়ের জন্য শিঙাড়া আর কেক। মিথিলা ওকে বলে, তুই এখানে বসে থাক। ঘর থেকে বের হবি না। একটু পরে তোর অঞ্জন ভাইয়া আসবে। আমরা ক্লাসে যাই।
ও হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ যান।
চলবে....